২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে কেন্দ্র করে তিনদিন ধরে দেশজুড়ে তাণ্ডব চালায় এই ধর্মব্যবসায়ীরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার থানা ও হাসপাতালে ভাংচুর এবং সরকারি অফিসে অগ্নিসংযোগ করেছে। এমনকি শুক্রবার জুমার নামাজকে কেন্দ্র করে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসায় উগ্রবাদী স্লোগান দিয়েছে। তাদের লক্ষ্য ছিল, নামাজে আসা মুসল্লিদের হুট করে উত্তেজিত করে, দেশবিরোধী নাশকতায় লিপ্ত হওয়া। অথচ ২০১৫ সালেও নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর করেছেন। তখন এই ধর্মব্যবসায়ীরা ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে মোদিকে ব্যবহার করার আশায়, লাইন ধরে দাঁড়িয়ে দেখা করেছে তার সঙ্গে; পত্রিকায় প্রেস রিলিজ পাঠিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে মোদিকে, নিজেদের পার্টি অফিসে মিষ্টি পর্যন্ত বিতরণ করেছে।
মূলত ,পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর অর্থায়নে, বিএনপি-জামায়াতের জন্য ক্ষমতার ক্ষেত্র তৈরির উদ্দেশ্যে এই অরাজকতা চালানো হচ্ছে। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের ব্যানার ব্যবহার করে মাদ্রাসার হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের নিয়ে সাধারণ মানুষকে ‘কাফের’ উপাধি দিয়ে প্রকাশ্যে স্লোগান দিতে দেখা গেছে এদের। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাদ্রাসার সামনে ‘কাফের’ ‘কাফের’ স্লোগানে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েন স্থানীয়রা। বেশ কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, এসব কর্মসূচিতে না গেলে তাদের খাবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশের নিম্নবিত্ত মানুষের সন্তানদের খাবার বন্ধের ভয় দেখিয়েও এসব ইসলামবিরোধী কাজে জড়াতে বাধ্য করছেন ধর্মব্যবসায়ীরা। দেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এসব তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে।
 
এই তো দুই মাস আগেও, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করেও দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এই উগ্রবাদীরা। তখন তাদের জ্বালাও-পোড়াও নাশকতার বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছে, তাদের মুরতাদ (ইসলামচ্যুত) বলে অভিহিত করেছে। জনজীবনে রক্তপাত ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর পাশাপাশি, দেশের ইতিহাস বিকৃত করে, অনলাইনেও উস্কানি ছড়াচ্ছে এরা। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশের সরলপ্রাণ মানুষদের ধর্মীয় আবেগ নিয়ে নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে ধর্মব্যবসায়ী চক্রটি। তাদের মূল লক্ষ্য ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, সাধাররণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা। এরপর বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের মতো এক ধ্বংসক্ষেত্রে পরিণত করা। এর আগে, হেফাজতের আমির আহমদ শফির মৃত্যুর পর তার জানাজার সময় সংগঠনটি দখলে নেয় জামায়াত নেতারা। বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক দল খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মামুনুল হককে দেওয়া হয় হেফাজতের যুগ্মমহাসচিব ও মুখপাত্রের দায়িত্ব। একইসঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর এজেন্ট বাবু নগরীকে হেফাজতের সভাপতি করে বিতর্কিত ও খণ্ডিত কমিটি ঘোষণা করা হয়। অবশ্য হেফাজতের আলেমদের অংশটি এই কমিটিতে বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ট কমিটি হিসেবে ঘোষণা করে এবং তাদের নেতৃত্ব মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তারা জানায়- হেফাজতের দখল নেওয়ার জন্য আহমদ শফিকে কৌশলে হত্যার করেছে বাবুনগরী-মামুনুল হকরা, এমনি বাবুনগরী বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার কাছ থেকে যে ৫০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন, তারো কোনো হিসাব তিনি সংগঠনকে দেননি।
