1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

আতশবাজি বিক্রি হয় গোপনে : মূল ক্ষেত্র শাঁখারিবাজার

বিশেষ প্রতিবেদক : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২২

পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার এলাকার কয়েকটি গলির মাথায় ও দোকানের কোণে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন তরুণ ও কিশোর। যাদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৫ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। আতশবাজির বড় বাজার হিসেবে পরিচিত হলেও শাঁখারিবাজারের দোকানগুলোতে সচরাচর আগের মতো আতশবাজি পাওয়া যায় না। কিন্তু কেউ কিনতে এসে খোঁজাখুঁজি করলে কোনো না কোনোভাবে টের পেয়ে যায় গলি ও দোকানের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো। তখনই চার-পাঁচজন এসে হাজির। গলির ভেতর ডেকে নিয়ে চলে দরদাম। এভাবেই প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে আতশবাজির বিকিকিনি।

বিদায়ী বছরের শেষ দিন ও নতুন বছরের আগমনকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর আতশবাজিসহ উৎসব-আয়োজনে রাতটি উদযাপন নতুন কিছু নয়। তবে উদযাপন যে কখনো কখনো কাল হয়ে দাঁড়ায় তার বড় উদাহরণ এবারের ‘থার্টি-ফার্স্ট নাইট’।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আতশবাজির বিকট শব্দের ভয়ে মৃত্যু হয়েছে সাড়ে চার মাস বয়সী শিশুর। ফানুস ওড়াতে গিয়ে রাজধানীতেই ঘটেছে অন্তত ১০টি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। উড়ে যাওয়া ফানুস বৈদ্যুতিক তারের ওপর পড়ে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ারও খবর পাওয়া গেছে। জরুরি সেবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে সারাদেশ থেকে থার্টি ফার্স্ট নাইটে ফানুস থেকে ঘটা ২০০টি অগ্নিকাণ্ডের খবর এসেছে ফায়ার সার্ভিসে। যে কারণে দেশে ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ করার জন্য ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দাবিও তোলা হয়েছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আতশবাজি ও ফানুস নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আতশবাজি নিষিদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে ফানুসও নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয় বিভিন্ন মহল থেকে।

যদিও রাজধানীতে ‘থার্টি-ফার্স্ট নাইট’ উদযাপনে ছিল বেশকিছু নিষেধাজ্ঞা। পটকা আতশবাজি যেন না ফোটানো হয়, সে ব্যাপারেও বারবার সাবধান করেছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। তবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বাড়ির ছাদে অবাধে আতশবাজি ফোটানো নিয়ে এক ধরনের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম।

সেই রাতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘আতশবাজি থামানোর বিষয় নয়। হাত দিয়ে আটকে রাখা যায় না। আতশবাজি না ফোটাতে আমি অনুরোধ করেছি, দয়া করে ফোটাবেন না। আতশবাজি ফোটায় একেবারে টিনেজ ছেলে-মেয়েরা। বাড়িতে গিয়ে দেখেন, আপনার ছোট ভাই দুটি আতশবাজি কিনে ফোটাচ্ছে। এত বিধিনিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করাটাও কঠিন। আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে নিষেধ করতে পারবো না। নগরবাসীকে অনুরোধ করেছিলাম, বয়স্ক মানুষ ও অসুস্থ মানুষের কথা ভেবে এটা সীমিত রাখবেন। আমি আশা করবো, যারা এই আতশবাজি ফোটাচ্ছেন, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।’

মানুষ যদি স্বেচ্ছায় নিজে থেকে সাবধান ও সচেতন না হয়, তবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়- ডিএমপি কমিশনারের এমন অসহায়ত্বের উদাহরণ রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা মুরাদ হোসাইন। তিনি বলছিলেন, ‘আমি নিজেই তো ২০টা ফানুস কিনেছি। পরিবার নিয়ে উড়িয়েছি।’

থার্টি-ফার্স্ট নাইটে ফানুস কিনতে গিয়ে আতশবাজির দোকানের ভিড়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যার পর থেকে মার্কেটে মানুষের ভিড় লেগে ছিল। অমুক দোকানে আতশবাজি বিক্রি হয়, এটা খবর পাওয়া মাত্রই মানুষ সেখানে গিয়ে ভিড় জমায়। একপর্যায়ে দোকানদার না দিতে পেরে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। মানুষ এতটাই আতশবাজি ও ফানুস কেনার জন্য আগ্রহী হয়েছিল।’

