২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রামস্থ নতুনপাড়া সেনানিবাসে ঘুমন্ত বাঙালি সৈনিকদের উপর পাকিস্তানি হায়েনা সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করছে, এ খবর জানার পর, মেজর জিয়া তার ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২৫০ জন সৈন্য, সমুদয় গােলাবারুদ ও যানবাহন নিয়ে রাত ৩টার সময় ষােলশহর স্টেশন হেড কোয়ার্টার ত্যাগ করে কালুরঘাটের দিকে পালিয়ে যায়। আমরা যারা ষােলশহর ২নং গেইটের আশেপাশে অবস্থান করছিলাম, তাঁদের ধারণা ছিল, মেজর জিয়ার নেতৃত্বে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট নতুনপাড়া সেনানিবাসে আক্রান্ত আহত ও আটকে পড়া বাদবাকী বাঙালি সৈন্যদের উদ্ধারে এগিয়ে যাবে। পরে জেনেছি, এখানকার মৃতপ্রায় সৈনিকরাও আশা করেছিল মেজর জিয়ার দল তাদের উদ্ধারে এগিয়ে যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, দুর্ভাগ্য আক্রান্ত ও আটকে পড়া নতুনপাড়া সেনানিবাসের বাঙালি সৈনিকদের। মেজর জিয়ার ৮ম বেঙ্গল তাদের উদ্ধারে এগিয়ে যাবার কথা দূরে থাক চট্টগ্রাম শহরের অন্য কোথাও এ্যাম্বুশ করা বা প্রতিরােধ গড়ে তােলাও নিরাপদ মনে করে নি। তারা প্রাণ বাঁচাতে চলে গেল প্রত্যন্ত গ্রামে। যাখানে কোনও যুদ্ধ নেই, কোনও ভয় নেই।
অবশ্য ৮ম বেঙ্গল যে, রাতের আঁধারে পালিয়েছে, আমরা সেটা বুঝতে পেরেছি ২৬ মার্চ ভাের ৫টায়। ২৫ মার্চ নতুনপাড়া সেনানিবাসের দিক থেকে আসা গােলাগুলির প্রচণ্ড শব্দের কারণ কী জানার জন্য আমরা ভাের ৫টার সময় যােলশহর ২নং রেল গেইটের দক্ষণে যে বালুকাময় মাঠটি ছিল, সেখানে গিয়ে হাজির হলাম আমরা দেখলাম, সারা গায়ে কাটাছেঁড়ার দাগ, আধাউলঙ্গ, কেউ গামছা পড়া, কেউ লুঙ্গি পড়া – উদভ্রান্ত কিছু বাঙালি সৈন্যকে ঘিরে মানুষের জটলা। কাছে গিয়ে জানতে পারলাম, ওরা সেইসব হতভাগ্য সৈনিক, যারা নতুনপাড়া সেনানিবাস থেকে প্রাণ নিয়ে পাকিস্তানি হামলা থেকে বেঁচে এখানে পালিয়ে এসেছে ৮ম বেঙ্গলের কাছে।
অনেক আশা নিয়ে ওরা এসেছে ৮ম বেঙ্গলে। এসেছে বাদ্য-বস্ত্র ও অস্ত্রের জন্য। এসেছে ৮ম বেঙ্গলকে সঙ্গে নিয়ে নতুনপাড়া সেনানিবাসে আটকে পড়া বাঙালি সৈন্যদের উদ্ধারে এগিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু হায়! সবই দুরাশা। ৮ম বেঙ্গলের স্টেশন হেড় কোয়ার্টারে কেউ নেই। কিছুই নেই। সব হাওয়া। বাঙালি মুখরিত একটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট এখন সম্পূর্ণ ফাকা।
সৈন্যদের মুখে সিডিএ গােডাউন ফাকা। সেখানে বাঙালি সৈন্যরা নেই, একথা শুনে আমরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। এবার নিজের চোখে দেখলাম। এবং থ হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম না কেন এমন হল। কোনও যুদ্ধ না, গােলগুলি না, কোনও আক্রমণ না, প্রতি আক্রমণ না; কী এমন ঘটনা ঘটল যে, এতবড় একটি সুসজ্জিত সেনাদল রাতের আঁধারে পালাতে বাধ্য হল?
খোঁজ নিয়ে জানা গেল ৮ম বেঙ্গল রাত ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে রেলরাস্তা ধরে সৈনিকরা, গাড়ির রাস্তা ধরে অফিসাররা, দিঘিদিক জ্ঞানহারা পথিকেরমত পালিয়েছে পূর্বদিকে। আমি নিজে নতুনপাড়া থেকে অষ্টম বেঙ্গলের কাছে সাহায্যের জন্য আসা কিছু সৈন্যকে পূর্বদিকে কালুরঘাট ব্রীজ পর্যন্ত পৌছে দিলাম। সেখানেই আমি জানলাম, মেজর জিয়ার সেনাদল বােয়ালখালীর করলডেঙ্গা পাহাড়ের দিকে চলে গেছে।
সূত্রঃ যুদ্ধের ময়দান থেকে মেজর জিয়ার পলায়ন, সিরু বাঙালি