দুর্ধর্ষ জঙ্গি সামিউন রহমান ওরফে ইবনে হামদুন। সিরিয়ায় আইএসের হয়ে নুসরা ফ্রন্টে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। ২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে সামিউন রহমানকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যায় সামিউন। পরে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ভারতের নয়াদিল্লি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। অবৈধভাবে ভুল তথ্য দিয়ে ওই জঙ্গি ভারতের পাসপোর্টও সংগ্রহ করেছিল। শুধু সামিউন নয়, এভাবে একের পর এক দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পৌনে দুই বছরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার ৭৭৯ জঙ্গির মধ্যে ৫৬৪ জন জামিনে বেরিয়ে গেছে।
এ হিসাবে ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ জঙ্গি জামিন পেয়েছে। কারাগারে রয়েছে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ জঙ্গি। জামিন পাওয়া অন্তত ৯ দুর্ধর্ষ জঙ্গির কোনো তথ্যই নেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। তাদের মধ্যে ঢাকা রেঞ্জের চারজন, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী এলাকায় দু’জন এবং রংপুরের এক জঙ্গি রয়েছে।
এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অদূরে পশ্চিম নাখালপাড়া এলাকায় জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় র্যাব। সেখানে অভিযানে তিন জেএমবি সদস্য নিহত হয়। উদ্ধার করা হয় গ্রেনেড, বিস্ম্ফোরক ও অস্ত্র। জঙ্গিরা এখনও নানা কৌশলে সক্রিয় বলে মনে করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এমন বাস্তবতায় জঙ্গিদের জামিন তাদের ভাবিয়ে তুলেছে।
এদিকে, জঙ্গিদের জামিন পাওয়া নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে চিহ্নিত জঙ্গিদের অকালীন জামিন পাওয়া বন্ধ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জঙ্গি অর্থায়নের বিশ্বব্যাপী আলোচিত প্রতিষ্ঠান ‘আইব্যাকসের’ সঙ্গে সংশ্নিষ্টরা জামিনে বেরিয়ে গেছে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এ ব্যাপারে এখনই প্রশাসনিক বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
জঙ্গি দমন অভিযানে যুক্ত পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, দীর্ঘ নজরদারি, গোয়েন্দা তথ্য বিশ্নেষণ, প্রযুক্তিগত ও স্থানীয় তদন্তের পর জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার জঙ্গি সদস্যদের তথ্যের ভিত্তিতেও গ্রেফতার হয় অনেক জঙ্গি। এরপরও তাদের অনেকে জামিনে বের হয়ে আবারও একই কাজে যুক্ত হচ্ছে। এতে জঙ্গি কার্যক্রম পুরোপুরি নির্মূল করা যাচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের জঙ্গি কার্যক্রম মনিটরিং সেলের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে সারাদেশে ১৭৮টি এবং ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৯টি জঙ্গি-সংক্রান্ত মামলা হয়। অর্থাৎ পৌনে দুই বছরে জঙ্গি-সংক্রান্ত মামলা হয় ২৭৭টি। মামলাগুলোতে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ৭৭৯ সদস্যকে গ্রেফতারের পর একই সময়ের মধ্যে ৫৬৪ জঙ্গি জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছে।
আদালতে পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের সূত্র জানায়, জামিনে থাকা জঙ্গিদের বেশির ভাগই নির্ধারিত দিনে আদালতে হাজিরা দিচ্ছে। তবে বাকি সময়টা সে কী করছে, জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে কি-না তা জানা যাচ্ছে না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, তারা সাধারণত জামিনে থাকা অভিযুক্ত জঙ্গিদের নজরদারি করে থাকেন। মাঝেমধ্যে ডেকে কথা বলেন। তবে বড় একটা সময়ই তারা নজরদারির বাইরে থেকে যায়।
এ ব্যাপারে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সমকালকে বলেন, জঙ্গিরা জামিন পাওয়ার পর সমাজে আবারও ভীতিকর অবস্থা তৈরি করতে পারে- এমন আশঙ্কা থাকে। তাদের জামিনের ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্টদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, অনেক সময় জঙ্গিদের ক্ষেত্রে যে অভিযোগগুলো পুলিশ দিয়ে থাকে সেখানে কিছু দুর্বলতা থাকে। বলা হলো জঙ্গির কাছে উগ্রপন্থি বই পাওয়া গেছে। দেখা গেল বইগুলোর নাম ঠিকমতো থাকে না। আবার আগে-পরে ওই জঙ্গি কী ধরনের ঘটনায় জড়িয়েছিল তারও উল্লেখ থাকে না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে জঙ্গিরা জামিন পেলে পরবর্তী সময়ে কী ধরনের আশঙ্কা থাকবে সেটা অনুধাবন না করেই জামিন দেওয়া হয়।
