1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

মুক্তিযুদ্ধে নারী যোদ্ধাদের অবদান নিয়ে কিছু কথা

হিরণময়ী দাশ রুনু : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০২৩

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, পাকিস্তানিদের লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে ও মা-বোনদের সম্মান বলিদানের মাধ্যমে আমাদের অর্জন মহান স্বাধীনতা।

১৯৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনের সুখ ও শোকে মেশানো মহান এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি অর্জন করেছে একটি লাল-সবুজের পতাকা। যার প্রতিটি ঘাসফুল, বালুকণা, মাটি-কাদা, গাছ, লতাপাতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত।

১৯৭১-এর মার্চের কথা স্বাধীনবাংলার মানুষ কোনো দিন ভুলবে না। ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদানের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। রক্তপিপাসু পাকিস্তানি হানাদাররা ২৫ মার্চের রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঘুমন্ত নিরীহ-নিরপরাধ শান্তিপ্রিয় বাঙালি নর-নারীর ওপর।

একাত্তরের মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। গোটা জাতি তখন ঐক্যবদ্ধ। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় জনতা উত্তাল, অসহযোগ আন্দোলন সভা-মিছিলে সমবেত হয়ে পাকিস্তানি সরকারের প্রতি অনাস্থা ও ঘৃণা প্রকাশ করে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও গণহত্যার পর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের ২৫ মার্চ প্রতিদিনের মতো ঢাকায় নেমেছিল ছোট-বড় অনেক গণমিছিল, গণসংগীতের আসর বসেছিল, মহল্লায় মহল্লায় চলছিল আসন্ন স্বাধীনতাসংগ্রামের মহড়া, কুচকাওয়াজ। ওই মহড়ায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একটা বিরাট অংশে ছিল সাধারণ মানুষ। তারা কেউ ভাবতেও পারেননি কয়েক ঘণ্টা পরই বর্বর হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে তাদের ওপর। জ্বালিয়ে দেবে সর্বস্ব। আর ওই প্রজ্বলিত শিখাই হবে এ দেশের স্বাধীনতার শিখা।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ বাঙালি নর-নারীর ওপর। রাতের নিস্তব্ধ ঢাকায় চতুর্দিক থেকেই পাকিস্তানি হায়েনার দল সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে এক নিষ্ঠুর পৈশাচিক প্রতিহিংসায় মেতে উঠেছিল। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের অবসান হয়ে উদিত হলো ২৬ মার্চের সকালের সূর্য। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো নতুন করে পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডব। স্বাধীনতাসংগ্রামে পুরুষের পাশাপাশি বাংলার বহু নারীও অংশগ্রহণ করেছিলেন। নারীরা একদিকে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, পাশাপাশি জনমত গঠন, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দান, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা, মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ, আহতদের সেবাদানসহ, খবরাখবর আদান-প্রদানের কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলার ঘরে ঘরে মেয়েরা হয়তো প্রত্যক্ষভাবে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি, কিন্তু পরোক্ষভাবে অনেকেই অংশগ্রহণ করেছেন। অনেকে এ সময় নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েও, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করেছেন।

একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিলগ্নে অংশগ্রহণ করেন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে, ছাত্র-ছাত্রী। পথে-ঘাটে-মাঠে জনগণকে বোঝানো হয় স্বাধীনতাযুদ্ধের কথা এবং শত্রুর মোকাবেলা করতে এ যুদ্ধে সবাইকে অংশ নিতে হবে।

আমি তখন বরিশালের গৌরনদী কলেজের ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছাত্র ইউনিয়নের একজন কর্মী হিসেবে কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করছিলাম। কলেজ ছুটি হয়ে যাওয়ায় আমি নিজের গ্রামের বাড়ি ধামুরা চলে আসি। তরুণ বয়স, সব কিছুতে ছিল একটা জানা-বোঝার আগ্রহ। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে তাদের এ দেশীয় দোসরদের দৌরাত্ম্য প্রকটভাবে বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন গ্রামের হাজার হাজার মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে, ঘরবাড়ি ফেলে মানসম্মান ও জীবন বাঁচাতে হেঁটে ভারতের উদ্দেশে যেতে শুরু করে।

আমাদের বাড়িতে তখন আত্মীয়-অনাত্মীয় ও আশপাশের গ্রামের ৮-১০টি পরিবারের লোকজনসহ প্রায় ৪৫-৫০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। বাড়িতে এত মানুষের মানসম্মান রক্ষা করা ও তাদের নিরাপত্তার চিন্তায় মা-বাবা খুব চিন্তিত থাকতেন। এমন পরিস্থিতিতে মা-বাবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এপ্রিলের মাঝামাঝি গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি ও স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা, তাঁদের ছেলেমেয়ে, স্ত্রীসহ ৩৫ জনের দলে আমি ও আমার দুই ছোট ভাইকে নিয়ে হেঁটে, কখনো হাঁটু কাদাজলে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা দিলাম। সারা দিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, রাতে কারো বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে, কোনো দিন স্কুলের ছাদে রাত কাটিয়ে ১১ দিনে ভারতের সীমান্তে পৌঁছলাম।

