1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

হাওয়া ভবন সিন্ডিকেট : শতাধিক সদস্যের কে কোথায়?

বিশেষ প্রতিবেদক : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২২

বিএনপি-জামাত জোট সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিতি পায় বনানীর ‘হাওয়া ভবন’। তারেক রহমানের নেতৃত্বে ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের জয়ী হওয়ার পেছনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে এই ভবন। সে সময় ভবনটির মূল আকর্ষণ ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন মাফিয়া সিন্ডিকেট।

নির্বাচনের সময় তার সহযোগী ছিলেন ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে মাহী বি চৌধুরী ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুন। নির্বাচনে জিতে সরকার গঠনের পর বি চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদে বসায় বিএনপি। এরপর মতবিরোধের জেরে অপমান করে বি চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণ করা হয়। এরপর থেকে এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও সহচর মাহী বি চৌধুরীর সঙ্গে ক্রমেই তারেকের দূরত্ব বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে তাদের সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।

ওই সময় থেকে লাইম লাইটে চলে আসেন- প্রয়াত হারিছ চৌধুরী, রশিদুজ্জামান মিল্লাত এমপি, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, রকিবুল ইসলাম বকুল, গোল্ডেন মনির, সিলভার সেলিম, লুৎফর রহমান বাদল, আশিক ইসলাম, মিয়া নূর উদ্দিন অপু, সাজ্জাদুল ইসলাম জয়, আতিকুর রহমান রুমন, বেলায়েত হোসেন, কাজী কামাল এমপি, শাহরিন ইসলাম তুহিন, সাইফুল ইসলাম ডিউক, ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবাল, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, সাজ্জাদ হোসেন নাইট, লুৎফুজ্জামান বাবর, জহিরউদ্দিন স্বপন, ইলিয়াছ আলী এমপি, মফিকুল হাসান তৃপ্তি, এমরান সালেহ প্রিন্স, আসাদুল হাবিব দুলু, সাতক্ষীরার সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিব, সায়মন আকবর, রাজিব সিরাজ অপু প্রমুখ।

এদের অনেকেই যেমন ছিলেন বিএনপির নেতা, আবার অনেকেই ছিলেন নিরেট হাওয়া ভবনের কর্মচারী। আর কর্মচারী হয়েও তারা মূলত অবৈধ পন্থায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন।

এরা ছাড়াও হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন- যুবদল নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হাবিব-উন-নবী সোহেল, সাহাবুদ্দিন লাল্টু, আজিজুল বারী হেলাল, সাধারণ সম্পাদক শফিউল বারী বাবু, প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মোটকা তারেক ওরফে মালয়েশিয়া তারেক, আনোয়ার, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা গাইবান্ধার হামিদুল হক ছানা ওরফে ওসি হামিদ, রানী, নূর আফরোজ জ্যোতি, গাবতলীর পৌর চেয়ারম্যান মোরশেদ মিল্টন, এনামুল হক, ডা. দেওয়ান সালাউদ্দিন, হেলেন জেরিন খান, নেওয়াজ হালিমা আরলি, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, ফয়সাল মোরশেদ খান, তানভীর ইসলাম, জহিরুল ইসলাম চৌধুরী, তাহমিন আক্তার ডেল, খন্দকার আবু আশরাফ, জোবায়েদ হোসেন রানা, ইমতিয়াজ আহমেদ এবং হুমায়ুন আহমেদ চৌধুরী।

বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে ঘিরে এরা গড়ে তোলে এক শক্তিশালী মাফিয়া সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট তখন নিয়োগ-বদলি-টেন্ডার অর্থনৈতিক লেনদেনসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতো। হেন কোনো কাজ নেই যা ওই বিতর্কিত ভবন থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো না।

মূলত হাওয়া ভবন হয়ে উঠেছিল সরকারের পাশাপাশি আরেক প্যারালাল সরকার। যেখানে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তারেক রহমান আর তার সঙ্গীরা হলেন সেই সরকারের মন্ত্রী-উজির-নাজির-কোতোয়াল।

