1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা

নিউজ এডিটর : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২১

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
আমরা দেখেছি যে, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি সম্পন্ন হবার পর নবগঠিত ভারত রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ দেশে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতির সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের নীতি গ্রহণ করেন। অপরদিকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও মুসলিম লীগ নেতৃত্ব দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতির সংসদীয় শাসন অর্থাৎ জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণ না করে পূর্ব বাংলার নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর এক উপনিবেশ সুলভ নীতি চাপিয়ে দিতে চায়। এই নীতির অংশ হিসেবে তারা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। যেখানে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪.৬% লোক বাংলা এবং মাত্র ৭% লোক উর্দু ভাষায় কথা বলে সেখানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অর্থই ছিল বাঙালি জনগণকে দাবিয়ে রাখা, শোষণ করার এক ষড়যন্ত্র। প্রাসঙ্গিক কারণেই এখানে যদি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর সমগ্র পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষার পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয় তবে পাঠকের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর অধিপত্যবাদী নীতি ও শোষণের বিষয়টি আরও প্রতিভাত হয়ে উঠবে।
পরিসংখ্যানটি ছিল নিম্নরূপ:

ভাষা মোট জনসংখ্যা শতকরা হার
পশতু ৩৫,৮৯,৬২৬ ৭.১
বেলুচি ১০,৭৫,৯৯৯ ১.৪
সিন্ধী ৪৩,৫৯,২৮৭ ৫.৮
পাঞ্জাবী ২,১৪,৬৬৮১৫ ২৮.৪
ইংরেজী ১৩,৭৭,৫৬৭ ১.৮
উর্দু ৫৪,১৯,১৩১ ৭.২
বাংলা ৪,১২,৯১,৮৮৯ ৫৪.৬

মোটকথা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এই ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি।
প্রথমত, পূর্ব বাংলার জনগণকে নেতৃত্বশূন্য ও আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা। কারণ, বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে বাঙালি জনগণকে চাকরি তথা প্রশাসনে অংশগ্রহণের জন্য একটি বিদেশী ভাষা শিক্ষার বোঝা বহন করতে হতো। এতে করে বাঙালির স্বাভাবিকভাবেই অবাঙালিদের থেকে পিছিয়ে পড়তো।
দ্বিতীয়ত, পূর্ব বাংলার জনগণ বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত ছিল। তারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য গর্ববোধ করতো। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ছিল তাদের আদর্শ, চেতনা, মূল্যবোধ। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের এমন বাঙালি সংস্কৃতি প্রীতিকে সন্দেহের চোখে দেখতো। তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে হিন্দুদের সংস্কৃতি বলে মনে করতো। তারা আরও মনে করতো যে, পূর্ব বাংলার জনগণের এ ধরনের সংস্কৃতি চর্চা ভারতের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
মোটকথা, পূর্ব বাংলার জনগণের বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে তাদের নেতৃত্বশূন্য এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যেই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং এই ষড়যন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামীকরণের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিকাল ও ছাত্র মুজিবের ঢাকা আগমনঃ
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই মুসলিম লীগ শাসকগোষ্ঠী অত্যন্ত সুকৌশলে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণের অংশ হিসেবে নিত্য ব্যবহার্য খাম, ডাকটিকিট, রেলগাড়ির টিকিট, বিভিন্ন ধরনের ফরম প্রভৃতিতে বাংলা ব্যবহার বন্ধ করে দেয় এবং তার স্থলে ইংরেজী ও উর্দুর ব্যবহার শুরু করে। পূর্ব বাংলার শিক্ষিত ও সচেতন সমাজ এতে করে ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হয়। অবশ্য পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের প্রগতিশীল কিছু ছাত্র-কর্মী ভারত বিভক্তির পূর্বেই সরকারের এহেন ভূমিকা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাই মুসলিম লীগের মধ্যে প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের নিয়ে একটি গ্রুপ গঠন করা যায় কি না সেটা তারা ভাবছিলেন। ফলশ্রুতিতে জুলাই মাসে এসব ছাত্রনেতা ‘গণ আজাদী লীগ’ নামে একটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এই ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন কামরুদ্দীন আমহদ, তাজউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ প্রমুখ। গণআজাদী লীগের মেনিফেস্টোতে ঘোষণা করা হয় :
রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোন মূল্যই নাই, যদি সেই স্বাধীনতা জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়ন না করে, কারণ অর্থনৈতিক মুক্তি ব্যতীত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি অসম্ভব। সুতরাং আমরা স্থির করিয়াছি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে থাকিব।.. বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। এই ভাষাকে দেশের যতোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
এসময় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করলে, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখে এর প্রতিবাদ করেন। কিন্তু সেই প্রতিবাদের ভাষা ছিল যেমন জটিল তেমনি পরস্পর বিরোধীও। অবশ্য এটাও সত্য যে, তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সমর্থন করেননি। এ প্রসঙ্গে একজন লেখক লিখেছেন, “…জুলাইয়ের শেষদিকে দৈনিক আজাদ এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ড. শহীদুল্লাহ…বাংলাকে পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রভাষারূপে এবং উর্দুকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের সপক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। আরবী ও ইংরেজীকেও তিনি অনুরূপ মর্যাদা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নের সেই সময় তিনি যুক্তিসিদ্ধ বাস্তব সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিলেন একথা বলা কঠিন। তবে এ প্রশ্নে তাঁর অভিমতের গুরুত্ব এখানে যে তিনি একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষার দাবী সমর্থন করেননি।’ বদরুদ্দীন উমর সাহেবও অনুরূপ মন্তব্য করেন। তার ভাষায়, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর…ভাষা বিষয়ক মন্তব্য এবং সুপারিশ গুলির মধ্যে অনেক জটিলতা এবং পরস্পর বিরোধিতা থাকলেও এগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। জটিলতা এবং পরস্পরবিরোধী চিন্তা তার মধ্যেই শুধু ছিল না। সমসাময়িক রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং জনসাধারণের চিন্তার মধ্যেও এ জটিলতা এবং পরস্পর বিরোধিতা যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান ছিল।”
মোটকথা, উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রের জোরালো ও যৌক্তিক প্রতিবাদ শুধু ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহই নন পূর্ব বাংলার অনেক শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদও করতে পারেননি বরং অনেকে উল্টো উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছেন। তৎকালীন প্রগতিশীল ও গণতন্ত্রমনা ছাত্ররাই কেবল বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়ান এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ মুজিব কলকাতা থেকে ঢাকায় আগমন করেন এবং ১৫০ মোগলটুলীতে ওঠেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে। এসময় তাজউদ্দিনের সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়। তাজউদ্দিন সে সময় গণ আজাদী লীগের কার্যক্রমের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। শেখ মুজিবও এর সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীতে (১৯৫০) অবশ্য এই সংকলনটি ‘সিভিল লিবার্টিস লীগ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনঃ
আমরা আগেই দেখেছি যে ভারত বিভক্তির পূর্বেই মুজিব মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক ও সুবিধাবাদী রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন। তিনি পরিষ্কার উপলব্ধি করেছিলেন যে মুসলিম লীগের সাথে থেকে বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই মাউন্টব্যাটেনের ৩ জুন পরিকল্পনা ঘোষণার সাথে সাথে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের সিরাজোদ্দৌলা হোস্টেলে ছাত্র ও যুব নেতাদের নিয়ে এক রুদ্বদ্বার বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন এবং পূর্ব বাংলায় লীগ বিরোধী ছাত্র, যুব ও রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আর এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভারত বিভাগের পরপরই তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ঢাকায় মুসলিম লীগ বিরোধী ছাত্র, যুব ও রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। ফলশ্রুতিতেই প্রদেশব্যাপী প্রস্তুতির পর শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমেদ, শামসুল হক, তাজউদ্দীন আহমেদ, শামসুদ্দীন আহমেদ, তসাদ্দক আহম্মেদ প্রমুখের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গঠিত হয় পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও এর সভাপতি মনোনীত হন তসাদ্দক আহমেদ। এই সংগঠনটি ছিল সারা পাকিস্তানে একমাত্র অসাম্প্রদায়িক সংগঠন। যুবলীগ নবগঠিত পাকিস্তানের গণতন্ত্র, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও ভাষা বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। উক্ত প্রস্তাবে বলা হয় :
বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্ত ই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।
এছাড়া যুবলীগ তার প্রচারিত ইস্তেহারে আরও দাবি করে যে,
রাষ্ট্রের অধীনস্ত বিভিন্ন এলাকার পৃথক পৃথক সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশকে সরকার স্বীকার করিয়া নিবেন, জীবন এবং সংস্কৃতিকে গড়িয়া তুলিতে এইসব এলাকার সকল ব্যাপারে স্বায়ত্তশাসন মানিয়া লইতে হইবে।
