অবশেষে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তির ঘোষণা দিয়েছে আপিল বোর্ডের সদস্য শ্যামল দত্ত। এই শ্যামল দত্ত কি সাংবাদিক শ্যামল দত্ত? জানি না। তবে এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো খবর। একটা চলচ্চিত্র কোনো সুনির্দিষ্ট ও গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া চারবছর সেন্সর বোর্ডে আটকে ছিলো, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগে। আমি মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর বিরাট ভক্ত এমন না। আনিসুল হকের লেখা নিয়ে তার দুটো কাজ পছন্দ হয়েছিল, নাটক ৫১বর্তী ও চলচ্চিত্র ব্যাচেলর। এছাড়া তার অন্য কোনো কাজ মনে তেমন দাগ কাটেনি। কিন্তু মানুষ ও বোদ্ধাদের আলোচনা সমালোচনা শুনে বলা যায়, তিনি সাম্প্রতিক সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধী, জামায়াত ইত্যাদি বিষয়ে ফারুকীর অবস্থান ধোঁয়াশাময়, যে কারণে তার প্রতি আমার অনাগ্রহ আছে। কিন্তু এই চলচ্চিত্রটা আটকে রাখার জন্য তার প্রতি একধরণের সহানুভূতিও আছে আমার। হলি আর্টিজানের ঘটনা আমার জন্য নানাভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ওই ঘটনার সন্ধ্যায় আমি টুইটারে খুব সরব ছিলাম। আমার মনে পড়ে টুইটারে পোস্ট দেখে পশ্চিমা বিশ্বের নানা গুরুত্বপূর্ণ টিভি চ্যানেল আমার ও ফেসবুক বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান দিয়ার সাক্ষাৎকার নিতে থাকে লাইভ ঘটনা চলাকালীন সময়ে। একপর্যায়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাকে বিদেশি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে অনুৎসাহিত করেন। দ্বিতীয়ত, এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের সাথে কানাডায় ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো পড়ুয়া এক বাংলাদেশি ছাত্রের সংশ্লিষ্টতার প্রসঙ্গ আসে। ওই সময়ে আমারসহ অনেক ভিসা প্রার্থীর আবেদন আটকে দেয় কানাডা। ভিসা পেতে দেরি হবার কারণে একপর্যায়ে আমার কানাডিয়ান প্রাদেশিক সরকার থেকে প্রাপ্ত পিএইচডির পূর্ণ স্কলারশিপটিও বাতিল হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। পরে ভিসা পেলে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে প্রায় ৪ মাসের স্কলারশিপ জলাঞ্জলি দিয়ে পরবর্তী সেমিস্টারে আমি পিএইচডি শুরু করি। জানুয়ারি পিএইচডি শুরু করার জন্য খুব খারাপ সময়। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আছে। তৃতীয়ত, কানাডায় আসার পর পিএইচডি প্রথম প্রস্তাবনা হিসেবে আমি বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইসলামী উগ্রবাদে আগ্রহী হবার সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে পিএইচডি করার আগ্রহ প্রকাশ করি। কিন্তু আমার কানাডিয়ান সুপারভাইজার ও আরেক কানাডিয়ান কমিটি মেম্বার এই বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বিধায় নিরুৎসাহিত করেন।
সুতরাং নানা কারণে হলি আর্টিজান এবং তার ধারাবাহিকতায় শনিবার বিকেল চলচ্চিত্রটি নিয়ে আমার আগ্রহ জন্মায়। ওই সময়ের সব পত্রিকা পড়ে, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার বন্ধুদের সাথে কথা বলে অনেক কিছু জানলেও এই ঘটনায় ফারাজ নায়কোচিত ভূমিকা রেখেছে এমন কিছু তখন শুনিনি। বরঞ্চ উল্টোটা দুয়েক সূত্র থেকে শুনেছি, কিন্তু গুরুত্ব দিইনি কারণ আমার কাছে নিহত সবাই দুর্ভাগ্যের শিকার, আমি তাদের সবার প্রতি সহানুভূতিশীল। ফারাজের বন্ধু অবন্তিকার মায়ের প্রেস কনফারেন্স শুনে মনে হয়েছে যারা ফারাজকে চেনে, তারা কেউ তার নায়কোচিত চরিত্রের সাথে পরিচিত নয়। এটি দুর্ভাগ্যজনক যে ওই ঘটনায় অনেকে বেঁচে থাকলেও এই বিষয়ে চলচ্চিত্র বানানোর ক্ষেত্রে কাল্পনিক নায়কের আশ্রয় নেওয়া যায় স্রেফ অর্থ ও প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে।