ক্ষমতার পালাবদলে ২০০৭ সালের ১/১১-তে সেনাসমর্থিত বিশেষ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাওয়া ভবনের এ সিন্ডিকেটের প্রায় সবাই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। আবার অনেকেই বিশেষ অভিযানে আটক হয়ে জেলে যান।

এ সিন্ডিকেটের মূল হোতা সিলেটের কানাইঘাটের হারিছ চৌধুরী গত আগস্টে মারা গেছেন। তার পরিবার মৃত্যুর খবরটি গোপন রাখেন গতকাল পর্যন্ত। পরে গণমাধ্যমকে জানানো হয়। এর আগে শোনা যেত, তিনি লন্ডনে, কখনো ভারতের আসাম অঞ্চলে, কখনো কানাডায় পলাতক জীবন যাপন করছেন। তবে গত তিন মাস আগে একটি খবর জানা যায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হারিছ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেছেন। যদিও সে সময় বিএনপি তা স্বীকার করেনি।

হাওয়া ভবন সিন্ডিকেটের বিতর্কিত ব্যবসায়ী এম এইচ সেলিম ওরফে সিলভার সেলিম প্রথমে পলাতক থাকলেও পরে আবার দেশে ফিরে এসেছেন। তিনি কয়েক বছর আগে বিএনপির রাজনীতি থেকেও সরে আসার ঘোষণা দিয়ে এখন বহাল তবিয়তে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজধানীর গুলশানের অভিজাত এলাকায় তার সিলভার টাওয়ার নামে ২২ তলা বিশিষ্ট বিশাল অট্টালিকা এখনও সাধারণ মানুষকে হাওয়া ভবনের সিন্ডিকেটের কথা মনে করিয়ে দেয়।

সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় বিচারাধীন আসামি হিসেবে ইতোমধ্যেই ফাঁসির অপেক্ষায় কনডেম সেলে দিনযাপন করছেন।

এদিকে, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হাওয়া ভবনের ‘যুবরাজ’ হিসেবে পরিচিত তারেক রহমান ১/১১ এর পর গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর জেলে ছিলেন। পরে আদালতের বদান্যতায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডনে পালিয়ে যান। আর সুবিধাভোগীরা কেউ দেশে, কেউ বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন।

হাওয়া ভবনে তারেক রহমানের সহযোগীরা তারেক রহমানের আশীর্বাদে হাজার কোটি টাকা কামালেও তাদের অনেকেই ছিলেন অযোগ্য ও স্বল্পশিক্ষিত। কারো কারো পরিচিতি ছিল অস্ত্রধারী ক্যাডার হিসেবে।

এদেরই একজন লুৎফুজ্জামান বাবর। শাহজালাল বিমানবন্দরে লাগেজ চোরা কারবারি বাবরের নাম ছিল লাগেজ বাবর। সোনাসহ বিভিন্ন পণ্যের চোরা কারবার করতে করতে পরিচয় হয় বিএনপির বড় নেতাদের সাথে। আর বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করে বাগিয়ে নিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর গদি।

তারেকের সেই সিন্ডিকেটের কাজই ছিল দেশের সব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কমিশন আদায় করা, বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা, বিদেশি বিনিয়োগের ওপর চাঁদার ভাগ বসানো। বিএনপি-জামায়াতের ৫ বছরে এরাই ছিল তারেককের প্রিয়ভাজন, পরামর্শক ও অলিখিত উপদেষ্টা।

হাওয়া ভবনের ব্যক্তিগত স্টাফ ছিলেন হামিদুল হক ছানা ওরফে ওসি হামিদ ও আনোয়ার। এরা দুজনই হাওয়া ভবনের নাম ভাঙিয়ে তদবির করে এখন বিপুল অর্থবিত্তের মালিক। তারেক রহমানের বদান্যতায় তারা সর্বত্র দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। হয়ে উঠেছেন বিপুল ক্ষমতার অধিকারী।

ওসি হামিদ ছিলেন পুলিশ বিভাগে মূর্তিমান আতঙ্ক। এক সময় রাজধানীর একটি থানার ওসি ছিলেন তিনি। পরে দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত হন। পুলিশ বিভাগে নিয়োগ-বদলি ও পদোন্নতিতে তার হাত ছিল অনেক লম্বা।

