1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি

মো. সেলিম রেজা : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শনিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২৩

গোটা পৃথিবী এক দুঃসময় পার করছে। বড় অর্থনীতির দেশ, যেমন—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডাসহ ছোট অর্থনীতির দেশগুলো মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট। করোনাকালে বিশ্ব অর্থনীতিকে এক ধরনের সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে। যেমন—ভোগ কমে যাওয়া, উৎপাদন হ্রাস পাওয়া, পণ্য পরিবহন ব্যাহত হওয়া, কর্মসংস্থান হ্রাস, স্বাস্থ্যঝুঁকি ইত্যাদি। করোনা মোকাবেলায় সরকারকে একদিকে কর কমাতে হয়েছে, অন্যদিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থ সহায়তাসহ শিল্প-কারখানাগুলোকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হয়েছে। পৃথিবীতে বেশির ভাগ দেশ এই অতিরিক্ত অর্থের সংকুলান করেছে হয় টাকা ছাপিয়ে (প্রিন্ট করে) নতুবা দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ করে। ২০২১ সালের শেষের দিকে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করলে পৃথিবীজুড়ে ভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিতে শুরু করে। করোনাজনিত কারণে দীর্ঘ সময়ের লকডাউন উঠিয়ে নিলে মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করে। মানুষের চলাফেরা, কাজকর্ম, ভোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য—সব কিছুই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, করোনাকালে অর্থনীতির সব খাত সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। যেমন—চিকিৎসা, ওষুধশিল্প, কৃষি, অনলাইন সেবা খাতের সঙ্গে জড়িত মানুষজনসহ সরকারি চাকরিজীবীদের আয় কমেনি বরং বেড়েছে মূলত কর কমানো, ঘরে অবস্থান ও ভোগ ব্যয় কমার জন্য। অন্যদিকে সরকারের দেওয়া নগদ অর্থ সাহায্য গরিব মানুষের হাতে সেভাবে না থাকলেও বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের হাতে টাকাগুলো রয়ে গেছে।

পৃথিবীব্যাপী চাহিদা বৃদ্ধির আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, যা ৮০০ কোটির মাইলফলক ছুঁয়েছে। ফলে করোনা-পরবর্তী সময়ে একদিকে মানুষের চাহিদা ভোগ ও ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প-কারখানাগুলো দ্রুত উৎপাদনে ফিরতে না পারায় দ্রব্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। ২০২২ সালের শুরু থেকে বিশ্বের কমবেশি সব দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি ৮ থেকে ৯ শতাংশে উঠে যায়। এর মধ্যে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে শুরু হয় রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ। যুদ্ধের পাশাপাশি রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসায় অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য, যেমন—তেল, গ্যাস, সার, গম ও ভুট্টার সরবরাহ বিঘ্নিত হয় এবং বিশ্বব্যাপী এসব পণ্যের দাম আরো বাড়তে থাকে। বিশ্বব্যাপী তেলের ঘাটতি ও দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষি ও শিল্পোৎপাদন এবং পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায় মারাত্মকভাবে। যার ফলে মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যায় বহুগুণে। একদিকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধের তেমন কোনো আভাস না থাকা, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানের জন্য।

মূল্যস্ফীতি রোধে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ অনেক দেশ সরাসরি অর্থ সহায়তা বন্ধের পাশাপাশি নীতি সুদহার বৃদ্ধি করা শুরু করে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কয়েক ধাপে নীতি সুদহার বাড়ানোর কারণে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ করা ও সব ধরনের বিনিয়োগ ব্যয়বহুল হয়ে যায়। গত প্রায় ৮-১০ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ১-১.৫০ শতাংশ কমলেও ২-৩ শতাংশে পৌঁছতে কত সময় লাগতে পারে তা বলা কঠিন হলেও বিশ্বজুড়ে মন্দা যে আসন্ন সে বিষয়ে প্রায় সবাই একমত। প্রশ্ন হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অনেক হাতিয়ার থাকলেও উন্নত দেশগুলো কেন একটা হাতিয়ার (নীতি সুদহার) ব্যবহার করছে? জনগণের আয় বাড়ানো ও চাহিদা মেটানোর জন্য যেখানে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ানো জরুরি, সেখানে নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে বিনিয়োগকে সংকোচন করা হয়েছে।

