1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন কেএনএফ এর লক্ষ্য কী?

বিশেষ প্রতিবেদক : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৩

স্বাধীনতার পর থেকে দেশি-বিদেশি ইন্ধনে অশান্ত হতে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রাম। বিশেষত ১৯৭৬ সাল থেকে কখনো নিজেদের একক অধিকারের নামে, কখনো স্বায়ত্বশাসনের নামে, আবার কখনো পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানিয়ে শুরু হয় সশস্ত্র তৎপরতা। এ পর্যন্ত শুধুমাত্র পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনগুলোর আধিপত্যের লড়াইয়ে নিহত হয়েছে হাজারেরও বেশি মানুষ। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২ যুগ পার হলেও পাহাড়ে এখনও বন্ধ হয়নি অস্ত্রের ঝনঝানি আর হানাহানি। মাদক বাণিজ্য, অস্ত্র ব্যবসা ছাড়াও পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনের ক্যাডারদের চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য ও সন্ত্রাসের কাছে এক প্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছে স্থানীয় জনগোষ্ঠী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড়ি জনগণের কাছে আতঙ্কের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট সংক্ষেপে ‘কেএনএফ’। রাঙ্গামাটির সাজেকের বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বান্দরবানের উপকণ্ঠ থেকে চিম্বুক পাহাড়ের ম্রো অঞ্চল হয়ে রুমা রোয়াংছড়ি, থানছি, লামা ও আলীকদম— এই ৯টি উপজেলা নিয়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের নামে সন্ত্রাসী ও দেশবিরোধী অপতৎপরতা চালাচ্ছে কেএনএফ।

কেএনএফ কি এবং কাদের স্বার্থে কাজ করছে?

পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি, চিন, বম, মিজো সহ প্রায় ৮২টি গোত্র রয়েছে। পাহাড়ে বসবাসরত কুকি চিনভুক্ত জনগোষ্ঠীর পআঙ্খউয়আ, লুসাই, গুণী, ম্রো, খিয়াং নামের ছয়টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কিছু সদস্য মিলে কেএনএফ গঠিত হয়। তাদের মোট জনসংখ্যা মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার হলেও কেএনএফ পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানিয়ে আসছে।

চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে বার্মিজ ও ভারতীয় জাতিভুক্ত এবং বহিরাগত মনে করে কেএনএফ। জেএসএস মূল, ইউপিডিএফ মূল, জেএসএস সংস্কার, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক ও মগ পার্টি সহ কয়েকটি স্থানীয় সংগঠনের প্রতি তারা বৈরী মনোভাব পোষণ করে এবং তাদের আধিপত্যের লড়াইয়ে পাহাড়ে রক্ত ঝরে নিয়মিতভাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেএসএস (জনসংহতি সমিতি) ও ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট)-এর বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী থাকলেও কেএনএফের মতো সশস্ত্র গ্রুপের ঘোষণা দিতে দেখা যায় না।

নাথান বম:

কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। জেএসএসের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিপিসি) এর ঢাকা মহানগর শাখা ও কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। কুকি চিন জাতীয় ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি এনজিও’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও তিনি। এছাড়া কুকি চিনভুক্ত জাতি গোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ সহ ছয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে তার। বম সম্প্রদায় থেকে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রে সাড়া না পেয়ে, বিশেষত নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর সন্ত্রাসের পথ বেছে নেন। মাদক, অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি, হত্যা ও অপহরণ সহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পর আইশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে গা ঢাকা দেয় নাথান বম।

জঙ্গি সংগঠন জামায়তুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার অন্যতম সদস্য শামীন মাহফুজের সঙ্গে নাথান বমের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ ও থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে অর্থ গ্রহণের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

কেএনএফ প্রতিষ্ঠা ও লক্ষ্য:

২০০৮ সালে কেএনএফ-এর প্রতিষ্ঠার পর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন ও ভারতের মনিপুর ও বার্মার ‘চীন রাজ্যের’ সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্যেই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। এ সময় এর নাম ছিল কুকি চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স – কেএনভি। ২০১৬ সালে সংগঠনটির সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি করা হয় এবং ভারতের মনিপুর, বার্মার কারেন ও কাচিন রাজ্যে গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করে। বর্তমানে এর সশস্ত্র শাখার নাম কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। ২০১৯ সাল থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা ভয়ংকর সব স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শুরু করে সন্ত্রাসী তৎপরতা। সশস্ত্র শাখা ছাড়াও কুকি চিন জাতীয় ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামের এনজিও’র আড়ালে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নাম ব্যবহার করে অর্থ ও সদস্য সংগ্রহ করেছেন কার্যক্রম পরিচালনা করে।

যেভাবে পরিচালিত হয় কেএনএফ:

এই সংগঠনের প্রায় চার হাজার সদস্য রয়েছে যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিজোরামে অবস্থান করছে। কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ তিন মাস। এর মধ্যে এক মাস মিজোরামে তাত্ত্বিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাকি দুই মাস মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের সঙ্গে যৌথভাবে মিয়ানমার আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ে তাদের আস্তানা রয়েছে। বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার কেওক্রাডং পর্বতের কাছাকাছি এলাকায় তাদের গোপন আস্তানা থাকলেও বেশিরভাগ সদস্য বর্তমানে সাদা পোশাকে ছদ্মবেশে কেন্দ্রীয় নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে।

যে কারণে প্রশ্নবিদ্ধ কেএনএফ এর কার্যক্রম:

১. শুধুমাত্র কুকি-চিন জনগোষ্ঠী কেন্দ্রিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি হাস্যকর ও বাস্তবতা বিবর্জিত। কেএনএফ পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানালেও কুকি-চিন বহির্ভূত নৃগোষ্ঠীগুলোর প্রতি তাদের চরম বৈরি মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। কেএনএফ প্রধান জয়ী হওয়ার জন্য ২০১৮ এর নির্বাচনে প্রার্থী হন নি, কারণ তিনি নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করেছিলেন বম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে। উগ্র জাতীয়তাবাদী দাবি জানিয়ে সদস্য সংগ্রহ করাই তার লক্ষ্য ছিল।

২. পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের নামে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও ইতোপূর্বে তাদের নিয়মতান্ত্রিক কোনো কার্যক্রম দেখা যায় নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর এ যাবত কোনো ধরণের দাবি জানানোর নজির তাদের নেই। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, কেন বা কোন যুক্তিতে তারা সন্ত্রাসবাদের পথ বেছে নিয়েছে?

৩. কেএনএফ এর হত্যা, চাঁদাবাজি ও অপহরণের শিকার ব্যক্তিরা সাধারণ জনগণ। কেএনএফ এর সন্ত্রাসী তৎপরতার শিকার সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মহৎ হলে ঠিকাদার, কোনো প্রকল্পের কর্মি বা ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে অপহরণ ও হত্যা করা হতো না।

৪. উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর কাছেই কেএনএফ এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। অন্যদিকে বেশিরভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণ কেএনএফ প্রধানকে জাতিবিদ্বেষী খলনায়ক হিসেবে গণ্য করে। এছাড়া কেএনএফ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ও কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সকলের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদকসেবন ও ধর্ষণ সহ‌ নানা সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগ রয়েছে। উগ্র জাতীয়তাবাদী মানসিকতার সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ছাড়া বিবেক ও নৈতিকতা সম্পন্ন কারো পক্ষে এ সংগঠনকে সমর্থন করা সম্ভব নয়।

২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ট্রাই জংশনের কাছাকাছি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছে কেনএফের ৬ সদস্য ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে আটক হয়। আটককৃত আসামিদের কাছ থেকে কোকি চিন ন্যাশনাল আর্মির সভাপতি এবং চিফ অব স্টাফের সিল মোহরসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়। পরবর্তী আইএস ও আল কায়েদা সহ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয় সামনে আসে। এছাড়া ভারতের মিজোরাম এবং মিয়ানমার থেকে তাদের কাছে আসা অস্ত্র বিভিন্ন জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কাছে চড়া দামে বিক্রি করার বেশ কয়েকটি প্রমাণও পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

৫. কেএনএফ এর অন্যতম প্রধান অভিযোগ তারা মুসলমানদের দ্বারা লাঞ্ছিত। মূলত খ্রিস্টান ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের কার্যক্রম প্রণীত হয়। কিন্তু অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণকারী এই সংগঠনের সঙ্গে আইএস, আল-কায়েদা সহ কয়ৈকটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। জামায়তুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে একটি জঙ্গি সংগঠনকে সহযোগিতা করা লিখিত চুক্তি করেছে কেএনএফ। জঙ্গিদের কাছে অস্ত্র বিক্রি, জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ এবং থাকা খাওয়া বাবদ প্রতি মাসে বড় অংকের টাকা গ্রহণ করে কেএনএফ।

কেএনএফের ক্যাম্পে এ পর্যন্ত তিন ব্যাচে জামাতুল আনসারের ৫৫ জন প্রশিক্ষণ নেন। তাঁদের প্রশিক্ষণ তত্ত্বাবধানে ছিলেন কেএনএফের প্রধান নাথান বম এর সামরিক কমান্ডার কথিত ব্রিগেডিয়ার ভাংচুং লিয়ান বম, মিডিয়া শাখাপ্রধান কথিত লে. কর্নেল লালজং মুই মাওয়াইয়া ও কথিত লে. কর্নেল লাল মুন ঠিয়াল চির চির ময় সহ প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে কয়েকজন ইতিমধ্যে র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন।

কেএনএফের কাছ থেকে জামাতুল আনসার বেশকিছু অস্ত্র কিনেছে যার যার অস্ত্রের গায়ে সাংকেতিক নম্বর বা চিহ্ন দেওয়া আছে। জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের ভিডিওতেও সেটা দেখা গেছে। এছাড়া পাহাড়ের আস্তানায় কেএনএফ ও জামাতুল আনসারের জঙ্গিদের একসঙ্গে থাকা ও খাওয়া-দাওয়া করার ভিডিও চিত্রও পাওয়া গেছে। এছাড়া কেএনএফের সঙ্গে তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জামাতুল আনসারের লড়াই করার সমঝোতাও হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশ-ভারত-মায়ানমার এর সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রায় ৭৬টি সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী বা জঙ্গি সংগঠন রয়েছে যাদের বেশিরভাগই মাদক ব্যবসা এবং অস্ত্র চোরাচালান ও অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কেএনএফ এর বিচরণ ছিল খুবই স্বল্প পরিসরে বিস্তৃত। মূলত অপহরণ ও চাঁদাবাজি কেন্দ্রিক কার্যক্রমের কারণে তারা অল্প সময়ের মধ্যে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানেও তাদের কার্যক্রম অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা কেন্দ্রিক যা কুকি-চিন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আবেগকে পুঁজি করে গুটিকয়েক ব্যক্তির অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রকল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই সন্ত্রাসী অপতৎপরতার প্রতিশব্দে রূপ নেয়া কেএনএফ এর বিরুদ্ধে আইনানুগ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াও জনসচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