অভিযোগ রয়েছে, এই বিভাগে তদবির করে ৫ বছরে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি। পরবর্তীতে এই ওসি হামিদকে বিনা কাউন্সিলে সরাসরি গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে চাপিয়ে দেন তারেক রহমান। তাকে জেলা বিএনপির সভাপতি বানানোর জন্য বঞ্চিত করা হয় গাইবান্ধার অনেক ত্যাগী নেতাকে।

অপরদিকে তারেকের ব্যক্তিগত পিয়ন ছিলেন আনোয়ার। সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন তদবির নিয়ে। এই আনোয়ারও শত কোটি টাকার মালিক। ওয়ান-ইলেভেনের পর পালিয়ে মালয়েশিয়া চলে যান। সেখানে তারেকের ভাই কোকোর পাচারকৃত অর্থে গড়া একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে আছেন বলে শোনা যায়।

রুমন এখন লন্ডন-বাংলাদেশ, বেলায়েত মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর কেন্দ্রিক জীবন কাটাচ্ছেন। মিয়া নুরুদ্দীন অপু দীর্ঘ কয়েক বছর মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোমে’ রাজকীয় জীবন কাটিয়ে কয়েক বছর আগে হঠাৎ করে দেশে ফিরে আসেন। তিনি আগে হওয়া ভবন দুর্নীতির মামলায় কিছুদিন জেলে গেলেও দ্রুতই সেখান থেকে বের হয়ে আসেন।

এরপর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাওয়া ভবনের বহুল বিতর্কিত নুরুদ্দীন অপু বিএনপি থেকে শরীয়তপুরে নিজের আসনে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়নও পান। নির্বাচনের কদিন আগে তার মতিঝিলের ব্যবসায়ী কার্যালয় থেকে র‍্যাব নগদ প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা উদ্ধার করে। ভোটে কারচুপি করার জন্য সেই অর্থ বিভিন্ন জায়গা বিতরণের জন্য নেওয়া হচ্ছিল বলে স্বীকার করেন তিনি। বর্তমানে সেই টাকা উদ্ধার মামলায় অর্থাৎ অর্থ পাচার মামলায় অপু জেলে রয়েছেন।

সাবেক এমপিদের মধ্যে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এক সময়ের বিমানের কর্মচারী রশিদুজ্জামান মিল্লাত, রাজশাহীর নাদিম মোস্তফা, সিলেটের নাসের রহমান, মাগুরার আলোচিত কাজী কামাল, নূর আফরোজ জ্যোতি, সিলেটের ইলিয়াছ আলী, বরিশালের জহির উদ্দিন স্বপন, সাতক্ষীরার হাবিবুল ইসলাম হাবিব, মাদারীপুরের হেলেন জেরিন খান, নবাবপুরের ফাহিমা হোসেন জুবলী প্রমুখ।

অভিযোগ রয়েছে, হাওয়া ভবনের দাপটে সবাই প্রচুর অবৈধ অর্থের মালিক বনে যান। ১/১১-তে জহির উদ্দিন স্বপন ভোল পাল্টে সংস্কারবাদীদের দলে যোগ দেন। দীর্ঘ কয়েক বছর দলীয় কর্মকাণ্ডের বাইরে থাকলেও বিগত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে তিনি গৌরনদী-আগৈলঝড়া আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেন।

মন্ত্রীদের মধ্যে হাওয়া ভবনের অন্যতম পরামর্শক ছিলেন যোগাযোগ খাতে বিশেষ করে সিএনজিচালিত অটো রিকশা ও সিএনজি স্টেশন বরাদ্দ নিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, জিয়াউল হক জিয়া, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সালাউদ্দিন আহমেদ, আমান উল্লাহ আমান, এহছানুল হক মিলন, উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আসাদুল হাবিব দুলু ও আবদুস সালাম পিন্টু।

