প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি আমাদের জীবনে নতুন নতুন তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়। অন্য ১১ মাসের চেয়ে ফেব্রুয়ারির আবেদন ভিন্ন আমাদের কাছে। সাংস্কৃতিক বিবেচনায় অত্যন্ত পবিত্র এই মাস। ফেব্রুয়ারি আমাদের অধিকার সচেতন হতে শিখিয়েছে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মদান আমাদের মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে। আর কে না জানে ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছি স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে। পাকিস্তানিরা নৃশংস গণহত্যার মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতার চেতনাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা সফল হয়নি। অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে।
আমরা সব সময়ে একুশের চেতনার কথা বলি। একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন ছিল মূলত আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। তাই ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা আমাদের মাতৃভাষা সম্পর্কে সচেতন হই। একুশের অঙ্গীকার ছিল আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে আমরা বাংলা প্রচলন করব।
ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পর যদি আমরা হিসাব করি কতটা পথ এগোলাম, তবে দেখব লক্ষ্যে পৌঁছতে আমাদের এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে। আমরা শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন করতে চাই। সেই প্রত্যাশায় সব শিশুকে বিদ্যালয়ে আনার চেষ্টা সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চলমান রয়েছে। তবে তার ফলাফলটার দিকে একটু দৃষ্টি দিতে চাই।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে আমাদের এখন বিশেষ জোর দিতে হবে। অবশ্য সরকার মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি করার জন্য নানা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এই যে বইমেলায় হাজার চারেক নতুন বই প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে কতগুলো মানসম্পন্ন? প্রত্যেকেরই স্বাধীনতা আছে বই প্রকাশ করার, এখানে মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একমাত্র প্রকাশকরাই পারেন নিজেদের প্রকাশিত বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ করতে। বইয়ের ব্যবসাকে আলু-পটোলের ব্যবসার সঙ্গে এক করে দেখলে হবে না। মানসম্পন্ন না হলে সেই বই প্রকাশক কেন প্রকাশ করবেন? অথচ আমরা অহরহ লক্ষ করি ভুল বানানে, ভুল বাক্য গঠনে নিম্নমানের বই প্রকাশিত হয়ে চলেছে। বিষয়বস্তুর কথা বাদই দিলাম। প্রতিটি বই প্রকাশনার আগে সম্পাদনার দাবি রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ প্রকাশকই সম্পাদনার ওপর গুরুত্ব দেন না।
ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের দেশে সংস্কৃতিচর্চা ব্যাপকতা লাভ করে। আজকাল প্রায় সব জেলা-উপজেলা শহরেই শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এর মধ্যে পথনাটক একটা বড় জায়গা দখল করে আছে। আসলে পথনাটকের মাধ্যমেই আমরা আমাদের বক্তব্য শৈল্পিকভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।
যাত্রা একসময়ে ছিল গ্রামীণ জীবনের প্রধান বিনোদনমাধ্যম। নানা কারণে যাত্রা তার অতীত গৌরব হারিয়েছে। এখন নতুন করে যাত্রার নবযাত্রার চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার জন্য যাত্রাশিল্পের প্রসার বিঘ্নিত হচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল নাটকের মতো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নিবন্ধিত যাত্রাদলগুলো দেশের যেকোনো জায়গায় যাত্রা অভিনয়ের সুযোগ পাবে। কিন্তু বেশির ভাগ জায়গায় স্থানীয় প্রশাসন আইন-শৃঙ্খলার অজুহাত দেখিয়ে যাত্রা অভিনয়ের অনুমতি দেয় না। এ ব্যাপারে সরকারের ওপরমহল থেকে কঠোর নির্দেশনা না দিলে যাত্রা ধীরে ধীরে অবলুপ্ত শিল্পমাধ্যমে পরিণত হবে।
সব শেষে আমরা গণমাধ্যমের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। আমাদের জীবনে গণমাধ্যমের একটা ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ফলে গণমাধ্যমে প্রমিত ভাষার ব্যবহার আমরা প্রত্যাশা করি। কিন্তু আমাদের বেশির ভাগ এফএম রেডিওতে যে বিকৃত বাংলা ব্যবহার করা হয় তার বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমরা উদাসীন। তরুণ প্রজন্ম সেই ভুল উচ্চারণ, ইংরেজি-হিন্দি মেশানো ভাষা, বিকৃত বাচনভঙ্গিকেই অনুকরণ করে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করছে। ব্যক্তিগতভাবে যদিও আমি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণবিরোধী, কিন্তু ভাষার এই বিকৃতিরোধে কঠোরতা অবলম্বন করা দরকার। বেশ কয়েক বছর আগে এ ব্যাপারে উচ্চ আদালত থেকে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল এবং একটি কমিটিও করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি নিয়ে আর কোনো সংবাদ শোনা যায়নি।
আমরা প্রত্যাশা করব, গণমাধ্যমে যাঁরা কথা বলবেন, সংবাদ পড়বেন—সবাই প্রমিত বাংলায় শুদ্ধ উচ্চারণে বলবেন। কারণ গণমাধ্যমে ব্যবহৃত ভাষাকেই তো সাধারণ মানুষ মান ভাষা হিসেবে অনুসরণ করবে।
একুশের শহীদদের প্রতি আমরা তখনই প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারব, যখন আমরা একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে মনোযোগী হব এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হব। আমরা যেন ভুলে না যাই একুশ কারো কাছে মাথা নত করে না।
লেখক : রামেন্দু মজুমদার – সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।