আবদুল্লাহ হারুন জুয়েল
সজীব ওয়াজেদ বা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল নিয়ে অপপ্রচার ও মিথ্যাচার নতুন নয়। পরবর্তিতে যুক্ত হয়েছে পুতুলের স্বামী খন্দকার মাশরুর হোসেন মিতুর নাম। যুক্তরাষ্ট্রের সেরা বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন করা জয়-পুতুলের মেধা ও যোগ্যতা সম্পর্কে সকলেই অবগত। এর ঠিক বিপরীতে রয়েছে জিয়া
ও এইট পাশ খালেদার পরিবার। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ সহ হেন অপকর্ম নেই যার সঙ্গে খালেদা পরিবারের নাম যুক্ত হয় নি; আর এ সকল অপকর্মের সবগুলোই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল। বিশ্ব ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট ও উইকিলিকসে তাদের দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। এমন কি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সিঙ্গাপুরের আদালতেও তারেক-কোকোর দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। জয়-পুতুলের সঙ্গে তারেক-কোকোর তুলনা করার নূন্যতম গ্রাউন্ডও নেই। কিন্তু তারপরও রাজনীতির গোলকধাঁধায় তারেকের টার্গেট হয় শেখ হাসিনার পরিবার। রাজনীতির প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা ছিল সুষ্ঠু ধারায়। তবে তা হয় নি পারিবারিক আভিজাত্য ও মর্যাদার পার্থক্যের কারণে। জিয়াউর রহমানের মা ছিলেন পাকিস্তান রেডিওর শিল্পী ও বাইজি। তাই বাইজির নাতি পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী তারেক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যম হিসেবে নোংরামি ও হাস্যকর মিথ্যাচারকে বেছে নিবে এটাই স্বাভাবিক।
২০১২ সালে সামহোয়্যার ইন ব্লগ, আমাদের প্রতিদিন, সোনার বাংলা সহ জামাত শিবিরের কিছু ওয়েবসাইটে এই মর্মে অপপ্রচার চলে যে, পদ্মা সেতুর ঘুষ নেয়ার কারণে কানাডার পুলিশ সায়মা ওয়াজেদের বাসায় রেইড দিয়ে পাসপোর্ট জব্দ করেছে, অথচ তখন পদ্মা সেতুর অর্থও ছাড় হয় নি। গুজব প্রচারের এক পর্যায়ে সায়মা ওয়াজেদ সাংবাদিকদের বলেন, “আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, কানাডায় আমরা দীর্ঘদিন ধরে আছি। আমাদের বেলায় এমন কিছু ঘটেনি যা নিয়ে সন্দেহের কিছু আছে। আমি নিউইয়র্ক থেকে কানাডা যাচ্ছি। যদি পাসপোর্টই জব্দ হয়, তাহলে সেখানে যাচ্ছি কীভাবে?”
সূত্র:
http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2012-09-16/news/290012
এ অপপ্রচারের ঠিক তিন মাস পর আবার গুজব তোলা হয়, “সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বাসা বাড়িতে হানা দিয়েছে কানাডার রয়্যাল পুলিশ”
সূত্র: https://www.somewhereinblog.net/blog/mahmoodkhan/29734339
পুলিশের উল্লেখ করে কবে, কোথায়, কোন একাউন্টে কত টাকা গেছে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করা হয়।
২০১৩ সালে আন্দালিভ পার্থ নামে একটি ফ্যান পেইজ থেকে খন্দকার মাশরুরকে নিয়ে একই ধারায় অপপ্রচার হয়।
https://facebook.com/andaleev/photos/a.566137253406712/633469123340191/
২০১৬ সালে কানাডার স্থলে আরব আমিরাতের নাম আসে। গত তিন চারদিন থেকে সেটিই প্রচার করা হচ্ছে, খন্দকার মাশরুর হোসেন গ্রেফতার হয়েছেন। গুজব রচয়িতার মেধা কোন পর্যায়ের তার প্রমাণ রয়েছে লাইনে লাইনে। নির্লজ্জ মিথ্যাচারের কিছু বিষয় উল্লেখ করছি:
১। মানি লন্ডারিংয়ের কথা বলা হলেও গ্রেফতারের সময় ল্যাপটপ, বিয়ারের ক্যান, সিম ইত্যাদি উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে যা হাস্যকর বললেও কম বলা হবে। এটা সম্ভবত ঢাকার ক্যাসিনো অভিযানের কথা ভেবে লেখা হয়েছে।
২। শামসুল আলম লেবার টাইপের পেশায় জড়িত তাই তার ধারণা হয়েছে সোর্স ছাড়া অর্থ আনলে গ্রেফতার করা হয়। সিভিল ও ক্রিমিনাল কোড কি সে সম্পর্কেও তার ধারণা নেই।