এই মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীরা হাওয়া ভবনের নির্দেশে সব কাজ সম্পাদন করতেন। কয়েকজন মন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলতেন, আমাকে টাকা নিয়ে হাওয়া ভবনে দিয়ে আসতে হয়। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী দুর্নীতির মামলায় সবাই জেলে যান। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বেশ কিছু ভয়াবহ মামলায় লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টু এখনো জেলে।

জিয়াউল হক জিয়া নিষ্ক্রিয় থাকার পর সম্প্রতি মারা গেছেন। বাকিদের অনেকেই আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তরুণ নেতাদের মধ্যে মফিকুল হাসান তৃপ্তি ও এমরান সালেহ প্রিন্স ছিলেন হাওয়া ভবনের অন্যতম নীতি-নির্ধারক। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনে উভয়েই ভোল পাল্টে সংস্কারবাদী হয়ে যান।

অথচ এরা তারেকের সাথে মিলে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। জনশ্রুতি আছে, এদের দেখলে এক সময় কেবিনেট মন্ত্রীরা পর্যন্ত সালাম দিতে বাধ্য হতেন। সচিবালয়ে তারা ঢুকলে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর স্টাফরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। সেই এমরান সালেহ প্রিন্স বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে পাশাপাশি কেন্দ্রীয় দপ্তরের দায়িত্ব পালন করছেন।

ওয়ান-ইলেভেনে তারা অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান। এখন আবার বিএনপির রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন।

পেশাজীবীদের মধ্যে হাওয়া ভবনের সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন কৃষিবিদ জাভেদ ইকবাল ও ড্যাব-বিএমএ নেতা ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। সব কাজে তারেক তথা হাওয়া ভবনকে ব্যবহার করতেন তারা। দুর্নীতিবাজ জাভেদ ইকবাল দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন ওয়ান-ইলেভেনের সময়। পেশাজীবী নেতা ডা. জাহিদ দেশেই থেকে বিএনপির রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। তিনি বর্তমানে দলের ভাইস চেয়ারম্যান পদে আছেন।

এরা ওই সময় স্বাস্থ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ। হাওয়া ভবনের কল্যাণে তারাও শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন।

তারেক রহমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন চরম দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীও। এদের মূল নায়ক ছিলেন বহুল বিতর্কিত ও আলোচিত ভোলার গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ওরফে খাম্বা মামুন।

সিন্ডিকেটের এই অংশে খাম্বা মামুন ছাড়া আরও ছিলেন- বাবুল কাজী, অ্যাডভোকেট আনিছুর রহমান, রাজিব সিরাজ অপু, এনামুল হক মামুন, আবদুল্লাহ আল মামুন, আবেদ হাসান মাহমুদ প্রমুখ। মামুন বর্তমানে জেলে রয়েছেন। বাবুল গাজী, রাজিব সিরাজ অপু ও এনামুল হক মামুন বিদেশে, বাকিরা সবাই দেশে ব্যবসা করছেন।

হাওয়া ভবনে তারেক রহমানের হয়ে অর্থের লেনদেন করতেন তৌহিদুল ইসলাম ওরফে আশিক ইসলাম ওরফে পাপ্পু, রকিবুল ইসলাম ও পিএস মিয়া নূর উদ্দিন অপু। শুধু হাওয়া ভবনের কল্যাণে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন প্রত্যেকেই।

অভিযোগ রয়েছে তারেক রহমানের হয়ে বিদেশে অর্থ পাচারে এই ‘থ্রি স্টার’ বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ওয়ান-ইলেভেনের পর তারা পালিয়ে ভারতে চলে যান। পরে আমেরিকা ও কানাডা, লন্ডন ও মালয়েশিয়া কেউবা দুবাইতে।

বর্তমানে আশিক আমেরিকায় রমরমা ব্যবসা করছেন। রকিবুল ইসলাম বকুল দীর্ঘদিন মালয়েশিয়া থেকে সম্প্রতি দেশে ফিরে এসে খুলনার রাজনীতি নিয়ে মেতে উঠেছেন। মিয়া নূরউদ্দীন অপু কোটি কোটি টাকা অর্থ পাচারের মামলায় কদিন আগে জেলে গেছেন।

