ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ প্রাপ্তি এবং ঋণ নবায়নের যোগ্যতা ধারাবাহিকভাবে শিথিল করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের যোগ্যতার মাপকাঠিতে কমপক্ষে ৬০ ভাগ নম্বর না পেলে ঋণ দেয়া হতো না। এটা কমাতে কমাতে এখন তা ৫০ ভাগে নামিয়ে আনা হয়েছে। বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে গেছে। নতুন ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এ কারণে ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা শিথিল করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ শিথিলতার কারণে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা সন্তোষজনক না হওয়ার পরেও বেশিসংখ্যক গ্রাহক নতুন ঋণ পাওয়ার পথ সুগম হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে ব্যাংকের ঝুঁকির মাত্রাও বেড়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
জানা গেছে, দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে যাওয়ায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর একটি নতুন নীতিমালা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ঋণের ঝুঁকি পরিমাপের নতুন এ নীতিমালা উদ্বোধন করেন গভর্নর ফজলে কবির। ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর) নামের এই নীতিমালায় ঋণের পরিমাণ ও গুণগত উভয় ধরনের সক্ষমতার মূল্যায়ন শর্ত রাখা হয়।
নীতিমালা অনুযায়ী, গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা মূল্যায়নের ভিত্তিতে গ্রাহককে চার শ্রেণীতে বিভাজন করে ব্যাংকগুলো। কোনো গ্রাহক ‘চমৎকার’ (এক্সিলেন্ট) বা ‘ভালো’ (গুড) রেটিং পেলে ব্যাংক তাকে অর্থায়ন করতে পারবে। ‘প্রান্তিক’ (মার্জিনাল) রেটিংধারী গ্রাহককে পুরনো ঋণ নবায়ন বা নতুন করে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে ‘অগ্রহণযোগ্য’ রেটিংধারীকে কোনো পরিস্থিতিতেই নতুন ঋণ দিতে পারবে না ব্যাংকগুলো, যদি না আগের ঋণ শতভাগ নগদ পরিশোধ হয় অথবা জামানত দিয়ে ঋণটি আচ্ছাদন করা হয়। ‘অগ্রহণযোগ্য’ (আনএকসেপ্টেবল) রেটিংভুক্ত গ্রাহকের আগের ঋণ সর্বোচ্চ দু’বার নবায়ন বা বর্ধিত করা যাবে। প্রথমে আইসিআরআর নীতিমালা অনুযায়ী গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বিবেচনায় ৮০-এর বেশি পেলে ‘চমৎকার’, ৭০-এর বেশি এবং ৮০-এর কম নম্বর পেলে ‘ভালো’, ৬০-এর বেশি এবং ৭০-এর কম পেলে ‘প্রান্তিক’ এবং ৬০-এর নিচে নম্বর পেলে ‘অগ্রহণযোগ্য’ রেটিং দেয়া হবে। তবে কোনো গ্রাহক গুণগত রেটিংয়ে যত নম্বরই পাক না কেন, পরিমাণগত রেটিংয়ে ৬০ শতাংশ নম্বর না পেলে তাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ রেটিং দেয়া হবে।’
জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় ২০২০ সালের মার্চের পর থেকে ব্যবসাবাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসে। ওই বছর অনেকেই আন্তর্জাতিক মন্দার ধকল কাটাতে না পেরে ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ করে দেন। অর্থনৈতিক গতি স্বাভাবিক রাখতে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। যার মাধ্যমে গত অর্থবছরে এক লাখ কোটি টাকার উপরে ঋণ বিতরণ করে ব্যাংকগুলো। এসব বিবেচনায় নিয়ে গত বছর ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা শিথিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগের নীতিমালা শিথিল করে ন্যূনতম ঋণ পাওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি ৬০ খেবে ৫৫-তে নামিয়ে আনে। ওই সময় এ-সংক্রান্ত এক নির্দেশনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে, ‘অর্থনীতিতে কোভিড-১৯-এর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় ঋণগ্রহীতার ওপর এর প্রভাব সহনীয় মাত্রায় রাখার লক্ষ্যে ২০২১ সালে গ্রাহকের ক্রেডিট রিস্ক রেটিং সম্পাদনে ২০২০ এবং ২০১৯ সালের মধ্যে যেকোনো এক সালের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী বিবেচনায় নেয়া যাবে। পাশাপাশি আইসিআরআর বিবেচনায় রেটিং ৭৫-এর বেশি পেলে ‘চমৎকার’, ৬৫-এর বেশি এবং ৭৫’র কম নম্বর পেলে ‘ভালো’, ৫৫-এর বেশি এবং ৬৫-এর কম পেলে ‘প্রান্তিক’ এবং ৫৫-এর নিচে নম্বর পেলে ‘অগ্রহণযোগ্য’ রেটিং দেয়া হবে। তবে কোনো গ্রাহক গুণগত রেটিংয়ে যত নম্বরই পাক না কেন, পরিমাণগত রেটিংয়ে ৫০ শতাংশ নম্বর না পেলে তাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ রেটিং দেয়া হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ পরিশোধের শর্ত গত ৩১ ডিসেম্বরের পর থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বড় কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ ঋণ তেমন পরিশোধ করছে না, যদিও তাদের দখলে রয়েছে ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঋণ। এর পাশাপাশি অন্য গ্রাহকদের একটি বড় অংশ ঋণ পরিশোধ করছেন না। তারা নানা উপায়ে ঋণ নবায়নের চেষ্টা করছেন। তবে এর মধ্যে কিছু ব্যবসায়ী রয়েছেন প্রকৃতপক্ষেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।