যাই হোক, হেফাজতকে মোটা অর্থ দিয়ে নাশকতার জন্য সামনে রেখে মাঠে যেমন অরাজকতার সৃষ্টি করছে বিএনপি-জামায়াত,তেমনি অনলাইনেও তীব্রভাবে সক্রিয় এরা। জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক-ইউটিউবে হাজির হয়ে যেমন গুজব ও ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা করছে এই উগ্রবাদী ধর্মব্যবসায়ীরা, সমান্তরালে বাংলাদেশকে অস্থির করে তুলতে অনলাইনের ডার্কওয়েবেও সক্রিয় হয়েছে আইএস-জঙ্গিরা। সম্প্রতি ডার্কওয়েব ব্যবহার করে জঙ্গিবাদী তৎপরতা বাড়ছে। আরবি ভাষার গান, আকর্ষণীয় মিউজিক, সঙ্গে যুদ্ধের দামামামাখা কণ্ঠস্বর: যেনো ইরানি বা হলিউডি কোনো ফিল্মের শুরু হচ্ছে, ঠিক এভাবেই দর্শক-স্রোতাদের মনে ঘোর সৃষ্টি করা হচ্ছে। এরপর উত্তিজিত কণ্ঠে যুদ্ধের জন্য ডাক দেওয়া হচ্ছে তরুণদের। তারা বলছে, বাংলাদেশ এখনো স্বাধীন হয়নি। তাই সবাইকে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে। এই দেশকে স্বাধীন করতে হবে। খেলাফত কায়েম করতে হবে।
মাঠে যেমন আপামর জনতাকে মুরতাদ ও কাফের ঘোষণা করে জাহান্নামী হিসেবে অভিহিত করছে হেফাজতিরা, তেমনি ডার্কওয়েবেও জান্নাতের টিকিট দিচ্ছে আইএস-জঙ্গিরা। এরা বলছে- যারা তাদের সৈন্য হিসেবে লড়বে, শুধু তাদের জন্যই জান্নাত অপেক্ষা করছে। এই জঙ্গিদের দাবি, যারা তাদের সঙ্গে থাকবে না, তারা সবাই ইসলামচ্যুত। তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও রণপ্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হতে তরুণদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে এরা।
 
ডার্কওয়েবের এসব ফুটেজের মাধ্যমে নিয়মিত নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে আইএস-জঙ্গিরা। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া, এমনকি হাতিয়ার-অস্ত্রপাতি, সবখানেই নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার আদেশ দেওয়া হচ্ছে। ফেসবুক-ইউটিউব ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে প্ররোচিত করার গাইডলাইন দেওয়া হচ্ছে সব অডিও-ভিজ্যুয়ালে। তারা বলছে, উগ্রবাদী তৎপরতা ভালোভাবে চালানোর জন্য প্রশিক্ষণ-শিবির গড়ে তুলতে।
এদিকে হেফাজতে ইসলামের যুগ্মমহাসচিব ও খেলাফত মজলিসের মহাসচিব, তথাকথিত মওলানা মামুনুল হক দাম্ভিকভাবে দেশের সব মসজিদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ২ এপ্রিল তিনি প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলেছেন, সোশ্যাল মিডিয়া ও দেশের সব মসজিদ এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। তারা সোশ্যাল মিডিয়া দিয়েই তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করবে। এমনকি সবসময়ের মতো ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ফতোয়া দিয়ে তিনি বলেন আরো বলেন, যারা হেফাজতে ইসলামকে মানবে না, তারা ইসলামকে মানলো না। তারা ইসলামচ্যুত।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডবের পর হেফাজতের নেতারা মানুষকে নতুন স্টাইলে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করেছে। তারা মানুষের মৃত্যুকে নিয়েও হুমকি দিচ্ছে। সরলপ্রাণ মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে তারা হুমকি দিয়ে বলছে- তাদের সাথে না থাকলে, তারা মানুষের জানাজা পড়াবে না! কতো নিচু ও নৃশংস হলে এভাবে ধর্মকে বিকৃত করা যায়। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ায় আইএস-জঙ্গিরা যেভাবে তাদের কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটিয়েছিল, ঠিক সেই পথেই এগুচ্ছে এই জঙ্গি চক্র। এখনই সামাজিকভাবে এদের প্রতিরোধ করা না গেলে, আগামী দিনে কোনো সাধারণ মানুষই আর নিজের ঘরে কিংবা নিজের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও নিরাপদে বাঁচতে পারবে না।