নিরাপত্তা বিশ্নেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, দ্রুত তদন্ত শেষ করে জঙ্গিদের ব্যাপারে সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে হাজির করা গেলে হয়তো বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে দীর্ঘদিন বিচার ছাড়া কারাগারে আটক রাখলে মানবাধিকারের বিষয়টি সামনে আসে। তবে এটাও ঠিক, জামিন পাওয়ার পর কোনো জঙ্গি যদি আবারও জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে আইন পরিবর্তন করে তাদের ব্যাপারে কঠোর হওয়া যেতে পারে।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, কোনো আসামিকে জামিন দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের। জামিনযোগ্য অভিযোগে যে কেউই জামিন পেতে পারেন। তবে তাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা থাকে জঙ্গিদের বিচারের মুখোমুখি করা।
তিনি আরও বলেন, জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা আইনের ফাঁক গলিয়ে যাতে জামিন না পায়, সে ব্যাপারে তারা চেষ্টা করেন। এর পরও কেউ জামিন পেয়ে গেলে আবারও যাতে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়াতে না পারে, সেদিকে নজরদারি থাকে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বলেন, র্যাবের হাতে গ্রেফতার ১৮ জঙ্গি জামিন পেয়েছে। তারা যাতে আবারও তৎপর হতে না পারে সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।
সিটিটিসির এডিসি আবদুল মান্নান বলেন, জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গিদের নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও তাদের আবার সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে। তাদের সঠিক পথে আনতে প্রয়োজন উদ্দীপনামূলক বিষয়ে সম্পৃক্ত করা।
২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপির বিভিন্ন থানায় দায়ের ৮০টি মামলায় গ্রেফতার জঙ্গি আসামিদের মধ্যে ৭৫ জন জামিনে রয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন থানায় দায়ের ১০টি মামলায় ১৬ জন, রাজশাহীর বিভিন্ন থানায় ৪টি মামলায় ১০ জন এবং সিলেটে ১১টি মামলায় ২৪ জঙ্গি জামিনে রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা রেঞ্জের বিভিন্ন থানার ১৪টি মামলায় ৩৩ জঙ্গি, চট্টগ্রামে ১৩ মামলায় ৩৩ জঙ্গি, খুলনায় ২০টি মামলায় ৪৮ জঙ্গি, বরিশালে এক মামলায় দুই জঙ্গি, রংপুরে ৮৯ মামলায় ৯৯ জঙ্গি এবং ময়মনসিংহে ২০ মামলার ৬৫ জঙ্গি জামিনে রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি জঙ্গি জামিনে রয়েছে রাজশাহী রেঞ্জের থানাগুলোতে। ওই রেঞ্জে ৩০টি মামলাতেই ১৫৯ জন জঙ্গি জামিনে রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালে দায়ের জঙ্গি-সংক্রান্ত ১৭৮টি মামলার মধ্যে তদন্ত শেষে একটি মামলায় আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ৮টি মামলা তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। ১৬৯টি মামলা তদন্তাধীন থাকলেও ৯টি মামলার বিচার শেষ হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৭ সালের শুরু থেকে গেল সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দায়ের ৯৯টি মামলার সবগুলোই তদন্ত চলছে।
তিন থানার মামলার ১৮ জঙ্গি জামিনে : সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁ থানায় ২০১৭ সালে সন্ত্রাসীবিরোধী আইনে দায়ের করা তিন মামলার ১৮ দুর্ধর্ষ জঙ্গি জামিন পেয়েছেন। জামিন পাওয়া সব জঙ্গিকে গত বছরের বিভিন্ন সময় পৃথক অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে র্যাব-১১।
র্যাব বলছে, জামিন পাওয়া সবাই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবির) সদস্য। গোয়েন্দা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গিদের মধ্যে রয়েছে মো. মোস্তফা ওরফে শামীম, শরীফুল ইসলাম ওরফে শাহীন, আবু রায়হান রবিন ওরফে হিমেল ও খন্দকার আবু নাইম। তাদের বিরুদ্ধে সোনারগাঁ থানায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়েছিল। এ ছাড়া জামিন পাওয়া জঙ্গিদের মধ্যে আছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ২০১৭ সালের ৭ এপ্রিল দায়ের করা ১৪ নম্বর মামলার আসামি আক্তারুজ্জামান, হাফেজ মাওলানা ওমর ফারুক, সেলিম হাওলাদার, কাউয়ুম হাওলাদার মিঠু, মামুনুর রশিদ, জামাল উদ্দিন ওরফে রাসেল জিহাদী, আবুল কাশেম মুন্সী ওরফে কাশেম, ফয়সাল আহমেদ ও জাবির হাওলাদার। রূপগঞ্জ থানায় ২০১৭ সালে ১১ জুন দায়ের করা ২৭ মামলার আসামি মো. ফারুক হোসেন, নবীন হোসেন রাব্বী, ইমরান আহমেদ, আবু বকর সিদ্দিক ও ইমরান আহমেদ। জামিনপ্রাপ্ত মামুনুর রশিদ জেএমবির দাওয়াতি শাখার সদস্য। জামিন পাওয়া আরেক জঙ্গি ইমরানের সঙ্গে সিরিয়ায় আইএসের হয়ে যুদ্ধে অংশ নেওয়া জুন্নুন শিকদারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এসব জঙ্গির জামিনে উদ্বিগ্ন র্যাব।