1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

মহীরুহদের চোখে মহানায়ক বঙ্গবন্ধু

অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০২৩

বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ। আমাদের রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির পরতে পরতে তিনি জড়িয়ে আছেন নিবীড়ভাবে। আধুনিক ও উদার বাংলাদেশ নির্মাণে তাঁর ভূমিকা যে কতোটা দৃঢ় ছিলো তা আমরা জানতে পারি। বাংলাদেশের গুণীজনদের কাছ থেকে। সেই গুণীজনদের অনেকেই আজ আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শৈল্পিক চরিত্রের নানা দিক নিয়ে তাঁরা যেসব কথা লিখে ও বলেছেন তা আমাদের চিরদিনের সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে রয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর এবারের জন্মদিনে তাঁর নান্দনিক নেতৃত্ব ও চরিত্রের নানা দিক নিয়ে গুণীজনেরা যেসব অমূল্য কথা বলেছেন সেগুলো লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি এই নিবন্ধে। আগেও এসব কথা আমরা নানা জায়গায় উল্লেখ করেছি। তবে এসব কথা চিরদিনের। তাই ফের উচ্চারণ করতে চেষ্টা করেছি এই লেখায়। এদেশের গবেষক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়নে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাই তাঁদের যুক্ত করতে তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। আবার রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি নজরুলের আদর্শেও তিনি ছিলেন অনুপ্রাণিত ও বিমোহিত। বঙ্গবন্ধুর জীবনপ্রবাহে এ দু’জনের প্রভাব ভীষণভাবে লক্ষণীয়। বেগম মুজিব তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কবিগুরুর আসন বঙ্গবন্ধুর অন্তরের অন্তঃস্থলে। রাজনৈতিক জীবনের উত্থানপতন দুঃখ-দৈন্য সর্বমুহূর্তে তাঁকে দেখতাম বিশ্বকবির বাণী আবৃত্তি করতে। ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়’ অথবা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ প্রভৃতি অসংখ্য গানের টুকরো তিনি আবৃত্তি করে যেতেন দুঃখ-দৈন্য-হাতাশায় ভরা অতীতের সেই দিনগুলোতে।’

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘সবসময় মনে হতো তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠের আবেগময় আবৃত্তি যেন তাঁর জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে এক হয়ে মিশে যাচ্ছে’।

…কবিগুরুর সোনার বাংলাকে পবিত্রতায়, স্নিগ্ধতায় অপরূপ করাই বঙ্গবন্ধুর জীবনের পরম প্রার্থনা আর এ জন্যই তিনি নেমেছিলেন সংগ্রামে। আর তাঁকে প্রেরণা যুগিয়েছে কবিগুরুর অমর বাণী। প্রতিবারই জেলে যাবার সময় ‘সঞ্চয়িতা’টা হাতে তুলে নিতেন। কারাগারে নিঃসঙ্গতায় বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র সঙ্গী ছিল ‘সঞ্চয়িতা’। বইটার গায়ে পড়েছিল জেলের সেন্সরের অনেকগুলো সিল’ (দ্র. সংবাদ, ৮ মে ১৯৭২)। বঙ্গবন্ধুর রবীন্দ্রপ্রীতির পরিচয় পাই সেই সময় বাংলা একাডেমি আয়োজিত রবীন্দ্র-জন্মোৎসব পালন অনুষ্ঠানে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘নতুন পরিবেশ ও নতুন চেতনায় এবার স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম রবীন্দ্র-জন্মোৎসব পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ ও অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু সত্য, শ্রেয়, ন্যায় ও স্বাজাত্যের যে- চেতনা বাঙালি কবিগুরুর কাছ থেকে লাভ করেছেন আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে তারও অবদান অনেকখানি। বাঙালির সংগ্রাম আজ সার্থক হয়েছে। বাঙালির রবীন্দ্র-সম্মাননার চেয়ে বড় কোনো দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই’ (দ্র. দৈনিক বাংলা, ৮ মে ১৯৭২)।