যদিও সরকারী দমন-নির্যাতন, সরকারী-বেসরকারী প্রেস মিডিয়াগুলোর অসহযোগিতার কারণে ১৯৪৮ সালেই গণতান্ত্রিক যুবলীগের বিলুপ্তি ঘটে তা সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনে এই সংগঠনটির ভূমিকা কম নয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এটিই ছিল প্রকৃত অর্থে প্রথম সরকার বিরোধী সংগঠন; সরকারের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রথম প্রতিবাদ।
উল্লেখ্য যে, এসময় (১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রের সমন্বয়ে তমদ্দুন মজলিশ নামে একটি ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম। এই সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল ‘কুসংস্কার, গতানুগতিকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা দূর করে সুস্থ ও সুন্দর তমদ্দুন গড়ে তোলা, খ. যুক্তিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মভিত্তিক সাম্যবাদের দিকে মানব সমাজকে এগিয়ে নেয়া, গ. মানবীয় মূল্যবোধের ওপর সাহিত্য ও শিল্পের মারফত নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা এবং ঘ. নিখুঁত চরিত্র গঠন করার লক্ষ্যে গণজীবনের উন্নয়নে সহায়তা করা। সংগঠনটি ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এতে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করার দাবি জানানো হয়। এতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, আদালত ও অফিসের ভাষা হবে বাংলা। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা থাকবে দুটি উর্দু ও বাংলা। পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা হবে বাংলা, দ্বিতীয় উর্দু এবং তৃতীয় ভাষা হবে ইংরেজী।
উক্ত পত্রিকায় আবুল মনসুর আহমদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল কাসেম প্রমুখ বুদ্ধিজীবী বাংলা ভাষার সপক্ষে জোরালো যুক্তি সহকারে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখে বাংলার শিক্ষিত সমাজকে সচেতন করে তোলেন।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিকে তমদ্দুন মজলিশের ভূমিকা বেশ সক্রিয় হলেও ভাষার দাবিতে আন্দোলনের সাথে সাথে বাঙালি সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রকট হতে থাকলে এই সংগঠনটি নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর মযহারুল ইসলাম লিখেছেন, “পরবর্তীকালে এই তমদ্দুন মজলিশ যদিও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল তবু ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে এর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। মুসলিম সংস্কৃতি বলতে যে আরবীয় সংস্কৃতির চিন্তা এঁদের মনে ছিল বাংলা জাতীয়তাবাদ চেতন প্রকট হবার সাথে সাথে তার সাথে তাদের গরমিল দেখা দিল স্বাভাবিকভাবেই বাংলা জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে এরা আর সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারলেন না।
করাচীর শিক্ষা সম্মেলন ও প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনঃ
১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচীতে যে শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। আর এই সংবাদ ঢাকায় এসে পৌছলে শিক্ষিত সম্প্রদায় খুব বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়। তার পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বাংলা ভাষা বিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে স্পষ্টভা অবগত হয় এবং এর প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এক প্রতিবাদ সভা আহ্বান করে। এর মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আবুল কাসেম, কল্যাণ দাসগুপ্ত, এ.কে.এ আহসান প্রমুখ বক্তৃতা করেন। তারা এক গৃহীত প্রস্তাবে বাংলাকে পাকি নের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা ও শিক্ষা মাধ্যম করার দাবি জানান।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিকে তমদ্দুন মজলিশের বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা ছিল। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যখনই কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই সংগঠনটি তার জোরাল প্রতিবাদ জানিয়েছে। আর এই প্রতিবাদ শামিল হয়েছে ঢাকার শিক্ষিত সচেতন মানুষ ও ছাত্রসমাজ। শেখ মুজিবও রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বহু কাজে এই সংগঠনটিকে সাহায্য ও সমর্থন করেছেন। যাই হোক, করাচীর শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবটি পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সমাজকে খুব মর্মাহত করে। তারা তমদ্দুন মজলিশের বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনে একত্মতা ঘোষণা করে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে রশিদ বিল্ডিং নামে একটি বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতেই ছিল তমদ্দুন মজলিশের অফিস। ভাষার দাবিতে শিক্ষিত সচেতন মানুষ, বিভিন্ন সংগঠনের নেতা কর্মীদের এই অফিসটি তাই হয়ে ওঠে মূলকেন্দ্র। আর এই অফিসেই তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে মুসলিম ছাত্রলীগ, গণতান্ত্রিক যুব লীগ ও তমদ্দুন মজলিশের সমন্বয়ে গঠিত হয় প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া। এই পরিষদ বাংলা ভাষার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বেশকিছু কর্মসূচী গ্রহণ করে। এসব কর্মসূচীর অংশ হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ঢাকা সফরে এলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তার সাথে দেখা করে পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার বিষয় তালিকা থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেয়া, পাকিস্তানের মুদ্রা, ডাকটিকিট ইত্যাদিতে বাংলা ভাষা স্থান না পাওয়ার কারণ জানতে চান এবং এগুলোতে বাংলা ভাষা প্রবর্তনের দাবি জানান। ফজলুর রহমানের সাথে সাক্ষাতের পর পরিষদ ফেব্রুয়ারি মাসেই বাংলা ভাষার দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর অভিযান শুরু করে এবং কয়েক হাজার মানুষের স্বাক্ষর নিয়ে সেটি সরকারের কাছে পাঠায়। উল্লেখ্য যে এই স্বাক্ষর অভিযানে অন্যান্যদের সাথে শেখ মুজিবও অংশগ্রহণ করেন এবং সেজন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন ও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকাঃ
আন্দোলনের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উপনিবেশিক মনোভাব ও কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক যুবলীগের পর যে ছাত্র সংগঠনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেটি হলো পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এটি ছিল তখন পূর্ব বাংলায় একমাত্র সরকার বিরোধী সংগঠন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগই হল তখন প্রথম ছাত্র সংগঠন যে সংগঠনটি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্রলীগ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর কলকাতার ছাত্রজীবনের সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেতে হলে তাই ছাত্রলীগের অতীত ইতিহাসের প্রতি আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। আমরা দেখেছি যে, ভারত বিভক্তির পূর্বে অর্থাৎ ব্রিটিশ ভারতে মুসলমান জনগোষ্ঠী বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানরা শিক্ষা দীক্ষায় পশ্চাৎপদ ছিল। আর্থ রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তারা ছিল বেশ অবহেলিত। এমন একটা পরিস্থিতিতে মুসলমান ছাত্ররা নিজেদের অধিকার দাবি- দাওয়া সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতেই ১৯৩৭ সালে গঠিত হয় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন নামে একটি ছাত্র সংগঠন। ১৯৩৮ সালে ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন বিলুপ্ত করে গঠন করা হয় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এই সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কলকাতার হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে এই সংগঠনটির পক্ষ থেকে শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করেন-যা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। তা ছাড়া এই সংগঠনের মাধ্যমে শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা শেখ মুজিবসহ অন্যান্যরা ঢাকায় চলে আসেন এবং ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এর নামে কাজে শুরু করেন। এসময় অবশ্য পূর্ব বাংলায় ছাত্র ফেডারেশন’ নামে কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত একটি ছাত্র সংগঠন মোটামুটি সক্রিয় ছিল। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ সরকারের নির্যাতন ও দমননীতির কারণে এ ছাত্র সংগঠনটি প্রায় ঝিমিয়ে পড়ে। যাই হোক, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের তখন প্রতিদ্বন্দ্বী দুই নেতা ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান ও শেখ মুজিবুর রহমান। শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ও মুসলিম লীগ সরকারের কট্টর সমর্থক। অপরদিকে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অসাম্প্রদায়িকতার অনুসারী এবং মুসলিম লীগ সরকারের ঘোর বিরোধী। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও মুসলিম লীগ নেতাদের উপনিবেশিক আচরণ, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রভৃতি উপলব্ধি করে সরকার বিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্যে একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
ফলশ্রুতিতেই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে এক কর্মীসভায় গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। নবগঠিত এই সংগঠনটিতে শুধুমাত্র কৌশলগত কারণেই ‘মুসলিম’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় পরবর্তীকালে সুযোগ বুঝে শেখ মুজিব মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নামকরণ করেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন নঈমুদ্দীন আহমদ। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সাংগঠনিক কমিটি ছিল নিম্নরূপ :