থার্টি-ফার্স্ট নাইটে ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ ছিল কি না জানতে চাইলে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপ-কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘ফানুস বন্ধ করার কোনো আইন নেই। এ ব্যাপারে নগরবাসীকেই সচেতন হতে হবে। আমরা নির্দেশনা দিয়েছিলাম, যদি নগরবাসী না মানে, তাহলে তো আর মামলা দিয়ে ধরে আনা সম্ভব নয়। আগামী বছর যেন এমন না ঘটে, এজন্য এর উৎসটাকেই আমরা বন্ধ করার ব্যবস্থা নেবো।’

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা ফানুস বিক্রি করছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে আমরা বিক্রি ও আমদানি যাই হোক না কেন বন্ধ করার ব্যবস্থা করবো। আগামী বছর বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে আমরা প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাবধান করে দিয়ে আসবো যে, আপনার বাসা থেকে যদি ফানুস ওড়ান তবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরকম কিছু পদক্ষেপ আমরা আগামী থার্টি-ফার্স্ট নাইটে নিতে পারি।’

বাংলাদেশে ঢালাওভাবে ফানুস ওড়ানোর বিষয়টা নতুন হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেশকিছু বিষয়। বৌদ্ধ ধর্মের উৎসব— প্রবারণা পূর্ণিমা কিংবা পুরান ঢাকার সাকরাইন উৎসবেও ফানুস ওড়ানো হয়।

বিষয়টি কীভাবে সমন্বয় করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় রীতিতে যারা ফানুস ওড়াচ্ছেন, তাদের ব্যাপার আলাদা। তাদের দিন আর থার্টি-ফার্স্ট নাইট তো একই দিনে নয়। তাদের ধর্মীয় দিনে তারা ওড়াবেন, তখন তো আর সারাদেশ ওড়াবে না। কিন্তু থার্টি-ফার্স্টে তো নগরবাসী লাখ লাখ ফানুস একসঙ্গে ওড়াচ্ছে। ঘনবসতির শহর হিসেবে ঢালাওভাবে ওড়ালে একটা ঝুঁকি তো আছেই। এছাড়া সাকরাইনে খুবই কম সংখ্যক ফানুস উড়বে। তারা এটা নতুন ওড়াচ্ছেন না। প্রতি বছরই তারা এটা করেন এবং তাদের চর্চা হয়ে গেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যখন নতুন ওড়াতে যান, তখন ঝামেলা হয়।’

এখন পর্যন্ত সাকরাইন উৎসব কিংবা প্রবারণা পূর্ণিমায় ফানুস ওড়ানোর জন্য আগুন লেগেছে এমন তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আসেনি বলে জানান তিনি।

উৎসব পালনে সব ধরনের সরঞ্জামের জন্য খুচরা ও পাইকারি বাজার হিসেবে বিখ্যাত পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার ও চকবাজার।

সম্প্রতি শাঁখারিবাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাকরাইন উৎসব সামনে রেখে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। বহুল পুরোনো শাঁখারিবাজারের গলিতে শতাধিক দোকানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের উৎসবের সরঞ্জাম। রঙ-বেরঙের কাগজ দিয়ে তৈরি ঘুড়ি সাজিয়ে রেখেছেন তারা। তবে ফানুস আছে কি না জানতে চাইলে প্রথমে স্বীকার করতে চান না তারা।

বেশ কয়েকটি দোকানে ফানুস আছে কি না জানতে চাইলে ‘সামনে দেখেন’ বলে এড়িয়ে যান তারা। এর মধ্যে এক দোকানদার বলেন, ‘কয়েক দিন পরে আইসেন।’ অনিল নামের এক দোকানদার প্রথমে রাজি না হলেও ‘অনেক পিস নেবো’ বলার পর তিনি বলেন, ‘দাম একটু বেশি পড়বে।’ ফানুসের দেখা মিললেও তবে কোনো দোকানেই জিজ্ঞেস করে আতশবাজি পাওয়া যায়নি।