যাওয়ার পথে মধুমতী নদী পার হতে গিয়ে আমাদের নৌকা মাঝনদীতে ডুবে গেলে নৌকার যাত্রীদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ জনের মৃত্যু হয়, কিন্তু আমরা তিন ভাই-বোন ও আমাদের দলের বাকিরা বেঁচে যাই। এত বেদনার মধ্যেও সেদিন আমার কাছে এ স্মৃতি ছিল আনন্দের। চলার পথে ৭০ বছরের বৃদ্ধ মাকে নিজেদের জীবন বাঁচাতে রাস্তার পাশে হাঁটু কাদাজলের মধ্যে ফেলে যাওয়ায় বৃদ্ধার আর্তচিৎকার ও অভিশাপ দিতে থাকা এ হৃদয়বিদারক ঘটনা আমাকে এবং পথচারীদের ক্ষণিকের জন্য হলেও কাঁদিয়েছে। চলতে চলতে পথে হাঁটু কাদাজলের মধ্যে এক মা তাঁর সন্তান প্রসব করেছেন, সেই দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না! ১১ দিনের পথচলার এসব স্মৃতি এখনো আমাকে ব্যথিত করে, পীড়া দেয়, সেই একাত্তরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সে যা-ই হোক, ১১ দিন পর আমরা ভারতের সীমান্তে পৌঁছে, ভ্যাকসিন-টিকা নিয়ে শরণার্থী ক্যাম্পে তাঁবুর ঘরে আশ্রয় নিলাম।

ভারতে পৌঁছার কয়েক দিন পর আমি বশিরহাটের টাকি মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে থেকে ৯ নম্বর সেক্টরে মেজর জলিলের অধীনে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র ট্রেনিং গ্রহণ করি। ট্রেনিংয়ে আমাদের ছোট-বড় সব ধরনের অস্ত্র চালানো, বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরকের ব্যবহার, এসএমজি, শর্ট মেশিনগান, এসএলআর, হ্যান্ড গ্রেনেড চালানো এবং গেরিলা পদ্ধতিতে ট্রেনিং দিয়েছেন সুবেদার মাজেদুল হক। ট্রেনিংয়ে সারা দিনের পরিশ্রমের পরও তরুণ বয়সে এ ছিল আমার কাছে অন্য রকম অভিজ্ঞতা। মাঝেমধ্যে নৌকায় চেপে আমরা দেবাহাট যেতাম। সঙ্গে থাকত গ্রেনেড।

সারা দিন কাটত আর্মস ট্রেনিংয়ে। দুপুরে একটু খাওয়ার সময় পেতাম। বর্ডার এলাকায় আমাদের ক্যাম্প, সারা রাত মর্টারের শব্দ। প্রথম প্রথম খুব ভয় লাগত। মাঝে মাঝে টাকি ও ইছামতী নদীর পারে গিয়ে ওপারের বাংলাদেশ দেখতাম। ট্রেনিংয়ে আমার সঙ্গে বাহিনীপ্রধান রমা দাশ, বিথীকা বিশ্বাস, কল্পনা, মিনতি, শোভাসহ মোট ১৮ জন মেয়ে ছিল।

জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড, লেট দেয়ার বি লাইট ও নাইন মান্থস টু ফ্রিডম ডকুমেন্টারিতে আমার ট্রেনিংকালীন ছবি রয়েছে। শ্রদ্ধেয় পরিচালক জহির রায়হান কিছু দৃশ্যে শুটিং করার জন্য আমাকে নির্বাচন করেন। বিষয়টি আমার টিম লিডার, কমান্ডারকে জানালে তিনি আমাকে এ জন্য সম্মতি প্রদান করেন। পরের দিন সকালে আমার কমান্ডার, টিম লিডার ও আমি বশিরহাটের উদ্দেশে রওনা হই। ওখানে পৌঁছে এত নোংরা-আবর্জনার মধ্যে শুটিংয়ে আমি প্রথমে অসম্মতি জানাই। আমার টিম লিডার এবং কমান্ডার আমাকে বুঝিয়ে রাজি করান। তারপর দিনব্যাপী আমার শত শত ছবি তাঁর ক্যামেরায় ধরা পড়ে। স্বাধীনতার অনেক পরে আমি জানতে পেরেছি আমার এই ছবিগুলো ‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম’ ডকুমেন্টারিতে রয়েছে।

দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ডিসেম্বর মাসে বিজয় অর্জিত হয়। মুক্তিবাহিনী একের পর এক এমনভাবে আক্রমণ শুরু করে যে নিরুপায় হয়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। দেশ হয় শত্রুমুক্ত। প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির লাল-সবুজের পতাকাখচিত কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলাদেশ।

লেখক: হিরণময়ী দাশ রুনু – বীর মুক্তিযোদ্ধা, নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত পরিচালক প্রশাসন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