১. নঈমুদ্দীন আহমদ, ২. আব্দুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল), ৩. শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর) ৪. অলি আহাদ (কুমিল্লা), ৫. আজিজ আহমদ (নোয়াখালী), ৬. আবদুল মতিন (পাবনা), ৭. দবিরুল ইসলাম (দিনাজপুর), ৮. মফিজুর রহমান (রংপুর), ৯. শেখ আব্দুল আজিজ (খুলনা), ১০. নওয়াব আলী (ঢাকা), ১১. নুরুল কবির (ঢাকা), ১২, আব্দুল অজিজ (কুষ্টিয়া) ১৩. সৈয়দ নূরুল আলম ও ১৪. আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করে তার মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করা। এছাড়া সামরিক বাহিনীতে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে নিয়োগ, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, পাকিস্তান নৌবাহিনীর সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তর ইত্যাদি। এই সংগঠনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং নেতা কর্মীরা ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
গণপরিষদে ভাষা বিষয়ক বিতর্ক ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনঃ
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এই অধিবেশনে পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজীর সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম সরকারী ভাষা করার প্রস্তাব করেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং সাম্প্রদায়িক রং মাখিয়ে বলেন :
প্রথমে এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য নির্দোষ বলিয়া আমি ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু বর্তমানে মনে হয় পাকিস্তানের আধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।
তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং মুসলিম জাতির ভাষাই হইবে। ইহার রাষ্ট্রভাষা। উপমহাদেশের দশ কোটি মুসলমানের দাবির ফলে পাকিস্তানের সৃষ্টি হইয়াছে এবং এই দশ কোটি মুসলমানের ভাষা হইল উর্দু।
পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনও এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব যে একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।” ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবটি নিয়ে গণপরিষদে তুমুল বিতর্ক হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা বাতিল হয়ে যায়।
বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম সরকারী ভাষার দাবি বাতিল হবার সংবাদ পূর্ব বাংলায় এসে পৌঁছলে প্রগতিবাদী ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী মহল ক্ষোভে ফেটে পড়ে। গণপরিষদের এই বাংলাভাষা বিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকার ছাত্র সমাজ বাংলা ভাষার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে শহর প্রদক্ষিণ করে। আর এই মিছিলের পুরো ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ধর্মঘট শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় পূর্ব বাংলার কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে বাংলা ভাষার পক্ষে গণপরিষদে এমন শক্তিশালী ও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, সেদিন গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত বাংলা ভাষার প্রস্তাবটি যারা সমর্থন করেছিলেন তাঁদের সকলেই ছিলেন হিন্দু এবং কংগ্রেস দলীয়। কোন বাঙালি মুসলমান সদস্য এই প্রস্তাব সমর্থন করেননি। এ প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন,”…পরিষদে মুসলমান সদস্যের সকলেই ছিলেন সরকারী মুসলিম লীগ দলভূক্ত এবং তারা দলগতভাবে বাঙালি আবাঙালি নির্বিশেষে সমস্বরে প্রস্তাবটির নিন্দা এবং বিরোধিতা করেছিলেন। অন্যপক্ষে প্রস্তাবটি যাঁরা উত্থাপন করেন এবং তার সমর্থনে বক্তৃতা করেন তাঁরা সকলেই ছিলেন হিন্দু এবং কংগ্রেস দলভূক্ত।”
আমরা আগেই দেখেছি যে, নেতৃত্বের কোন্দল, মতাদর্শগত বিতর্ক, সাংগঠনিক দূর্বলতা, নেতাদের দূরদর্শিতার অভাবে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যথার্থ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। এসময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সরকার বিরোধী একমাত্র ছাত্র সংগঠন হওয়ার সুবাদে ভাষা আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে চলে আসে। শেখ মুজিবসহ এই সংগঠনের অন্যান্য নেতারা ভাষা আন্দোলনকে আরও বেগবান করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভা আহ্বান করা হয় । কামরুদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, রনেশ দাসগুপ্ত, অজিত গুহ, আবুল কাসেম, কাজী গোলাম মাহবুব, নঈমুদ্দীন আহমেদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, তাজউদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, সরদার ফজলুল করিম, শামসুদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল আলী প্রমুখ। এই সভায় পূর্ববর্তী সংগ্রাম পরিষদ বিলুপ্ত করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদুন মজলিশ, বিভিন্ন হল সংসদের দু’জন করে প্রতিনিধি নিয়ে গঠন করা হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সর্বদলীয় পরিষদ। এই পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। পরিষদ ১১ মার্চ সারা পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে এবং তা সফল করার জন্য ব্যাপকভাবে পিকেটিং করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ঐতিহাসিক ১১ মার্চ, ১৯৪৮ঃ শেখ মুজিবের কারাবরন
১১ মার্চ সকালেই ধর্মঘট সফল করার জন্য ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে অবস্থান গ্রহণ করে। শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রমুখ সেক্রেটারিয়েটের পাশে পিকেটিং-এর জন্য অবস্থান নেয়। শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শামসুল হক প্রমুখ সেক্রেটারিয়েটের ১ নং গেট (আব্দুল গনি রোড), কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রমুখ ২ নং গেটে (তোপখানা রোড) অবস্থান নেন। রমনা পোস্ট অফিসের সামনে অবস্থান নেন মোহাম্মদ তোয়াহা, সরদার ফজলুল করীম প্রমুখ। সেক্রেটারিয়েটের ১ নং এবং ২ নং উভয় গেটেই পুলিশের সাথে এসব ছাত্র নেতার তুমুল বাকবিতগ্তা হয়। ১ নং গেটে পুলিশ অফিসার শামসুদ্দোহার সাথে শেখ মুজিবের উত্তপ্ত তর্ক বিতর্ক হয় এবং এক পর্যায়ে তা হাতাহাতিতে গিয়ে দাঁড়ায়। পুলিশের সাথে কথা কাটাকাটির অভিযোগে শেষপর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলীকে গ্রেফতার করে ওয়াইজঘাটের কতোয়ালি থানায় এবং সেখান থেকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ছাত্রনেতাদের সাথে অনেক কর্মীও কারাবরণ করেন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। এদিন শুধু ছাত্র নেতারাই নয় স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণিত ছাত্র, সাধারণ জনগণ, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী এক নব উদ্যোমে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে এবং প্রচণ্ড বিক্ষোভের মাধ্যমে সরকারের ভিত্তি কাপিয়ে দেয়। উল্লেখ্য যে ১১ মার্চের এই ধর্মঘট শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ না থেকে সারা দেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। এই দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে কে.জি. মুস্তাফা অত্যন্ত চমৎকার কিছু কথা বলেছেন। কে.জি. মুস্তাফ ১৯৫২ সালের মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস মুলতঃ প্রাচীন ও নবীন চিন্তাধারার দ্বন্দ্বের ইতিহাস।…১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব পাশ হওয়ার পর এ দ্বন্দ্ব সুস্পষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ করতে আরম্ভ করে। তৎকালীন মুসলিম লীগের প্রাচীনপন্থীদের নিকট লাহোর প্রস্তাবের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র সমবায় (Sovereign and Independent states) গঠনে প্রতিশ্রুতি ভারবর্ষের, বিশেষতঃ বাংলাদেশের তরুণ বুদ্ধিজীবী সমাজকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে। তারা আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করেছিল, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা তাদের আত্মবিকাশের দ্বার উন্মুক্ত করবে। বিভিন্ন সংস্কৃতির স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে, গণমুক্তির প্রথম স্তররূপে জাতীয় মুক্তির পথ প্রশস্ত করবে। তাদের একান্ত প্রত্যয় ছিল, বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় সত্তারূপে পাকিস্তান গড়ে তুলতে জাতীয় সার্বভৌমত্বের যে স্বীকৃতি অপরিহার্য, লাহোর প্রস্তাব তা সুনিশ্চিত করেছে এবং পাকিস্তানকে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী করার মূলমন্ত্র ঐ স্বীকৃতিতে নিহিত।
প্রাচীনপন্থীরা নব্যশক্তির মোকাবিলায় ইতিহাসকে বিকৃত করার মহাজনী পন্থা অবলম্বন করলেন-কালক্ষেপন না করে তারা ঘোষণা করলেন এক আল্লাহ, এক কোরান, এক রসূলের অনুসারী মুসলমানদের আবাসভূমি পাকিস্তান হবে এক রাষ্ট্র, একভাষা এক সংস্কৃতির দেশ। লাহোর প্রস্তাবের states শব্দের “S” কে তারা অ্যাখ্যা দিলেন টাইপের ভুল।
লাহোর প্রস্তাবের এই বিকৃত ব্যাখ্যার প্রবক্তারা ভারতের সদ্য বিকাশোখ মুসলিম অর্থনৈতিক স্বার্থের সক্রিয় সহযোগিতায় বলীয়ান। সুতরাং অধিকতর এই বেপরোয়া মনোবৃত্তির নগ্ন প্রকাশ ঘটলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই প্রথমে রেসকোর্স ময়দানে এবং পরে কার্জন হলের সুধী সমাবেশে।…কলকাতা সিটি মুসলিম ছাত্রলীগ “শহীদ-হাসিম’ গ্রুপের উদারপন্থী মুসলিম মহল এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ মুসলিম তরুণ বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সম্মিলিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করলেন আসন্ন সংগ্রামের সম্মুখীন হওয়ার জন্য। পূর্ব পাকিস্তানে একটি গণতান্ত্রিক যুবসংস্থা ও একটি প্রগতিশীল ছাত্রসংস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা গৃহীত হ’ল। পরবর্তীকালে জন্ম নিল পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ (শামসুল হক ও আতাউর রহমানের নেতৃত্বে) এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটি (শেখ মুজিবুর ও মঈনুদ্দিনের নেতৃত্বে) প্রবীণ চিন্তাধারা ১৫ই আগস্টের পর যেমন পেলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক শক্তির উৎসাহ,নবীন চিন্তাধারা পেলো সাংগঠনিক শক্তির হাতিয়ার ও উচ্চতর আদর্শের ধর্ম। ফলে উভয় চিন্তাধারায় স্বাধীনতাপূর্ব কালের সুপ্ত দ্বন্দ্ব স্বাধীনতা উত্তরকালে সুস্পষ্ট সংকটে রূপান্তরিত হল এবং যে সংকটের গভীরতায় যে অভিব্যক্তি ঘটলো কার্জন হলে সেই সূধী সমাবেশ-একমাত্র উর্দুর আসফালন স্তব্ধ হয়ে গেল বজ্রকণ্ঠের না ধ্বনির তরঙ্গাঘাতে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি (৫২) আন্দোলনের পথিকৃত ১১ ই মার্চের (৪৮) আন্দোলন ছিল এই ঐতিহাসিন না’ ধ্বনির উত্তাল তরঙ্গ। ঢেউ লাগলো সারা প্রদেশে। স্বাধীনতাকামী জনসমষ্টির যেন নবযাত্রা শুরু হল। তরুণ সমাজ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর থেকে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। পুলিশের মুখোমুখি। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠ। এরা পাকিস্তানের দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তিমিছিলে সামিল হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী স্লোগানে কলকাতার রাজপথ কাপিয়ে তুলেছে। ১৯ জুলাইয়ের (১৯৪৬) সর্বাত্মক হরতাল সফল করেছে, ‘রশিদ আলী দিবসের যৌথ নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করেছে। ইতিহাসের গতি নির্ণয় করেছে এরা বালুঘাট উপনির্বাচনে, ৪৫ ও ৪৬ এর সাধারণ নির্বাচনে।