৩। আরব আমিরাতে ফান্ড লক হওয়ার খবর সবসময়ই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে বলে জঙ্গিগোষ্ঠির অর্থ হিসেবে সন্দেহ করা অর্থও আনলক করে।
সূত্র: https://gulfbusiness.com/uae-releases-496m-frozen-funds-ending-kuwait-dispute/
৪. বলা হয়েছে, পুলিশ সুইস একটি ব্যাংকে ৬৮০ মিলিয়ন ডলারের সন্ধান পেয়েছে। সেই একাউন্টের নম্বরও দেয়া হয়েছে। এটি সত্যি হলে প্রত্যেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেই সংবাদ হতো এবং সুইস সেই ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, একাউন্ট নম্বরের সঙ্গে কোডিং নম্বর হিসেবে উল্লেখ করে ৪টি সুইফট কোড দিয়েছে যা ডেবিট/ক্রেডিট ইনস্ট্রাকশন। তারেকের মত অর্ধশিক্ষিত মানুষদের আশ্বস্ত করার জন্য বোধহয় দেয়া হয়েছে।
৫. বৈষয়িক জ্ঞান থাকলে জানার কথা যে, আরব আমিরাতে টাকা আনা, বিনিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মিনিমাম বাধাও নেই। বরং অর্থপাচারকে উৎসাহিত করতে নাগরিকত্ব দেয়া শুরু করেছে। ফোর্বস সহ অনেক মিডিয়ায় অর্থের জবাবদিহিতা না থাকা নিয়ে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।
সূত্র: https://forbes.com/sites/dominicdudley/2019/01/29/dubai-has-become-a-money-laundering-paradise-says-anti-corruption-group
৬. মাশরুরের অর্থপাচারের কারণে আটক হওয়ার সূত্র হিসেবে U.S Public Law 106-229 এর উল্লেখ করেছে যা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আইন। এছাড়া Electronic commerce agreement (ECE/TRADE/257) হচ্ছে ইউরোপের জন্য জাতিসংঘ নির্ধারিত আইন। European
Community Directive No: 95/46/EEC এর মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৮ সালে। তিনটির কোনটির সঙ্গে আরব আমিরাত বা সুইস ব্যাংকের কোনো সম্পর্ক নেই। স্বাভাবিক বিবেচনাতেই বোঝা উচিত যে, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কাতার, আমিরাত, সুইজারল্যান্ড – এতগুলো দেশ নিয়ে জগাখিচুড়ির গল্প কতটুকু বাস্তবসম্মত হতে পারে! আরও হাস্যকর বিষয় হচ্ছে, কাতার ও আমিরাত সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টায় গত নভেম্বরে এ্যারাবিয়ান গালফ কাপে অংশ নিয়েছে। সেখান থেকে ফান্ড আসলে সম্পর্ক আরও জোরালো হওয়ার কথা, কিন্তু লেবাররা লিখেছে সম্পর্ক হানির কথা। আরব আমিরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে অর্থপাচার সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম চালায় এ কমিটি/সংস্থাগুলো যা নিয়মিত ব্রিফ করে থাকে।
ফান্ড ট্রান্সফার সম্পর্কে মিথ্যাচার করার আগে আরও স্টাডি করা উচিত ছিল। এক্ষেত্রে আইন ও পুলিশ কিভাবে কার্যক্রম করে সেটি জানতে দেখুন।
https://iclg.com/practice-areas/anti-money-laundering-laws-and-regulations/united-arab-emirates
৭. কোনো কারণে অর্থের উৎস নিয়ে সন্দেহ হলে ফান্ড লক বা হিসাব জব্দ করা হয়, গ্রেফতার বা পাসপোর্ট জব্দ করা হয় না। ৪ কোটি দিরহাম জমা দেয়ার কারণে পুলিশ নড়েচড়ে বসেছে বলা হয়েছে। আরব আমিরাতে ৪ কোটি দিরহাম যে বেশি টাকা নয় তা বোঝার জ্ঞান শামসুলের মতো লেবারের থাকার কথা নয়।
এত তথ্য প্রমাণ ও ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন ছিল না, তবু উল্লেখ করেছি এটা দেখাতে যে, বিএনপি নিজেরা ইতিবাচক কিছু করতে পারে নি, নেতাবাচক কিছু করলেও তাতে অযোগ্যতারই পরিচয় দেয়। কোনো গ্রহণযোগ্য মাধ্যম ছাড়া যারা গুজবের ওপর ভরসা করে উচ্চকণ্ঠ হোন, তারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মাধ্যমে জিয়া পরিবারের দুর্নীতি নিয়ে নীরব থাকেন কেন?