পারিবারিক আত্মীয়দের মধ্যে তিন খালাতো ভাই- সাইফুল ইসলাম ডিউক, তাহসিন আক্তার ডেল ও শাহরিন ইসলাম তুহিন হাওয়া ভবনের নামে ক্ষমতার দাপট দেখান। এদের মধ্যে ডিউক ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িয়ে জেলে রয়েছেন। ডেল ও তুহিন বিদেশে পলাতক। শোনা যায়, সম্প্রতি তারা দেশে ফিরে এলেও পলাতক দিনযাপন করছেন।

খাম্বা মামুনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন ছাত্রদল নেতা সাহাবুদ্দিন লাল্টু। তিনি মামুনের বেয়াই। মূলত এ সম্পর্কের কারণেই ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতির পদ পেতে লাল্টুকে সহায়তা করেন মামুন। মামুনের বিভিন্ন ব্যবসায়িক বিষয় দেখাশোনা করেছেন তিনি। কিন্তু পট পরিবর্তনের পর লাল্টু কানাডায় পালিয়ে ফিলিং স্টেশনের মালিক হিসেবে জীব্ন যাপন করছেন।

হাওয়া ভবনের হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দেখাশোনা করতেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ও অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবাল। দুজনেই কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান। ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হাওয়া ভবনের অঘোষিত মুখপাত্র বনে যান। বগুড়ায় পাউবো, সওজ, এলজিইডির সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে ৫ বছরে বিপুল অর্থ আয় করেন তিনি।

নিজ গ্রাম শিবগঞ্জ উপজেলার আলিয়ারহাটকে ‘মিনি টাউন’ হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি তারেক রহমানকে দিয়ে একদিনে ১৮টি প্রকল্প উদ্বোধন করান। পিতার চেহলামে ৩ লাখ লোক খাইয়ে এক ঐতিহাসিক রেকর্ড গড়েন। হাওয়া ভবনের এই দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ওয়ান-ইলেভেনে পালিয়ে যান। সাজাপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজ এই ব্যক্তি বহাল তবিয়তে কানাডায় রয়েছেন।

এই সিন্ডিকেটের মধ্যে অন্যতম ট্যালেন্টেড এবং সাবধানী বলা যায় প্রয়াত হারিছ চৌধুরীকে। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পেলেও তার মূল দায়িত্ব ছিল হাওয়া ভবনের সঙ্গে। কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হারিছ চৌধুরী ওয়ান-ইলেভেনে সিলেট সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে মামাবাড়ি আসামের করিমগঞ্জে চলে যান বলে শোনা যায়। পরে সেখান থেকে লন্ডনে। সেখানেই চুটিয়ে ব্যবসা করেছেন। তারেক রহমানের ব্যক্তিগত খরচের দেখভাল করতেন তিনি।

শোনা যায়, অর্থ খরচ করে বানানো নতুন নাম-পরিচয়ে ভিন্ন আইডেন্টিটি নিয়ে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতেন তিনি। তার পক্ষে এটা খুবই সম্ভব। হাওয়া ভবনের অত্যন্ত প্রভাবশালী হারিছ চৌধুরী সব সময়ই সতর্কতার সাথে অনিয়ম আর অপকর্ম করে গেছেন। শুরু থেকেই তিনি বিদেশের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করে গড়ে তুলেছিলেন সুরক্ষিত এবং বিকল্প আবাসন।

হাওয়া ভবনের অত্যন্ত ক্ষমতাধর আরেক ব্যক্তি ছিলেন সাবেক ছাত্রদল নেতা রকিবুল ইসলাম বকুল। দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়োগ-বদলিসহ বিএনপির সাংগঠনিক কর্মসূচি দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। একই সঙ্গে সাবেক ছাত্রদল নেতাদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিও দেখতেন তিনি। তিনি ছাত্রদলও দেখাশোনা করতেন। তারেক রহমানের পক্ষে বকুল জোট সরকারের মন্ত্রিসভার ভেতর শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।