দেশ স্বাধীন হবার পর কবি নজরুলকে তাঁর ৭৩তম জন্মবার্ষিকীতে ঢাকায় নিয়ে আসার সমস্ত ব্যবস্থা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি কবি নজরুলকে পত্র লিখেছিলেন এভাবে, ‘মুক্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণ ও আমার পক্ষে আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনার জন্মবার্ষিকীতে আপনার আদর্শে বাংলাদেশকে সিক্ত হতে দিন। আমরা সাগ্রহে আপনার আগমনের প্রতীক্ষা করছি’ (দ্র. সংবাদ, ২১ মে ১৯৭২)। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে কবি ঢাকায় আসলেন। অবিরাম পুষ্পবর্ষণের মাঝে কবি বাংলাদেশে পদার্পণ করলেন। কবি ও বঙ্গবন্ধুর মাঝে এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হলো। বাঙালির এই দুই বিদ্রোহীর মিলনক্ষণটি ইতিহাসের স্বর্ণোজ্জ্বল এক অধ্যায় হিসেবে এরই মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। ‘গণভবন থেকে কাজ সেরে গতকাল বিকেল আড়াইটায় বঙ্গবন্ধু গেলেন তাঁর ধানমণ্ডির বাড়িতে। বাড়ি গিয়ে তিনি বুকশেলফ থেকে বের করলেন কবি নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ‘সঞ্চিতা’। আবেগ আর উচ্ছ্বাস জড়িয়ে আবৃত্তি করলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। তারপর ‘মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেইদিন হব শান্ত’- চরণ দু’টি আবৃত্তি করতে-করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলেন।’ (দ্র. দৈনিক বাংলা, ২৫ মে ১৯৭২)

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটির প্রতি ছিল তাঁর আলাদা আবেগ। এই গানটিকেই যে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করবেন সেটি বহু আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন। গানটিকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে দেবার জন্য তিনি আগ্রহী ছিলেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬-দফা প্রণয়নের পর থেকেই বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। বাঙালি ৬-দফাকে মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করে। এই সময়েই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সনজিদা খাতুনকে দিয়ে কার্জন হলে বিদেশী অতিথিদের সামনে এই গান তিনি গাইয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে জাহিদুর রহিম তাঁর উপস্থিতিতে গেয়েছেন এই গান অসংখ্যবার। আর তাই এই গানই হতে পেরেছে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত।

গবেষক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের সবসময়ই তিনি জাতীয় উন্নয়নে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছেন। আর তাই ৭২ এর ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসার পর তিনি পরিকল্পনা কমিশনে ড. নুরুল ইসলাম, প্রফেসর রেহমান সোবহান, প্রফেসর আনিসুর রহমান, ড. মুশাররফ হোসেনসহ অসংখ্য শিক্ষক, প্রকৌশলী ও পেশাজীবীদের জড়ো করেছিলেন। প্রফেসর কবীর চৌধুরীকে শিক্ষাসচিব নিযুক্ত করেছিলেন। প্রফেসর আনিসুজ্জামানকে সংবিধান রচনায় যুক্ত করেছিলেন। প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী ও ডক্টর এ.আর. মল্লিককে মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন। সাহিত্যিক আবুল ফজলকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করেছিলেন। জয়নুল আবেদিনসহ সকল শিল্পী ও শিক্ষাবিদকে তিনি শিক্ষকতুল্য সম্মান করতেন এবং তাঁদের উপদেশ শুনতেন। বিশেষ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে ছিল এক গভীর সম্পর্ক। নিজেও প্রচুর পড়াশোনা করতেন।

তাঁর সংস্কৃতি-ভাবনার পুরো জমিন জুড়েই ছিল এদেশের দুঃখী মানুষ। তিনি শিল্পী কামরুল হাসানের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন শাশ্বত বাংলার আর্ট ফর্ম কী করে উঠে আসে তাঁর ক্যানভাসে। জয়নুল আবেদিনের পরামর্শ মতো সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য স্থাপনের পরিকল্পনা তাঁর ছিল (দ্র. শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে লেখকের আলাপচারিতা)। সময়ের অভাবে তিনি তা করতে পারেননি। সুযোগ পেলেই শিল্পচার্যের সঙ্গে এদেশের শিল্পকলা নিয়ে কথা বলতেন।

বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার মনসে বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁও-এ ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন’ গঠন করেন। স্বদেশের শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশে ও প্রচারে তিনি উদগ্রীব ছিলেন। নানা কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও আমাদের ঐতিহ্যবাহী শিল্প-সংস্কৃতির জন্য বরাদ্দ ছিল তাঁর বিশেষ সময়। তাই গণভবনকে তিনি বাঙালির গর্বের ভবন করার মানসে শিল্পী রশীদ চৌধুরীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পছন্দের কেউ গেলে তিনি তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তা দেখাতেন।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১-৫ মার্চ বন্ধুরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরকালে সেখানকার নেতৃবৃন্দের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে যান ‘কচি-কাঁচার মেলা’র শিশুদের আঁকা চিত্রকর্ম। তাঁর নান্দনিক চিন্তা শুধু গানে, কবিতায় বা শিল্পকলায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি এদেশের মানুষকে নিয়ে যে-সব স্বপ্ন দেখতেন সে-সবও তাঁর নান্দনিক ভাবনারই অংশ। এদেশের মাটি ও মানুষের কাছ থেকে কোনোদিন তাঁকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাসকে এতো সহজে নিঃশেষ করা যায় না। তাই তো প্রবল পরিক্রমায় ফিরে এসেছে বাঙালির প্রকৃত ইতিহাস। আর ফিরে এসেছেন সেই ইতিহাসের বরপুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কেননা কবি মোহাম্মদ রফিকের ভাষায় “বাঙালির শুদ্ধনাম শেখ মুজিবুর রহমান।” সে কারণেই করোনা সংকট সত্ত্বেও পরম মমতা ও আগ্রহে আমরা পালন করেছি বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী। এখনকার তরুণ প্রজন্ম সহজেই অনুভব করতে পারে যে ‘বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ’। তবে নিজের জন্মদিন নিয়ে খুব একটা উচ্ছ্বাস ছিল না বঙ্গবন্ধুর। তিনি ভাবতেন জীবনটা কেবলই জনগণের জন্য নিবেদিত আর কিছুতেই নয়।

১৭ই মার্চ ১৯৭১ সেই অসহযোগ আন্দোলনের কালে বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিনে বিদেশী সাংবাদিকদের জন্মদিনের শুভেচ্ছা বিনিময়ের উত্তরে তিনি বললেন, “আমি জীবনে কখনও আমার জন্মদিন পালন করিনি। আপনারা আমার দেশের মানুষের অবস্থা জানেন, তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। যখন কেউ ভাবতে পারে না মরার কথা তখনও তারা মরে। … আমার জন্মদিন কী, মৃত্যু দিবসই-বা কী? আমার জীবনই-বা কী? মৃত্যুদিন আর জন্মদিন অতি গৌণভাবে এখানে অতিবাহিত হয়। আমার জনগণই আমার জীবন।” জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জনগণের সাথে তাঁর এই আত্মিক সম্পর্ক অটুট ছিল। আর তাই আজ তিনি নীরবে শুয়ে আছেন তাঁরই প্রিয় জন্মভূমির প্রিয় গ্রামে।

তাঁকে শারীরিকভাবে হারিয়ে কিছুকাল স্বপ্নহীন বেপথু হয়েছিলো বাংলাদেশ। তবে তিনি ঠিকই ছিলেন আমাদের মননে। তাই ফিরে এসেছেন প্রবলভাবে। কবি বাবলু জোয়াদ্দারের ভাষায়‘সেদিন মানুষের স্বপ্ন খুন হয়েছিল/স্বপ্নের লাশ পড়েছিল উদোম আকাশের নীচে। অবশেষে হ্নদয়ের ভাঁজ খুলে মানুষেরা/শবযাত্রার পাতাল ছায়া থেকে বের হয়ে/আজ মানুষ হয়ে উঠেছে/বাঙালিরা আজ মানুষ হয়ে উঠেছে।

লেখক : ড. আতিউর রহমান –  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