১১ই মার্চ এঁদের ত্যাগের পরীক্ষা, ঈমানের পরীক্ষা, নবলব্ধ চেতনার অগ্নিপরীক্ষাই জয়ী হ’ল। চারদিন সংগ্রামের পর।
১১ মার্চের গ্রেফতার ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ১৩ মার্চ ১৯৪৮ থেকে ২৫ মার্চ ১৯৪৮ মার্চ পর্যন্ত কর্মসূচিঃ
১৩ মার্চ পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বাংলায় হরতাল পালিত হয় এবং পরিষদ ২৫ মার্চ পর্যন্ত হরতাল অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৫ মার্চ পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা থাকায় সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ধর্মঘট সফল করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
১৫ মার্চের ধর্মঘটে ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও সেক্রেটারিয়েটসহ রমনা এলাকার বিভিন্ন কর্মকর্তা কর্মচারী এমন কি রেল কর্মচারীরাও শামিল হয় এবং ভাষার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এভাবে ভাষার দাবিতে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পরিষদের নেতাদের সাথে আপোসরফা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও নাজিমউদ্দীনের মধ্যে আট দফা দাবি সম্বলিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির দাবীগুলো ছিল নিম্নরূপ:
১. ভাষা আন্দোলনে ধৃত বন্দীদের অবিলম্বে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে হবে।
২. পূর্ব বাংলার আইনসভা এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে যে, পূর্ব বাংলার অফিস আদালতের ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা।
৩. বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করে পূর্ব বাংলার আইনসভা বিশেষ প্রস্তাব গ্রহণ করবে।
৪. ভাষা আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না।
৫. পুলিশ কর্তৃক ভাষা আন্দোলনকারীদের অত্যাচারের অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে বিবৃতি দিবেন।
৬. সংবাদপত্রের উপর থেকে নিষেদাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।
৭. ২৯ ফেব্রুয়ারি হতে পূর্ব বাংলার যেসব স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে সেখান থেকে তা প্রত্যাহার করা হবে।
৮. ভাষা আন্দোলনকারীরা পাকিস্তানের শত্রু নয়, মঙ্গলকামী বলে বিবৃতি দিতে হবে।
চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবার পূর্বে আবুল কাসেম, কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটক শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ ছাত্র-নেতার সাথে দেখা করেন এবং তাদেরকে চুক্তিটি দেখান। তাঁরা চুক্তির দাবীগুলো দেখার পর সেগুলো সমর্থন ও অনুমোদন করেন। এরপর সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বর্ধমান হাউসে ফিরে এলে সরকারের পক্ষে খাজা নাজিমুদ্দীন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কামরুদ্দীন আহমদ চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে পুলিশ ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ ও কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে করে ছাত্ররা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এক বিরাট মিছিল সহকারে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সামনে এসে হাজির হয়। তমদ্দুন মজলিস নেতা অধ্যাপক আবুল কাসেম ছাত্রদের শান্ত করার জন্য নাজিমুদ্দীনের সাথে তাদের চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি বলেন। এতে করে ছাত্ররা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং আবুল কাসেমকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে।
এসময় তোয়াহা প্রমুখ ছাত্রনেতা দ্রুত সেখানে এসে ছাত্রদের শান্ত করার চেষ্টা করেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, চুক্তিটি চূড়ান্ত কিছু নয়, এটাকে কেন্দ্র করে শুধু আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে মাত্র। সরকার যদি তাদের ভাষা সম্পর্কিত দাবি না মানে তবে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। তারপরও ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে এবং দাবি করে যে, স্বয়ং নাজিমুদ্দীনের মুখ থেকে চুক্তিটি সম্পর্কে শুনতে চায়। কিন্তু নাজিমুদ্দীন সেখানে না উপস্থিত হওয়ায় ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন অব্যাহত রাখে। শেষ পর্যন্ত ছাত্রনেতারা বাধ্য হয়েই পরদিন অর্থাৎ ১৬ মার্চ ধর্মঘট আহবান করে।
সেদিনই অর্থাৎ ১৫ মার্চ চুক্তি অনুযায়ী ভাষা আন্দোলনে বন্দী ছাত্রদের মুক্তি দেয়ার জন্য জেল গেটে আনা হলে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেদিন কমিউনিস্ট নেতা সত্যেন সেন, রনেশ দাশগুপ্ত ছাড়াও জাকির হোসেন, শওকত, আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে মামলা থাকায় তাদের মুক্তির নির্দেশ আসেনি। ফলে তাদেরকে বাদ দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য বন্দীরা জেলখানা পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। এতে করে জেলগেটে চরম উত্তেজনা ও হৈ হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরকার সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। জেল থেকে মুক্তি পাবার পর শেখ মুজিবসহ অন্যান্য ছাত্রনেতাকে একটি ট্রাকে করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করানো হয় এবং সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে তাদের সংবর্ধনা দেয়া হয়।
১৬ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে ১৫ মার্চ সম্পাদিত চুক্তির কয়েকটি স্থান সংশোধন করে সেই সংশোধনী প্রস্তাব সাধারণ ছাত্র- ছাত্রীদের সভায় পেশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শেখ মুজিব সেই নির্ধারিত ছাত্রসভায় উপস্থিত হলে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে সেই সভায় সভাপতিত্ব করার অনুরোধ জানান। শেখ মুজিব তাতে রাজী হন এবং তাঁর সভাপতিত্বে সভার কাজ শুরু হয়। সভায় নিম্নোক্ত প্রস্তাবগুলো গৃহীত হয়:
১. ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় পুলিশী বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তদন্তের জন্য সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত এবং সরকারী ও বেসরকারী সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিটি নিয়োগ করতে হবে।
২. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের সুপারিশ করে প্রস্তাব গ্রহণের উদ্দেশ্যে আলোচনার জন্য পূর্ব বাংলার আইন পরিষদের অধিবেশন চলাকালে একটি বিশেষ দিন নির্ধারণ করতে হবে।
৩. সংবিধান সভা কর্তৃক তার উপরোক্ত সংশোধনী প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করাতে ব্যর্থ হলে সংবিধান সভার এবং পূর্ব বাংলা মন্ত্রিসভার সদস্যদের পদত্যাগ করতে হবে।
প্রস্তাবগুলো গৃহীত হবার পর সেটি অলি আহাদের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। শেখ মুজিব এরপর বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন এবং বক্তৃতা শেষে সাধারণ ছাত্রদের পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হবার আহবান জানান। এরপর এক বিরাট মিছিল সহকারে তিনি পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হন এবং মিছিলের পুরোভাগে থেকে স্লোগান তোলেন, “চলো চলো এ্যাসেম্বলি চলো” । মিছিলটি পরিষদ ভবনের কাছে এলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। ছাত্ররা এতে বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং নাজিমুদ্দীন মন্ত্রিসভার পদত্যাগ ও পুলিশী নির্যাতনের অবসান দাবি করে। এসময় পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও বন্দুকের ফাকা আওয়াজ শুরু করলে শওকত আলীসহ ১৯ জন ছাত্র মারাত্মক আহত হন। এরপর ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে সংগ্রাম পরিষদ ১৭ মার্চ ঢাকায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও বিক্ষোভের কর্মসূচী গ্রহণ করে। পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ১৭ মার্চ ঢাকাসহ প্রদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়।
এভাবে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য ছাত্রনেতার সুযোগ্য ও সাহসী নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন সারা প্রদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং তা গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এই আন্দোলনে শুধু ছাত্র সমাজই নয় ছাত্রনেতাদের বিশেষ করে শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে বৃদ্ধ বয়সে ফজলুল হকও অংশগ্রহণ করেন এবং পুলিশী নির্যাতনের শিকার হন। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর মযহারুল ইসলাম লিখেছেন:
শেখ মুজিব একজন বলিষ্ঠ প্রত্যয় সম্পন্ন এবং অসমসাহসী যুবনেতা হিসেবে ছাত্র-সমাজে এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করতে থাকে। শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আব্দুল মতিন, শামসুল হক প্রমুখ যুবনেতার কঠোর সাধনার ফলে বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ব বাংলায় একটি গণ আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল। জনসভা, মিছিল আর শ্লোগানে সমগ্র বাংলাদেশ যেন কেঁপে উঠতে লাগল। রাস্তায় দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার ‘রাষ্ট্রভাষা বংলা চাই’। দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্ত ভাবে কাজ করে যেতে লাগলো। এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে ওতপ্রােত সম্পর্কে যারা নিরলস কাজ করেছেন সেইসব ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন অন্যতম। শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেবার বেলায় অন্যান্যদের মধ্যে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয় এমনকি তারই প্রেরণায় ৭৬ বছরের বৃদ্ধ শেরে বাংলা ফজলুল হক পর্যন্ত এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নিলেন।… ছাত্রদের ওপর হামলা চালালো । এমনকি, তারা শেরে বাংলাকেও আঘাত করতে দ্বিধাবোধ করল না।
যাই হোক, সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ১৭ মার্চ হরতাল পালিত হয়। সেদিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নঈমুদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে সংগ্রাম পরিষদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় ১৯ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা আগমন উপলক্ষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরবর্তী ধর্মঘট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
 মোহাম্মদ আলীর জিন্নাহর ঢাকা আগমন, জানি কিছু অজানা কথাঃ
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষার দাবিতে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তাতে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্ব বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। উপরস্ত পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগ নেতৃত্বে উপদলীয় কোন্দল, গণবিচ্ছিন্নতা (যা আমরা বিস্তারিত পরে আলোচনা করবো) প্রভৃতি কারণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯ মার্চ ঢাকা সফরে আসেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে প্রায় এক বছর আগে পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা যে কায়েদে আজমকে মাথায় নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল জিন্নাহর ঢাকা আগমনে সেই ছাত্র জনতার মধ্যে তেমন কোন স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষ্য করা গেল না। এ প্রসঙ্গে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা, শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর ডায়েরীতে লিখেছেন :
…১৯ মার্চ, ১৯৪৮ সালে কায়দে আযম এসেছেন ঢাকায়। রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার লোক।…একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, লোকজনের মধ্যে শ্লোগান তোলার মতো তেমন উচ্ছাস দেখা গেল না। সাম্প্রতিক পুলিশী নির্যাতনের ফলে ছাত্ররা নিস্পৃহ। রাতে শহরের নানা জায়গায় বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল।
যাই হোক ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ জিন্নাহ বিকেলের দিকে ঢাকা এসে পৌঁছান। এরপর ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণদানকালে বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে বলেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। যারা এ ব্যাপারে বিভ্রান্তির-সৃষ্টি করছেন তাঁরা বিদেশী রাষ্ট্রের অর্থভোগী চর তথা পাকিস্তানের শত্ৰু। রাষ্ট্রভাষা একটি হলে কোন জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে না। জিন্নাহর এই বক্তব্য সাধারণ মানুষ তেমন কোন প্রতিবাদ না করলেও ছাত্ররা ঠিকই না’ ‘না বলে এর প্রতিবাদ করে। আর ছাত্র সমাজের এই সমবেত প্রতিবাদেও নেতৃত্ব প্রদান করেন শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ ও আব্দুল মতিন। এ প্রসঙ্গে জিল্লুর রহমান এক নিবন্ধে বলেছেন :
..ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি (জিন্নাহ) বলেছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। জিন্নাহ সাহেবের এ উক্তির সাথে সাথেই জনতার মধ্য থেকে প্রতিবাদ উঠেছিল। সকলকে আমি চিনতাম না। কিন্তু অনেকের মধ্যে আমাদের বঙ্গবন্ধু, সেদিনকার মুজিব ভাই-তিনিই সকলের আগে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘না’ বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।
যদিও শেখ মুজিবের এই না’, ‘না’ প্রতিবাদ সেদিন রেসকোর্সের বিশাল জনসমুদ্রের গুঞ্জনে চাপা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হলে তা আবার গর্জে উঠল । আর এবার শুধু শেখ মুজিব, আব্দুল মতিন বা তাজউদ্দিন নয় বরং কার্জন হলের সকল ছাত্রের কণ্ঠে তা ধ্বনিত হল। উক্ত সমাবর্তনে জিন্নাহ আবারও ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ বলে ঘোষণা দিলে ছাত্রদের ‘না’, ‘না’ প্রতিবাদ গুঞ্জনে জিন্নাহর কণ্ঠস্বর যেন স্তিমিত হয়ে এল। বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন ভাষায় :
…রেসকোর্সের বক্তৃতা এবং এই একই সমাবর্তন বক্তৃতায় প্রথম দিকেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা জিন্নাহ যে কারণেই বলেছেন সেখানেই তিনি সেটাকে একটা ঘোষণার মতো প্রচার করেছেন। কিন্তু এই প্রথম তিনি উর্দুকে উল্লেখ করতে গিয়ে অপেক্ষাকৃত মৃদু ভাষা প্রয়োগ করে বললেন, ‘আমার মতে একমাত্র উর্দুই হতে পারে সেই ভাষা।
মোটকথা, রেসকোর্সের ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাঙালির প্রাণের ভাষা, মায়ের ভাষা বাংলাকে কটাক্ষ করে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাতে করে বাংলার ছাত্রসমাজ পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিল যে জিন্নাহ কার্জন হলের সমাবর্তনেও বাংলা ভাষাকে আক্রমণ করে অনুরূপ বক্তব্য রাখবেন। তাই শেখ মুজিবুর রহমান, আব্দুল মতিন, তাজউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ ছাত্রনেতা জিন্নাহর বাংলাভাষা বিরোধী এমন আচরণের প্রতিবাদ করার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। ফলশ্রুতিতেই ২৪ মার্চ জিন্নাহ একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দিলে কার্জন হলের ছাত্ররা সম্মিলিতভাবে না’, ‘না প্রতিবাদ করে জিন্নাহর কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করে দেয়।
কার্জন হলের ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় সংগ্রাম পরিষদ ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সাথে পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হন। অবশ্য এসব বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল ছাত্র রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন। তাই সেসব বৈঠকে তিনি ভাষার ব্যাপারে কোন আপোষ রফা না করে বরং একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি ইতোপূর্বে সংগ্রাম পরিষদ ও নাজিমুদ্দীন সরকারে (প্রাদেশিক সরকার) মধ্যে সম্পাদিত ভাষা সম্পর্কিত চুক্তিটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন এবং পূর্বের ন্যায় অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেন যে, উর্দু ব্যতীত অন্যকোন ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবি করার অধিকার পাকিস্তানের কোন নাগরিকের নেই। শুধু তাই নয় সে দাবি কেউ উত্থাপন করলে, একথা নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয়া হবে যে, সেই ব্যক্তি রাষ্ট্রের শত্রু, ভারতের পোষা গুপ্তচর এবং সেই হিসেবে নাগরিক অধিকারের অযোগ্য।
এসময় মুসলিম ছাত্রলীগের শাহ আজিজুর রহমানের গ্রুপটি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সমর্থন ও আশীর্বাদ লাভ করে। ফলে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে শাহ আজিজুর রহমানের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। শেখ মুজিব স্পষ্ট বুঝতে পারেন যে, জিন্নাহসহ মুসলিম লীগ নেতৃত্ব শুধু ভাষার প্রশ্নেই নয় আর্থ-রাজনৈতিক কোন প্রশ্নেই বাংলার জনগণকে সহানুভূতি দেখাবে না। তাই তিনি মুসলিম লীগ রাজনীতি থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেন এবং তাজউদ্দিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শামসুল হক, নঈমুদ্দিন আহম্মদ, কামরুদ্দিন আহমেদ প্রমুখের সাথে মাতৃভাষা বাংলাসহ অন্যান্য আর্থ-রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে মুসলিম লীগ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।
কিন্তু মুসলিম লীগের অব্যাহত ষড়যন্ত্র, সরকারের দমননীতি, নির্যাতনে এ প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়। শেখ মুজিবের ক্রমবর্ধমান ভাষার আন্দোলন ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদানে ঈর্ষান্বিত হয়ে সরকার তাঁকে ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কারারুদ্ধ করেন। উল্লেখ্য যে এই দিনেই অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন।
মুজিবের গ্রেফতারের কারণে ভাষা আন্দোলনের গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে আসলেও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ, গণতান্ত্রিক যুব লীগভুক্ত নেতাকর্মীরা ও সাধারণ ছাত্রসমাজ ভাষার দাবিতে আন্দোলন বেগবান করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম শরীক তমদুন মজলিসের পিছুটান ও আপোসকামিতা এই উদ্যোগকে ব্যাহত করে। এ প্রসঙ্গে একজন গবেষক লিখেছেন :
..এই পর্বের আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিশের পিছুটান ও আপোসকামিতা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। বস্তুত এই সংগঠন রাজনৈতিক চিন্তায় প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী ছিল। সম্ভবত বাংলা রাষ্ট্রভাষা বিষয়টিকে তাদের এই বিশেষ প্রয়োজনের অংশ হিসেবেই তারা দেখতে চেয়েছিলেন, বাঙালি জাতিসত্তার সাথে সমন্বিত করে নয়। মতাদর্শগত এই বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা ভাষা আন্দোলনকে একটি সংকীর্ণ দৃষ্টির পরিসীমায় ধরে রাখতে চেয়েছিলেন এবং এই জন্য তারা আন্দোলনে আপোসপন্থা গ্রহণে দ্বিধা করেননি। এর প্রমাণ মার্চে জিন্নাহ সাহেবের পূর্ববঙ্গ সফর উপলক্ষে ভাষা বিষয়ক লক্ষ্য অর্জনে তাদের আনন্দ ও প্রত্যাশা এতই স্পষ্ট ছিল যে, কোন দূরদর্শিতার পরিচয় না রেখেই লীগ শাসকদের সাথে সমঝােতার ভিত্তিতে তারা মাঝপথে আন্দোলন স্থগিত করে দিতে এতটুকু দ্বিধা করেননি। এমনকি জিন্নাহ সাহেবের চলে যাবার পর লক্ষ্য অর্জনে চূড়ান্ত ব্যর্থতা সত্ত্বেও সেই স্থগিত আন্দোলন শুরু করা কোন উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেননি। এই বিষয়ে সংগ্রাম পরিষদকে উজ্জীবিত করার কোন চেষ্টাও তারা করেননি।
