বছর ছয়েক আগে ইউটিউবে একটি গানের ভিডিও প্রকাশিত হয়। ‘ভাঙা তরী ছেঁড়া পাল’ শিরোনামের ভিডিওটিতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য বাউল বেশধারী এক ব্যক্তিকে দেখানো হয়। র্যাব বলছে, বাউল বেশধারী ওই ব্যক্তি আসলে দুর্ধর্ষ এক খুনি। যে অন্তত তিনটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
কিন্তু এত পুরোনো একটি ভিডিও হঠাৎ কীভাবে এলো র্যাবের নজরে? র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলছেন, মাস ছয়েক আগে এক ব্যক্তি র্যাবকে জানায়, বগুড়ায় ২০০১ সালে চাঞ্চল্যকর বিদ্যুৎ হত্যাকাণ্ডের আসামি হেলাল হোসেনের চেহারার সঙ্গে ওই বাউল মডেলের চেহারার মিল রয়েছে।
এ সন্দেহের ভিত্তিতে বিষয়টি নিয়ে খোঁজ-খবর শুরু করে র্যাব। বিদ্যুৎ হত্যা মামলার এজাহার থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ নিয়ে তারা জানতে পারে, এই মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হেলাল হোসেন।
অন্তত তিনটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হেলাল হোসেন
তদন্তে নেমে র্যাব জানতে পারে, গানটির শুটিং হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের রেল স্টেশনে। সেখান থেকে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে র্যাব-৩ এর একটি দল গতকাল (বুধবার) রাতে ভৈরব স্টেশন থেকে মিউজিক ভিডিওতে বাউলের মডেল হওয়া ওই ব্যক্তি অর্থাৎ হেলাল হোসেনকে গ্রেফতার করে।
হেলাল হোসেন বাউল সেলিম, সেলিম ফকির, খুনি হেলাল ও হাত লুলা হেলালসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত।
আজ (বৃহস্পতিবার) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, হেলাল হোসেন আমাদের বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পারি, বগুড়ায় ২০০১ সালের বিদ্যুৎ হত্যাকাণ্ডের চার আসামির মধ্যে সে একজন। ওই হত্যাকাণ্ডের মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়। বগুড়ায় ১৯৯৭ সালে সংঘটিত আরও একটি হত্যা মামলারও আসামি সে। একইসঙ্গে ২০০৬ সালে রবিউল হত্যা মামলার আসামিও সে। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের একটি মামলা এবং চুরির একটি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বুধবার রাতে ভৈরব স্টেশন থেকে গ্রেফতার করা হয় হেলাল হোসেনকে।
র্যাব বলছে, হত্যা মামলায় সাজা হওয়ার পর এলাকা ছেড়ে আত্মগোপন করে এবং বাউলের বেশ বেছে নেয় হেলাল। এভাবে দেশের বিভিন্ন রেল স্টেশনে গত সাত বছর আত্মগোপনে ছিল সে। বাউলের বেশ ধরে গান গেয়ে জীবিকাও নির্বাহ করে হেলাল।
র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার মঈন বলেন, ১৯৯৭ সালে ২১ বছর বয়সে ‘বিশু’হত্যাকাণ্ডে’র মধ্যে দিয়ে অপরাধ জগতে পা রাখে হেলাল হোসেন। পরে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মারামারিতে যোগ দেয় সে। এর ফলে সে এলাকায় দুর্ধর্ষ হেলাল নামে পরিচিতি পায়। ২০০০ সালে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় তার বাম হাত প্যারালাইজড হয়ে যায়। এর ফলে তার নাম হয়ে যায় ‘হাত লুলা হেলাল’।
তিনি আরও বলেন, ২০১০ সালে একটি চুরির মামলায় সে জেলে যায়। ২০১১ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। চুরির মামলায় জামিনে বের হওয়ার পর বিদ্যুৎ হত্যা মামলার রায়ে আদালত তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়। এই রায়ের পর সে পালিয়ে যায় এবং ফেরারি জীবন শুরু করে। মূলত ২০১৫ সাল থেকে তার এই ফেরারি জীবন শুরু হয়।
ফেরারি জীবনে প্রথমে হেলাল বগুড়া থেকে ট্রেনে ঢাকায় আসে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে পৌঁছে শাহ-আমানত মাজারে কিছুদিন ছিল। এরপর সেখান থেকে যায় সিলেটের হজরত শাহজালালের মাজারে। সেখানে বেশ কিছুদিন ছিল। তারপর বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে ফেরারি জীবন শুরু হয় তার। শাহজালালের মাজার থেকে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ স্টেশনে যায়। বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে ঘুরে ঘুরে বাউল গান গাইত সে। এভাবে গান গেয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত হেলাল।
যেভাবে মিউজিক ভিডিওতে হেলাল
নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে ‘ভাঙা তরী ছেঁড়া পাল’ গানটির শুটিং চলার সময় পরিচালক তার সহকর্মী ও স্থানীয়দের বলেন, ‘একজন বাউল মডেল প্রয়োজন।’ তখন স্থানীয়রা পরিচালককে হেলালের কথা বলেন। সে তখন নারায়ণগঞ্জ রেল স্টেশনে ‘সেলিম ফকির’ নামে পরিচিত ছিল। এরপর তাকে খুঁজে এনে ওই মিউজিক ভিডিওতে মডেল হিসেবে নেওয়া হয়।
এরপর নারায়ণগঞ্জ থেকে ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনে চলে যায় হেলাল হোসেন। সেখানে প্রায় চার বছর অবস্থান করে সে। সেখানে বিয়েও করে হেলাল হেসেন।অষ্টম শ্রেণি পাস হেলাল এক সময় এলাকায় মুদির দোকানের ব্যবসা করত।