গার্ডিয়ান, রয়টার, সিএনএন, বিবিসি, ওয়াশিংটন পোস্ট বা যেকোনো গ্রহণযোগ্য সংবাদমাধ্যমের খালেদা পরিবারের দুর্নীতি ও অপকর্মের সূত্র রয়েছে অগণিত। মাইলফলক রিপোর্ট হিসেবে কয়েকটি লিংক দিচ্ছি।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে কোকোর দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট:
http://star.worldbank.org/corruption-cases/node/18464
http://star.worldbank.org/corruption-cases/node/18728
যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টে থাকা কোকোর দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট:
https://www.justice.gov/criminal/fraud/fcpa/docs/response3-appx-c.pdf
যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংকের এ্যাসেট রিকোভারি বিভাগে তারেকের দুর্নীতির তথ্য:
http://www.assetrecovery.org/kc/node/ba567240-2030-11de-a9b1-0d536ac86161.6
তারেক ও কোকোর অর্থপাচার নিয়ে এফবিআইএর প্রতিবেদন:
https://www.fbi.gov/washingtondc/press-releases/2009/wfo010909.htm
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট কেস-স্টাডিতে কোকোর দুর্নীতি:
http://papers.ssrn.com/sol3/papers.cfm?abstract_id=2052355
বৃটিশ সরকারের বাংলাদেশের দুর্নীতি বিষয়ক প্রতিবেদনে তারেক ও কোকোর দু্নীতি:
https://www.gov.uk/government/uploads/system/uploads/attachment_data/file/197481/evaluation-anticorruption-Bangladesh.pdf
উইকিলিংকস এ তারেক কোকোর দু্নীতি:
https://wikileaks.org/gifiles/docs/80/806713_bbc-monitoring-alert-bangladesh-.html
https://wikileaks.org/gifiles/docs/35/359123_-os-bangladesh-new-bangladesh-corruption-charges-.html
এ লিংকগুলি যাদের উদ্দেশ্য দেয়া তাদের এতে মোটেও লজ্জা হবে না কারণ নোংরামিই তাদের পেশা। আরব আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স শেখ মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান গত সপ্তাহে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার সম্মতি দিয়েছেন। ১১ই জানুয়ারি, ২০২০ আরব আমিরাতে শেখ হাসিনার পূর্ব নির্ধারিত সফর রয়েছে। দূষিত মানসিকতার প্রতিফলন ঘটাতে গত সাত বছর ধরে যে অপপ্রচার চলছে সেটি এবার বিশ্বাসযোগ্য করার দায়িত্ব নিয়েছেন সাকা চৌধুরীর গেলমান খ্যাত শামসুল আলমের মতো বিতর্কিত কয়েকজন। কোনো ধরণের সূত্র ছাড়া, নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ছাড়া যারা কল্পকাহিনীকে ভিত্তি করে রাজনীতি করে তাদের হাতে কখনোই আমরা নিরাপদ নই। সরকারের উচিত শামসুল আলমের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়।