তমদ্দুন মজলিসের এমন আপোসকামী মনোভাবের কারণে এই সময় আন্দোলন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও একেবারে থেমে যায়নি। এসময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা সাধারণ ছাত্রসমাজকে সঙ্গে নিয়ে ভাষার দাবিতে আন্দোলনে শরীক হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এসময় (১৯৪৯ সালে) বাংলাকে ধ্বংস করার লক্ষ্য হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এক বিবৃতির মাধ্যমে এর জোরালো প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদলিপিতে ছাত্রনেতা নঈমুদ্দিন আহমদ বলেন, “…তোগলকী প্ল্যানের উদ্যোক্তাদের আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই যে, আরবি বর্ণমালার ধুয়া তুলে গত বছরের ভাষা প্রস্তাব নাচক করার ষড়যন্ত্রকে আমরা কোনমতেই সহ্য করে নেব না।”
শেখ মুজিব : ছাত্রনেতা থেকে জননেতাঃ
শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবার প্রায় একমাস পর অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে জেলখানা থেকে মুক্তি লাভ করেন। জেলখানা থেকে বের হয়েই তিনি ভাষা আন্দোলনসহ পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনে শরীক হন। ২৯ জুলাই তিনি নারায়ণগঞ্জে এক সাংগঠনিক সফরে যান এবং সেখানে ছাত্রলীগের প্রকাশ্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী এই গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতায় তিনি ছাত্রলীগের ১০ দফার অন্যতম দাবি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পাকিস্তানের নৌবাহিনীর সদর দপ্তর করাচি থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তরের দাবি জানান।
এছাড়া ১৯৪৮-৫০ সালে পূর্ব বাংলায় খাদ্য সংকটের ফলে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তাতে প্রায় ২০ হাজার লোক গ্রাণ হারায়। এই দুর্ভিক্ষর প্রতিবাদে শেখ মুজিব আন্দোলন গড়ে তোলেন। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে ঢাকা সফরে আসেন এবং ওঠেন ‘বর্ধমান হাউসে।’ ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে শেখ মুজিব বিক্ষোভ কর্মসূচী জোরদার করেন এবং আরমানিটোলা ময়দানে এক বিশাল জনসভায় তিনি সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। উক্ত জনসভায় দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “একজন অন্যজনকে খুন করলে তার ফাঁসি হয়। যে নুরুল আমীন শত শত লোক খুন করেছে তার কি হওয়া উচিত? তাকে এই মাঠের মধ্যে এনে গুলি করা উচিত। উক্ত জনসভায় তিনি পূর্ববঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন সভা ভেঙ্গে দিয়ে সার্বজনীন ভোটাধিকারের নতুন নির্বাচনের দাবি জানান। জনসভা শেষে প্রায় ৫০ হাজার লোকের এক বিশাল মিছিল নিয়ে মুজিব বর্ধমান হাউসের দিকে অগ্রসর হলে নবাবপুর রেলক্রসিং এ পুলিশ মিছিলে বাধা প্রদান ও লাঠি চার্জ করে। মিছিল থেকে মওলানা ভাসানী ও শামসুল হককে গ্রেফতার করা হয়। প্রেফতারের পূর্বে মওলানা ভাসানী আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য শেখ মুজিবকে সরে যেতে বলেন। শেখ মুজিব খুব কৌশলে মিছিল থেকে সরে পড়েন এবং পরবর্তীতে আত্মগোপন অবস্থায় সারা বাংলায় জেলা ও মহকুমা পর্যায়ের সরকারী দপ্তরগুলোতে খাদ্যের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান ও বিক্ষোভ কর্মসূচী জোরদার করেন। কিন্তু আবারও তিনি মুসলিম লীগ সরকারের কোপানলে পড়েন এবং ১৯৫০ সালে ১ জানুয়ারি গ্রেফতার হন।
মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে ১৯৫০ সালের জুন মাস নাগাদ মুক্তি দেয়া হলেও সরকার শেখ মুজিবকে জেলখানার অন্ধ প্রকোষ্ঠে আটকে রাখে। কারণ শেখ মুজিবের সাহসী ও উদীয়মান বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিল তখন প্রাদেশিক সরকারের বড় আতঙ্ক। শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় তিনি জেলখানায় আটক থাকলেও একেবারে বসে থাকেননি। ভাষা আন্দোলনসহ সরকার বিরোধী অন্যান্য আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।
ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত কালপর্বঃ
১৯৫০-৫১ সালের মধ্যে পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগ সরকারের দমননীতি ও নির্যাতন, খাদ্য ঘাটতি ও দুর্ভিক্ষ, ভায়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম শরীক তমদ্দুন মজলিসের পিছু টান ও আপোসকামিতা প্রভৃতি কারণে ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসলেও ১৯৫২ সালে তা আবার জোরদার হয়ে ওঠে। বস্তুত ১৯৫২ সালেই ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। ১৯৫১ সাল রাওয়ালপিণ্ডির এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। প্রধানমন্ত্রী হবার পর লিয়াকত আলী খানের মতো তিনিও বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তিনি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির কথা ভুলে গিয়ে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে জিন্নাহ ও লিয়াকত আলীর সুরে ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পরদিন (২৭ জানুয়ারি) পল্টন ময়দানের জনসভায়ও তিনি ঘোষণা দেন যে, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তিনি আরও বলেন যে, ‘একাধিক রাষ্ট্রভাষা থাকতে পারে না এবংয় এতে কোন রাষ্ট্র শক্তিশালী হয় না।’ নাজিমুদ্দিনের এমন ঘোষণায় ঢাকার ছাত্র সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মধুর ক্যান্টিনে এক জরুরী সভার আয়োজন করে। উক্ত সভায় গাজীউল হক নাজিমুদ্দিনের বাংলাভাষা বিরোধী আচরণের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করেন এবং স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট মুসলিম লীগ সরকারের কবল থেকে মায়ের ভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য ছাত্র-জনতার প্রতি আকুল আহ্বান জানান। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন :
“ভাইসব, ফ্যাসিস্ট লীগ সরকার আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। নাজিমুদ্দিন কাল বলেছেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বেঈমান! বেঈমানের দল বারবার আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, চুক্তি করেছে বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। বারবার সে চুক্তি ভেঙ্গেছে। আজ ওদের কথার জবাব দেবার সময় এসেছে। ওরা আমাদের প্রাণের ভাষা, বাপ-দাদার মুখের বুলি কেড়ে নিতে চায়। এদেশের মাঝি আর মনের আনন্দে ভাটিয়ালি গান গাইতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ নজরুল-মাইকেল-সুকান্ত আমাদের কাছে হয়ে যাবে ইতিহাসের বস্তু, মায়ের কাছে চিঠি লিখব-উর্দুতে ঠিকানা লিখতে হবে। উর্দু না জানার অপরাধে সরকারী চাকরি বাকরি থেকে বঞ্চিত থাকবে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে উর্দুভাষী ছেয়ে ফেলবে বাংলাদেশ। আমাদের বুকের উপর দাঁড়িয়ে আমাদেরই খবরদারী করবে তারা। সোনার বাংলাকে দেউলে করবে। শুষে নেবে সমস্ত সম্পদ। বাঙালীকে ভিখারীর জাত বানিয়ে ওরা আমাদের তাবেদার বানাবে। …একটা জাতিকে ধ্বংস করার প্রধান উপায় হলো তার ভাষা কেড়ে নেওয়া। ভাষা কেড়ে নিয়ে ওরা আমাদের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিতে চায়। বজ্রকণ্ঠ তার প্রতিবাদ করার সময় এসেছে। পূর্ব বাংলার সাড়ে চার কোটি লোক আজ ছাত্র সমাজের দিকে উন্মুখ হয়ে চেয়ে রয়েছে। মায়ের সম্মান রাখতে এগিয়ে আসুক ছাত্র-সমাজ। ঝাপিয়ে পড়ক মহাসংগ্রামে। লীগ সরকার দেখুক, বাংলার ছাত্র জনতা তথা সাড়ে চার কোটি বাঙালীর অমিত শক্তি। আমরা যদি সকলে মিলিত আওয়াজ তুলি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ফ্যাসিস্ট লীগ সরকার নিপাত যাক-তাহলে শুধু সেই প্রচণ্ড গর্জনের তোড়েই লীগ সরকার ভেসে যাবে।”
উক্ত সভায় ৩০ জানুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ঢাকাসহ সারা বাংলার স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরা সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করে এবং আওয়াজ তোলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আমাদের দাবি মানতে হবে নইলে গদি ছাড়তে হবে।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ গঠনঃ
এমতাবস্থায় ৩১ জানুয়ারি (১৯৫২ সালের) ঢাকার বার লাইব্রেরীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, খেলাফতে রব্বানী পার্টি, তমদুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৬২ প্রভৃতি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ১৯৪৭ সালের ৫ ও ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামে যে সংগঠনটি গড়ে ওঠে পাকিস্তান সরকারের দমন নীতির কারণে অল্পদিনের মধ্যেই তার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ সরকারের বাংলা ভাষার বিরুদ্ধাচরণ, অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ, সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতা প্রভৃতির প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্ত নের কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তায় পূর্ব বাংলার কিছু তরুণ ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠন করেন। এসময় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত না হলেও সরকারের দমনীতি ও নির্যাতনের কারণে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে বাধ্য হয় এবং যুবলীগের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
একুশে ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বানঃ
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হরতাল পালন করে। ৩০ জানুয়ারি ছাত্রসভা থেকে আবার ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্টভাষা সংগ্রাম পরিষদ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ এই হরতাল সফল করার জন্য জোর তৎপরতা চালায়। ফলে ঢাকায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঐ দিন (৪ ফেব্রুয়ারি) সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতাল শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে এক বিশাল ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় গাজীউল হক ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি (মতান্তরে ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি) পতাকা দিবস এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সার পূর্ব বাংলায় হরতাল কর্মসূচী ঘোষণা করেন।
আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে অর্থ সংকটের সম্মুখীন হওয়ায় ছাত্র সমাজ এই দু’দিন পতাকা দিবস পালন করে। আর ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন থাকায় ছাত্ররা এই দিন ধর্মঘটের ডাক দেয়।
এদিকে ৬ ফেব্রুয়ারি ১৫০ মোগলটুলীতে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যে সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচীর প্রতি পূর্ণ একাত্মতা ঘোষণা করা হয়। উক্ত সভায় ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবসের প্রস্তাব গ্রহণ করে জনগণকে সাধ্যানুসারে অর্থ সাহায্য প্রদানে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল সফল করার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া উক্ত সভায় একুশে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনেরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
অবশ্য কেউ কেউ লিখেছেন ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় বার লাইব্রেরীতে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে যে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ গঠিত হয় সেই পরিষদ ঐ দিনই সারা প্রদেশব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল কর্মসূচী গ্রহণ এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
যাইহোক, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সার প্রদেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচী ঘোষণা করলে নূরুল আমীন সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে একমাসের জন্য ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি এবং সকল প্রকার মিছিল মিটিং নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় ঢাকার ছাত্র সমাজ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। এমন একটা পরিস্থিতিতে অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতেই নবাবপুরস্থ আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বৈঠক আহ্বান করা হয়। সেদিনের সেই বৈঠকে শীর্ষস্থানীয় অধিকাংশ নেতাই ছিলেন অনুপস্থিত। শেখ মুজিবুর রহমান জেলে, মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলে, অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন অবস্থায়। বৈঠকে ‘১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না’ প্রশ্নে ভোটাভোটি হলে ১৪- ৪ ভোটে প্রস্তাবটি পাশ হয়।
সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের এমন নমনীয় সিদ্ধান্ত ছাত্র সমাজ মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে অবিচল থাকে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, তৎকালীন সরকার বিরোধী দলগুলো খুব সতর্কতার সাথে ভাষা আন্দোলন পরিচালনা করছিল যাতে কোন কারণেই সরকারের সাথে সংঘর্ষের সৃষ্টি না হয়। কারণ এই অজুহাতে সরকার পূর্ব বাংলার আসন্ন সাধারণ নির্বাচন পিছিয়ে দিতে পারে। মূলত এ করণেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে।
কিন্তু বাংলার ছাত্রসমাজ বিরোধী দলগুলোর এই যুক্তি মেনে নিতে রাজী ছিল না। কারণ সে সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রশ্নটি ছিল ছাত্রদের জীবন মরণের প্রশ্ন। তাই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে সেই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ে ১১ জন ছাত্রনেতা এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন এবং যে কোন প্রকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য যে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তটি সেই রাতে ১১ জন ছাত্রনেতা গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা হলেন:
১. গাজীউল হক (বিশিষ্ট আইনজীবী)
২. হাবিবুর রহমান শেলী (বিচারপতি)
৩. মোহাম্মদ সুলতান (মরহুম বামপন্থী নেতা)
৪. এম আর আখতার মুকুল (লেখক)
৫. জিল্লুর রহমান (আওয়ামী লীগ নেতা)
৬. আব্দুল মোমিন (আওয়ামী লীগ নেতা)
৭. এস. এ. বারী এটি (মরহুম বিএনপি নেতা)
৮. সৈয়দ কামরুদ্দীন হোসেইন শহুদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)
৯. আনোয়ারুল হক খান (মুজিবনগর সরকারের তথ্য সচিব)
১০. মঞ্জুর হোসেন (মরহুম ডাক্তার)
১১. আনোয়ার হোসেন (পরিচয় অজ্ঞাত)।
১৪৪ ধারা ভঙ্গঃ
রাতের সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের পর ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্ররা জমায়েত হতে শুরু করে। বেলা ১১টার (মতান্তরে ১১.৩০) দিকে আমতলায় (মতান্তরে বেলতলায়) সভা শুরু হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে বিপক্ষে বক্তব্য রাখেন শামসুল হক, আব্দুল মতিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান আমানুল্লাহ খান প্রমুখ। বক্তৃতা শেষে গাজীউল হক ২০ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তিনি বলেন :
নূরুল আমীন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পুলিশ মোতায়েন করেছে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হলে নাকি গুলি করা হবে। ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করা হবে। আমরা নূরুল আমিন সরকারের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। ১৪৪ ধারা আমরা ভাঙ্গবোই। আমরা দেখতে চাই নূরুল আমীন সরকারের বারুদাগারে কত বুলেট জামা আছে।”
এরপর তিনি আব্দুস সামাদ আজাদের (মতান্তরে আবদুল মতিন, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ) পরিকল্পনা মাফিক দশজন দশজন (মতান্তরে পাঁচ জন/ছয় জন আটজন) করে ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গেটে প্রায় ১৫/২০ হাজার ছাত্র-ছাত্রী একত্রিত হয় এবং ১১.৩০ ১২.০০ নাগাদ দশজন দশজন করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমে আসে। এরপর মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে আগ্রসর হতে থাকে।
গুলি বর্ষণ করে ছাত্র হত্যাঃ
তারপর মেডিকেল কলেজ পার হলে কলেজ হোস্টেলের দিকে এগুতে শুরু করলে পুলিশ মিছিলে লাঠি চার্জ শুরু করে। পুলিশের সাথে শুরু হয় ছাত্র জনতার খণ্ডযুদ্ধ। এরপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছাড়লে ছাত্ররা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ে। এরপর ছাত্র-জনতা পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ‘লাঠি চার্জ কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে থাকলে ছাত্র-জনতাও ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। এভাবে পুলিশ ছাত্র-জনতা খণ্ডযুদ্ধ বিকেল পর্যন্ত চলে। এরপর বিকেল ৩.১০ (মতান্তরে ৩টা) মিনিটে পুলিশ প্রথম গুলিবর্ষণ করে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত।” বরকতের তলপেটে গুলি লাগে। প্রচুর রক্তক্ষরণের পর বরকত হাসপাতালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এরপর গুলিবিদ্ধ হন রফিকউদ্দিন। রফিকের মৃত্যু আরও মর্মান্তিক। পুলিশ সরাসরি রফিকের মাথায় গুলী করে। এতে করে মাথার সমস্ত মগজ রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে। তারপর গুলিবিদ্ধ হন জব্বার। তার তলপেটে (মতান্তরে হাটুতে) গুলি লাগে এবং সাথে সাথেই মৃত্যু ঘটে। ২১ ফেব্রুয়ারিতেই পুলিশের গুলিতে শহীদ হন চার জন।” এদের তিন জন হলেন বরকত, রফিক ও জব্বার। অপর জনের নাম জানা যায়নি। কারণ সেই লাশটি পুলিশ গুম করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঢাকার ছাত্র-জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং রাস্তায় রাস্তায়, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, কসাই মুসলিম লীগ সরকার ধ্বংস হউক’ শ্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। শুধু ছাত্র জনতাই নয় সচিবালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাও অফিস ত্যাগ করে রাস্তায় নেমে আসে।
পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে বিতর্ক ও বাংলা ভাষার স্বীকৃতিঃ
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা শহর যখন রণক্ষেত্র তখন বঙ্গীয় আইন পরিষদে অধিবেশন চলছিল। পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার খবর তখন পরিষদে এসে পৌঁছে। ছাত্র হত্যার এই সংবাদ মনোরঞ্জন ধর ও গোবিন্দ লাল ব্যানার্জি পরিষদে নিয়ে এসেছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ৩-৩০ মিটিটে পরিষদের অধিবেশন শুরু হলে বিরোধী দলীয় সদস্যরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং ছাত্র হত্যার জবাব দাবি করেন। সরকার দলীয় সদস্য মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ছাত্রহত্যার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং পরিষদ মূলতবী ঘোষণার দাবি জানান। তিনি পরিষদে দাঁড়িয়ে বলেন :
জনাব স্পীকার, প্রশ্নোত্তরের পূর্বে আমি আপনার কাছে একটি নিবেদন করতে চাই। যখন দেশের ছাত্ররা যারা আমাদের ভাবী আশা-ভরসার স্থল, পুলিশের গুলীর আঘাতে জীবনলীলা সাঙ্গ করেছে, সেই সময় আমরা এখানে বসে সভা করতে চাই না। প্রথমে তদন্ত তারপর হাউস চলবে।
তিনি আরও বলেন,
…যখন আমাদের বক্ষের মানিক, রাষ্ট্রের ভাবী নেতা, ছয়জন ছাত্র রক্তসজ্জায় শায়িত, তখন আমরা পাখার নিচে বসে হাওয়া খাব, এ আমি বরদাস্ত করতে পারি না। আমি জালেমের এই জুলুমের প্রতিবাদে পরিষদগৃহ ত্যাগ করছি এবং মানবতার দোহাই দিয়ে আপনার মধ্যস্থতায় সকল মেম্বারের কাছে পষিদগৃহ ত্যাগের আবেদন জানাচ্ছি।
এরপর তিনি পরিষদ কক্ষ ত্যাগ (ওয়াক আউট) করেন। তাকে সমর্থন করে যেসব সদস্য পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেন তাদের মধ্যে ছিলেন খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মনোরঞ্জন ধর, গোবিন্দ বল্লব ব্যানার্জী, ওসমান আলী প্রমুখ।