ক্রেতাবেশে বিজয় স্টোর নামে এক দোকানে গিয়ে আতশবাজি আছে কি না জানতে চাইলে দোকানদার বলেন, ‘বাজি কখনো দোকানে আইসা চাইলে পাইবেন না।’তাহলে কীভাবে পাবো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সামনে হাঁটতে থাকেন, দোকানের আশপাশে গলির মাথায় পোলাপাইন দেখবেন। ওদের কাছে চাইলেই পাইবেন’। পরে ফানুস আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৫০ টাকা করে দাম পড়বো।’

ওই দোকানদারের সঙ্গে কথা বলা শেষ না হতেই ১৬-১৭ বছর বয়সের এক বালক এসে জানতে চাইলো, ‘ভাই কী লাগবো।’

‘তাকে বলা যাবে না’ জানালে ওই বালকের মন্তব্য, ‘আপনি কী খুঁজছেন, তা জেনেই আমি আসছি।’ পরে ‘সাইডে আহেন’ বলে ‘পন্নি গলি’ নামের একটি গলির ভেতরে ডেকে নিয়ে যায়। চার-পাঁচটি দোকানের ভেতরে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আতশবাজির দরদাম করতে থাকে সে। ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত দামের বাজি তার কাছে আছে বলে জানায়।

‘রাস্তায় যদি পুলিশে ধরে’ প্রশ্ন করলে তার উত্তর ‘এমনভাবে প্যাকেট কইরা দিমু যে, বাংলাদেশের যে কোনো জায়গায় নিতে পারবেন।’

দোকানে কেন বিক্রি হয় না প্রশ্ন করলে সে জানায়, ‘ডিবি আইসা জব্দ করে।’ ফানুস আছে কি না জানতে চাইলে তার উত্তর, ‘আগুন ধরার পর ফানুসও নিষিদ্ধ।’ তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঠিক এমন সময় আশপাশ থেকে আরও তিন-চারজন একই বয়সী বালক হাজির। ওই গলির সঙ্গে সংযোগ থাকা আরও কয়েকটি গলির মাথায় ও মার্কেট-দোকানের কোণায় দাঁড়িয়ে আছে এমন আরও বেশ কয়েকজন তরুণ ও কিশোর।

বিষয়টি নজরে আনলে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপ-কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘গোপনে কিছু বিক্রি হতে পারে। কিন্তু যখনই প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে, আমাদের কাছে এমন অভিযোগ আসছে, আমরা তখনই অভিযান চালিয়েছি। বিভিন্ন ডিভিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে তখনই এটাকে কঠোর নজরদারির মধ্যে নিয়ে এসেছেন। যাদের অনুমোদন নেই, তারা হয়তো গোপনে কিছু বিক্রি করছেন। তবে মাঠে আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে।’

ফানুস বন্ধ না করা গেলেও বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ফানুস ওড়ানোর বিষয়টা নতুন। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন ফানুসের প্রচলনটা তেমন ছিল না। আমার কাছে মনে হচ্ছে, স্যাটেলাইট ও গ্লোবালাইজেশনের কারণে অনেক পুরোনো সংস্কৃতি নবরূপে এসেছে। ফানুস তার মধ্যে একটি। যখন এটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে, এটার কারণে প্রাণের ক্ষতি হচ্ছে, তখন অবশ্যই এটাকে একটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা উচিত। কিন্তু আসলে এটা কতটুকু সম্ভব সেটাই বড় প্রশ্ন।’

কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব ফানুসেই তো আর আগুন ধরে না। যেসব ফানুস ত্রুটিযুক্ত, ঠিকমতো ওড়ে না, সেগুলো থেকেই আগুনের ঘটনা ঘটে। তাই এসব যেখানে তৈরি হয় ও বিক্রি হয়, সেখানে মনিটরিং করা উচিত। পাড়া-মহল্লায় কিশোর-কিশোরীরা যেভাবে এটা ব্যবহার করছে, এটা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণের বিষয় রয়েছে। এজন্য আমাদের সচেতনতা তৈরি করা দরকার। এজন্য প্রয়োজন কলকারখানাগুলোতে যেন নজরদারি করা হয় এবং যারা এটা ওড়াচ্ছে, সেই জায়গাগুলোতে নজরদারি করা উচিত।’


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