এখন একটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী তাদের অর্থ-প্রতিপত্তি দিয়ে যদি পরিবারের এক সন্তানকে নায়কের ভূমিকায় আবির্ভূত করতে চায়, তারা সেটা করতেই পারে। এই শিল্পগোষ্ঠীর মুখপাত্র পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ জাতির বিবেক হিসেবে একটি উচ্চমার্গীয় অবস্থান সমাজের যেকোনো বিষয়ে ধরে রাখতে চাইলেও এ বিষয়ে পূর্ণ নীরবতা বজায় রেখেছেন। জীবন ও জীবিকার খাতিরে তাদের এই অবস্থান নিয়েও বিস্মিত হবার কিছু নেই অবশ্য।
ফারাজকে নায়ক বানিয়ে ভারতের চিত্র পরিচালক এই বিষয়ে ঘটনার প্রায় সাড়ে ৬ বছর পর কেন চলচ্চিত্র বানিয়ে মুক্তি দিতে চাইছেন এটি একটু অবাকই লেগেছে। এমন না স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে চলচ্চিত্র বানানোর মতো আর কোনো বিষয়ের অবতারণা হয়নি। তবে বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক ‘মানের’ হত্যাকাণ্ডের সন্ত্রাসীরা ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলো, এটি ভারত ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশবিরোধী শিবিরের জন্য একটা যুৎসই প্রোপাগান্ডা ইসু, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই চলচ্চিত্রে তাই বাংলাদেশবিরোধী শিবির, সাথে দেশের ভেতর কাউকে নায়ক বানানোর প্রচেষ্টায় কোনো বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী জড়িত থাকলে অবাক হবো না।
অন্যদিকে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী মাত্র পনের দিনের মহড়া শেষে সাত দিনে চলচ্চিত্রটি ধারণের কাজ শেষ করেন। ফারুকীর চলচ্চিত্রেও ভারত ও জার্মানির বিনিয়োগ আছে বলে শুনেছি। এতবছর পর যখন ভারতের চলচ্চিত্রটি মুক্তির ঘোষণা এলো, তখন আপিল বোর্ড কেবলমাত্র চলচ্চিত্রের শুরুতে এই চলচ্চিত্র হলি আর্টিজানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়নি এই সতর্কবাণী লিখে দেবার শর্তে মুক্তির ঘোষণা দেওয়ার ব্যাপারটা বিরাট ‘নওটাঙ্গি’ লেগেছে। ফারাজ ও শনিবার বিকেলের শুরুতে ও শেষে যাই লিখে দেওয়া হোক না কেন, এ দুটি চলচ্চিত্রই যে হলি আর্টিজানকে কেন্দ্র করে সেটি দুধের শিশুর বুঝতেও সমস্যা হবার কথা নয়।
এখন শনিবার বিকেলে চার বছর ধরে সেন্সর বোর্ড ভারতীয় সরকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বাংলাদেশবিরোধী শিবিরের স্বার্থরক্ষার জন্য আটকে রেখেছিলো, এই আশঙ্কা যদি কারও মনে আসে, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। এই যে এইসব কন্সপিরেসি থিওরির প্রচারণা, তার দায় যারা চার বছর বিনা কারণে শনিবার বিকেলে আটকে রাখল তাদের। মাঝে সেন্সর বোর্ড তুলে দেবার একটা আলাপ শুনেছিলাম, ব্যাপারটা ভালো হলেও, বাংলাদেশ এখনও প্রস্তুত নয়। তবে সেন্সর বোর্ডে সরকারের সচিররা কী করেন সেটা যেমন বুঝি না তেমন নতুন সদস্য যারা হলেন তারাও কী করবেন বুঝি না। নাম উল্লেখ করলাম না, উল্লেখ করলে আবার বলবেন আপনার এতো নাক উঁচা কেন! গত দুইদিনের পত্রিকা কিংবা গুগলে বর্তমান সেন্সর বোর্ডের সদস্য লিখে সার্চ দিলেই পাবেন। যাই হোক এখন দুটো চলচ্চিত্রই দেখতে হবে। অপছন্দের ভারতীয় ছবি ও প্রিয়-না-ফারুকীর ছবি দুটো দেখে আরেকটা লেখা লিখতে হবে ফেব্রুয়ারি মাসে।
লেখক : শামীম আহমেদ জিতু – কলামিস্ট ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