বকুল মাঝে অনেকদিন চুপচাপ থাকলেও সম্প্রতি গত বছর থেকে আবারও তার নাম শোনা যাচ্ছে। জোট সরকারের ৫ বছরে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়া বকুল দীর্ঘদিন পলাতক থেকে বর্তমানে নিজ এলাকা খুলনার রাজনীতিতে সক্রিয়। ছাত্রদলের কমিটি গড়ার মিশন নিয়ে কাজ করছেন তিনি। গত কয়েক মাস আগে বকুল এবং একটি ইউনিটের ছাত্রদলের কমিটির সম্ভাব্য পদপ্রার্থীদের আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ফোনালাপ এবং স্ক্রিণশট ফাঁস হয়। সেখানে কমিটি গড়ার জন্য অর্থ সংগ্রহ করে লন্ডনে তারেক রহমানের নিকট পাঠানোর বিষয়টি উঠে আসে।

কমিটি বাণিজ্য করার জন্য ‘যে যত বেশি দিবে, সে তত বড় পদ পাবে’ কর্মসূচি নিয়ে কাজ করা বকুলের অধীনস্তরা পদ প্রত্যাশীদের কাছ থেকে কয়েকশ মোটরসাইকেল, নগদ অর্থ, ফেন্সিসহ নানান উপঢৌকন সংগ্রহ করছে বলে তথ্য প্রমাণ পেয়েছে গণমাধ্যমগুলো।

এই দুর্নীতিবাজ মাফিয়া চক্রের সদস্যরা প্রশাসনে তারেক রহমান সিন্ডিকেট, টিম হাওয়া ভবন, ভাইয়ার লোক ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। মন্ত্রীরা কথা না শুনলে তাকে অকার্যকর করে রাখা হতো, অনেক সিনিয়র মন্ত্রীকে প্রকাশ্যে ধমক দেয়া হত।

২০০১ সালে নির্বাচনে জয়লাভের পর মন্ত্রীসভা গঠনের পূর্বে হাওয়া ভবনে রীতিমত নিলাম হয়েছিল মন্ত্রীত্বের গদি বরাদ্দের ক্ষেত্রে। সেখানে যারা যারা চাহিদামত অর্থ দিয়েছিলেন, তারাই পেয়েছিলন নির্দিষ্ট সব মন্ত্রণালয়। তাদের ওপর নির্ধারণ করে দেয়া হয় চাঁদার পরিমাণ। পরবর্তী প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে তাদেরকে তারেক রহমানের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে গদি টিকিয়ে রাখতে হয়েছিল।

গিয়াউদ্দিন আল মামুন ওরফে খাম্বা মামুনের প্রতিষ্ঠান খাম্বা লিমিটেড- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাবুল গাজী, ওয়ান-কম্পোজিট লিমিটেডের পরিচালক এনামুল হক মামুনি, মামুনের পিএস কামরুজ্জামান, হাবুল ও মোটকা তারেক ওরফে মালয়েশিয়া তারেক, নরসিংদীর বেলায়েত, বগুড়ার গাবতলী এলাকার দিনকাল পত্রিকার প্রতিনিধি রুমন সবাই হাওয়া ভবনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

হাওয়া ভবনের ব্র্যান্ড এবং তারেকের নামে আতঙ্কিত করে বিভিন্ন স্তরের লোকজনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান তারা। হাওয়া ভবনের সামান্য কর্মচারী হলেও তাদের ক্ষমতার দাপটের কাছে অনেক বিএনপি নেতা অসহায় হয়ে থাকতেন। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের পর তারাই ‘হাওয়া’ হয়ে যান। পট পরিবর্তনে তারা গা ঢাকা দেন। দীর্ঘদিন আড়ালে থাকার পর তবে আবার ফিরে এসেছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে পুনরায় ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন।

বগুড়া জেলার নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে হাওয়া ভবনে আরও একটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ছিলেন- তারেক রহমানের পিএস সাজ্জাদ হোসেন নাইট, তার ভাই সুইট, গাবতলীর পৌর চেয়ারম্যান মোর্শেদ মিল্টন, ছাত্রদল নেতা এমআর ইসলাম স্বাধীন, মাহফুজ সিদ্দিকী লিটন ওরফে চাকু লিটন, জেলা বিএনপি সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা, সাধারণ সম্পাদক ভিপি সাইফুল,