উচ্চ সুদের কারণে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন কম হচ্ছে, অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করছে। এখন কথা হচ্ছে, উন্নত দেশগুলো মূল্যস্ফীতি রোধে বা অর্থনীতিতে বিদ্যমান অতিরিক্ত অর্থের সরবরাহ কমানোর জন্য মানুষের আয়ের ওপর করহার বাড়াল না কেন? অনেকে বলতে পারেন উচ্চ সুদের জন্য মানুষ তার হাতের অতিরিক্ত অর্থ ভোগে ব্যয় না করে সঞ্চয় করবে, চাহিদা কমে যাবে এবং মূল্যস্ফীতি কমে যাবে। নীতিনির্ধারকদের এ কথা মনে রাখতে হবে, মানুষ দীর্ঘ এক বছর ঘরবন্দি ও সীমিত ভোগের পর বেশি ভোগ করবে এটাই স্বাভাবিক, আর করোনাকালে লাখ লাখ মানুষ মারা গেলেও পৃথিবীর জনসংখ্যা কিন্তু বৃদ্ধি পেয়ে ৮০০ কোটি পার হয়েছে। অনেক দেরিতে হলেও যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক মানুষের আয়ের ওপর করহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি আলোচনা করতে গেলে ভালো-মন্দ দুটি দিকই পাওয়া যায়। সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংককে ধন্যবাদ দিতে চাই এ জন্য যে তারা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যাংক রেট ও কলমানি রেট বা নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে সরকার কৌশলী হলে অতিরিক্ত ব্যয়ভার নির্বাহে, বিনিয়োগ ও অবকাঠামো নির্মাণে বা জ্বালানি তেলের ভর্তুকি প্রদানে স্বল্প পরিসরে করহার বাড়াতে পারত। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এমনিতেই মানুষের দুরবস্থা, তার ওপর সরকার কর বাড়াবে কিভাবে? আগেই বলেছি, করোনার কারণে সব মানুষের আয় কমেনি, বরং অনেক মানুষের আয় বেড়েছে। সমাজে আয়বৈষম্য বেড়েছে বহুগুণ। নানামুখী সংকটের সময় আয়বৈষম্য না বাড়িয়ে বরং কমানোর দিকে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সরকার করমুক্ত আয়ের সীমা তিন লাখ থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লাখ করে ওপরের দিকে করহার ১৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ৩৫-৪০ শতাংশ পর্যন্ত করতে পারত। আবার জেলাভিত্তিক বা অঞ্চলভিত্তিক করহার নির্ধারণ করতে পারত। যেমন—ঢাকা অঞ্চলের জন্য এক ধরনের, আবার রাজশাহীর জন্য এক ধরনের করহার। যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান ভালো ব্যবসা করেছে তাদের মুনাফার ওপর করহার বাড়ানো যেত, যদি তা আবার বিনিয়োগে ব্যবহার করা না হয়। দক্ষ জনবল বাড়ানোর মাধ্যমে করের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি কর প্রদানকারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। সরকারের আয় বৃদ্ধি ও সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা মানুষের কাছে দ্রুত ও সঠিকভাবে পৌঁছানোর জন্য একটি শক্তিশালী তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে হবে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ করদাতা প্রকৃত আয় অনুযায়ী কর প্রদান করেন না। ফলে তাঁদের আয়গুলো কালো টাকা হয়ে যায়। আর এই কালো টাকা কোনো না কোনোভাবে দেশ থেকে পাচার হয়ে যায়। গত বছরের শেষের দিকে দেশে ডলারের যে সংকট দেখা দেয় তার একটা অন্যতম কারণ অর্থপাচার। বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে ডলার সংকটও দেখা দেয়। ছোট ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সব চাপ (করোনার আঘাত, জ্বালানির উচ্চমূল্য, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য, অর্থপাচার) একসঙ্গে নিতে পারেনি। ফলে অর্থনীতি ও জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে মূল্যস্ফীতির এই চাপ শুধুু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, বিশ্বের অনেক বড় দেশ এই চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।

তেলে ভর্তুকি কমানো বা আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য সরকার যে সময়ে এবং যেভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াল, সেটা সঠিক মনে হচ্ছে না। জ্বালানি তেল ও গ্যাস হচ্ছে অর্থনীতিতে রক্ত সঞ্চালনের মতো। তেলের সরবরাহ ভালো ও দামে সাশ্রয়ী হলে উৎপাদন ও পরিবহনব্যবস্থা ভালো চলে আর সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে বা দাম বেশি হলে তার প্রভাব অর্থনীতি ও জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পড়ে। সমন্বয় করা যাবে না, তা নয়। তবে সময় ও প্রয়োজনকে বিবেচনায় নিয়ে ধাপে ধাপে বাড়ালে অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব কম পড়ে। বাংলাদেশের মুদ্রার বিনিময় হার এখন বাজারব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল, আবার পোশাকশিল্পও আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো রকম সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই প্রতিযোগিতা করছে। ফলে জ্বালানি তেলের দাম বাজারের চাহিদা ও জোগানের ওপর ছেড়ে দিলে বা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে চাইলে তার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের জনগণের বা অর্থনীতির আছে, তবে তা সময়-সুযোগ বুঝে করতে হবে।

জনগণের চাহিদা মেটানো ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য উৎপাদন ও উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সময় বলেন, এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না। কথাটাকে শুধু বলার মাঝে না রেখে বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরকে কাজে লাগাতে হবে। কৃষি মাঠকর্মী ও কর্মকর্তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আঙিনায় ও বাড়ির আশপাশে সবজি ও ফলমূল চাষের জন্য পরামর্শ ও উৎসাহ প্রদান, গুরুত্ব বোঝানোসহ বিনা মূল্যে বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ করতে হবে। শহর এলাকায় ছাদ কৃষিকে উৎসাহিত করার জন্য একই ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।

লেখক : মো. সেলিম রেজা – সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