২২ ফেব্রুয়ারির জানাযায় এম আর আখতার মুকুল, আওয়ামী মুসলিম লীগের তৎকালীন সভাপতি মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশসহ বেশ ক’জন এম, এল, এ. এবং একদল অধ্যাপক ও ডাক্তার যোগদান করেন। গায়েবানা জানাযার পরপরই কয়েকটি বাশের মাথায় ভাষা শহীদদের রক্তাক্ত জামা কাপড় বেঁধে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শুরু হয় জঙ্গী মিছিল। মিছিলটি কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে শহরের বিভিন্ন দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘খুনি নূরুল আমীনের কল্লা চাই’, “জালেম সরকারের পদত্যাগ চাই’, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’-সম্বলিত স্লোগানে ঢাকা শহর মুখরিত হয়ে ওঠে। ছাত্র-জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে সরকার সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজ ও সংবাদ অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়। টহলরত পুলিশ ও পাকিস্তানী সৈন্যরা আবারও মিছিলের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও গুলীবর্ষণ করে। এতে শহীদ হন সফিউর রহমান, আব্দুল আউয়াল, আব্দুস সালাম, ওলিউল্লাহ (মতান্তরে ওহিউল্লাহ) প্রমুখ
পুলিশের গুলিতে আবারও ছাত্র-জনতা হত্যার সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে ঢাকার বিশ্ষুদ্ধ জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং প্রাদেশিক আইন পরিষদ ভবন ঘিরে ফেলে। সে সময় (বিকেল ৩টা) পরিষদের অধিবেশন চলছিল। বিরোধী দলীয় সদস্যরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব পেশ করেন। সরকার দলীয় বেশ কিছু সদস্য তা সমর্থন করেন। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই নুরুল আমীন সরকার বাংলাকে প্রদেশের সরকারী ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করে।
শহীদ মিনার নির্মাণঃ
রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, সফিউর প্রমুখের রক্তের বিনিময়ে বাংলার জনগণ পেল মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি। তাই এই বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ২২ ফেব্রুয়ারি রাতেই মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা গুলীবর্ষণের জায়গায় শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সেই রাতেই মাদারীপুরের তৎকালীন মেডিকেল ছাত্র গোলাম মওলা (সহ-সভাপতি, মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ), নওগাঁর মঞ্জুর হোসেনের নেতৃত্বে নির্মিত হয় শহীদ মিনার। সকাল হতে হতেই শহীদ মিনার নির্মাণের খবর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে শিশু কিশোর যুবক বৃদ্ধ সবাই এসে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শুরু করে। ফলে মেডিকেল কলেজ চতুবর পরিণত হয় এক পূণ্যভূমিতে।
অবশ্য এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ২১ ফেব্রুয়ারি রাতেই রাজশাহীতে ছাত্র হত্যার খবর পৌছানো মাত্র ছাত্ররা এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ২১ তারিখ রাতেই রাজশাহী কলেজের নিউ মুসলিম হোস্টেলের অভ্যন্তরে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে।” অনেকে মনে করেন এটিই ছিল বাংলাদেশে প্রথম শহীদ মিনার। যদিও ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে পুলিশ বাহিনী শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলে এবং শহীদ মিনারের ইটগুলো গাড়িতে করে নিয়ে যায়।
পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে বাংলা ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব গৃহীত হবার পরও নুরুল আমীন ভাষা আন্দোলনকারীদের সমালোচনা ও কটুক্তি করে বক্তৃতা বিবৃতি অব্যাহত রাখেন এবং সারা প্রদেশব্যাপী পুলিশী নির্যাতন ও ধরপাকভের নির্দেশ দেন। এতে করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, খেলাফতে রানী পার্টির আবুল হাশিম, বঙ্গীয় পরিষদ সদস্য মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, মনোরঞ্জন ধর, সত্যেন সেন, গোবিন্দ লাল ব্যানার্জী, এম ওসমান আলী, মোহাম্মদ তোয়াহা, খালেক নেওয়াজ খান প্রমুখ প্রেফতার হন। এছাড়া শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা গ্রেফতার হন তাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক মোজাফর আহমাদ চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত গুহ, অধ্যাপক সুনীল দে, অধ্যাপক পুলিন দে প্রমুখ।
ভাষা আন্দোলনের জন্য বিভিন্ন সময়ে ময়মনসিংহে যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন রফিক উদ্দিন ভুইয়া, হাতেম আলী তালুকদার; রংপুরের মতিয়র রহমান প্রমুখ এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে মুস্তাফা মনোয়ার, শামসুজ্জোহা, নুরুল ইসলাম মল্লিক, শফি হোসেন খান, মোমতাজ বেগম, লুর রহমান, জানে আলম, এম.এইচ. জামিল, ৮ বছরের বালক মোসলেহ দন, বাদশা মিঞা, নাজির হোসেন, সুলতান মোহাম্মদ, মশিয়র রহমান, লুৎফর রহমান, আজগর আলী, জালাল উদ্দিন, নাছির উল্লা, আব্দুল মোতালিব, রুহুল আমীন, জালাল আহম্মেদ, দুলু আফেন্দী, হাদিস মোল্লা, সুবিমল গুহ, আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ।
১৯৫২-৫৩ সাল এবং পরবর্তীকালে রাজশাহীতে যারা ভাষার জন্য নির্যাতিত হন এবং জেল খাটেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন গোলাম আরিফ টিপু, শামসুদ্দিন আহমদ, আফসার আলী, আনসার আলী, ডা, এস.এম.এ. গাফফার ডা, মেসবাহুল হক বাচ্চু, মমতাজ উদ্দিন আহমদ, মোঃ ওয়াজেদ আলী, মহিউদ্দিন আহমদ, ওবায়দুল হক দুলু, গাজীমুদ্দিন, আবদুর রহমান, আবদুল মান্নান, আবু সাঈদ, আবদুর রহিম, সিরাজুল ইসলাম চাঁদ প্রমুখ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিবঃ
আমরা আগেই দেখেছি যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই একজন তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে শেখ মুজিব সরকার বিরোধী আন্দোলনে অবতীর্ণ হন। গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রভৃতি গঠনের মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। এজন্য তিনি মুসলিম লীগ সরকারের রোধানলে পড়েন এবং বার বার কারারুদ্ধ হন। সর্বশেষ জননিরাপত্তা আইনে তিনি ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি গ্রেফতার হন। এরপর দুই বছরের বেশি সময় তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকেন। বেশ কয়েক মাস ধরে তখন তিনি হৃদরোগে ভুগছিলেন। অসুস্থতার কারণে ১৯৫২ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহমাদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও মুজিব চুপ করে বসে থাকেননি, ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রতি নিয়তই খোঁজ খবর নিতেন। আলি আহাদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সাথে তিনি ভাষা আন্দোলন নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা করেন এবং সে সম্পর্কে তাদের দিক নির্দেশনাও দেন। সে সময় তিনি তাদের আরও জানান যে, ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে আমরণ অনশন শুরু করবেন। এই অনশনের কথা জানতে পেরে সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা নিরাপদ মনে না করে ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাক কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুর জেলা কারাগারে স্থানান্ত রিত করে। ফরিদপুর যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে পুলিশের বাধা অতিক্রম করে সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে তিনি এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি বলেন “একুশে ফেব্রুয়ারি এসেম্বলি বসবে, এম.এল.এ দের কাছ থেকে রাষ্ট্রভাষার বাংলার পক্ষে দস্তখত আদায় করবে।
শেখ মুজিবের স্টিমার ঘাটে সেদিনের সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা ভাষা আন্দোলনে নতুন মাত্র যোগ করে। এরপর ফরিদপুর জেলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি সকল রাজবন্দীদের মুক্তিসহ ভাষার দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন। বরিশালের মহিউদ্দিন আহম্মদও মুজিবের সাথে অনশন শুরু করেন। দীর্ঘ কারাবাস ও অনশনের কারণে এ সময় শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহম্মেদের স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি ঘটে। ১৭ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয় ।
বিগত ১৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহম্মদকে ঢাকা জেল হইতে অপসারণ করা হইয়াছে বলিয়া খবর রটিয়াছে । আরো প্রকাশ তারা উভয়েই নাকি ১৬ ফেব্রুয়ারি হইতে অনশন শুরু করিয়াছেন। শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিনের স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই খারাপ, তারা অতিমাত্রায় দুর্বল হইয়া পড়িয়াছেন। মহিউদ্দিনের নাক হইতে নাকি রক্ত ঝরিতেছে।”
মওলানা ভাসানীসহ বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী, ছাত্রনেতা, যুবনেতা শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীগণ এই দুই নেতার দীর্ঘ কারাবাস ও ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং শেখ মুজিব, মহিউদ্দিনসহ সকল কারাবন্দীর আশু মুক্তি দাবি করেন। মওলানা ভাসানী এসময় মানবিক কারণে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিনের মুক্তির আবেদন জানিয়ে একটি পথক বিবৃতিও দেন। এছাড়াও ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিনের প্রতি অনশন ভঙ্গ করার আবেদন জানিয়ে এক তারবার্তা প্রেরণ করেন। উক্ত বার্তায় তিনি বলেন যে, বর্তমান অবস্থায় তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন রয়েছে। এভাবে সারা প্রদেশ ব্যাপী শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন জোরদার হতে থাকলে সরকার শেষ পর্যন্ত জনদাবির কাছে মাথা নত করে এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়। জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে সাথে সাথেই মুজিব ঢাকার আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে এক তার বার্তায় ২১ ফেব্রুয়ারির মর্মান্তিক ঘটনার জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। দীর্ঘ কারাবাস, রোগভোগের কারণে সেসময় তাকে গ্রামের বাড়ি টুঙ্গি পাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় এক মাস চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং ঢাকায় ফিরে এসে অসমাপ্ত ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন।
সূত্রঃ ভাষা আন্দোলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা, ড. অজিত কুমার দাস


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