মহিলা এমপি নূর আফরোজ জ্যোতি, গাবতলী থানা বিএনপি নেতা আতিকুর রহমান আতিক, সন্ত্রাসী নতুন, ধুনট থানা বিএনপি সভাপতি পল্লী মামুন, বগুড়া মিনিবাস সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক, সাবেক এমপি জিএম সিরাজের চাচাতো ভাই গোলাম মাহবুব প্যারিস, সাবেক এমপি হেলালুজ্জামান তালুকদার লালুর শ্যালক শামীম চৌধুরী, মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা কবির আহমেদ মিঠু, মোটর শ্রমিক নেতা শোকরানা,

সুদ ও দাদন ব্যবসায়ী জাকির হোসেন, ছাত্রদল নেতা শহীদুল ইসলাম বাবলু, অ্যাডভোকেট মাহবুব আল শাহীন, বাস মালিক হামিদুল হক চৌধুরী হিরু, মাহবুবুর রহমান বকুল প্রমুখ তারেক রহমান ও হাওয়া ভবনের কল্যাণে শত শত কোটি টাকার মালিক হন। ২০০৭-২০০৯ সাল পর্যন্ত তারা পালিয়ে থেকে এখন আবার দেশে ফিরেছেন।

আলোচিত-সমালোচিত এই ভবনের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন ভবনের কথিত মালিক আলী আসগার লবী ও সিলভার সেলিম। জোটের ৫ বছরে উভয়েই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ছিলেন। হাজার কোটি টাকার ব্যবসা বাগিয়ে নেয়ার তথ্য প্রমাণ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে লবী হাওয়া ভবন বেচে তার পাকিস্থানি স্ত্রীকে নিয়ে আমেরিকা প্রবাসী হয়েছেন। সিলভার সেলিম বর্তমানে দেশেই ব্যবসা করছেন।

মন্ত্রী-এমপির পুত্রদের সমন্বয়ে আরেকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ছিল হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক। সেখানে ছিল পাটমন্ত্রী শাজাহান সিরাজের পুত্র রাজিব সিরাজ অপু, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর পুত্র আবিদ হাসান, বন ও পরিবেশমন্ত্রী তরিকুল ইসলামের পুত্র অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোর্শেদ খানের পুত্র ফয়সাল মোর্শেদ খান ও মেজর (অব.) কামরুল ইসলামের পুত্র তানভীর ইসলাম জয়। তারা জোট সরকারের ৫ বছর হাওয়া ভবনের অধীনে চুটিয়ে ব্যবসা করে লালে লাল হয়েছেন।

একইভাবে যুবদল সভাপতি বরকত উল্লা বুলু ও সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, যুবদল নেতা (বতমানে যুবদল সভাপতি) সাইফুল ইসলাম নীরব, মইনউদ্দিন তিতাস, নবাবগঞ্জের খন্দকার আবু আশফাক ও হেলেন জেরিন খানের বিশেষ পরিচিতি ছিল হাওয়া ভবনের লোক হিসেবে। এরা কেউ ব্যবসা কেউ বা রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন এখনও।

ওয়ান-ইলেভেনে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে ফলাও করে হাওয়া ভবনের লুটপাটের কাহিনী প্রকাশিত হয়। হাওয়া ভবন তখন হয়ে ওঠে নির্বাচনের ইস্যু। হাওয়া ভবনের সেই মাফিয়াদের অনেকেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার বেড়াজালে আটকে পড়েন।

সময়ের আবর্তে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠছে হাওয়া ভবনের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট সদস্যরা। কেউ কেউ আগের মতো বিএনপির রাজনীতিতে নিজের বা আগের সিন্ডিকেটের অবৈধ প্রভাব বিস্তারে রীতিমত কলকাঠি নাড়াচ্ছেন, কেউ আবার সরকারি দলের সুশীতল ছায়াতলে বসেই ঘোঁট পাকাচ্ছেন।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