ঈদ ও বাংলা নববর্ষের টানা ছুটিতে বিনোদনকেন্দ্রগুলো পর্যটকের পদচারণয় মুখর। হাসি ফুটেছে পর্যটকসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মুখে। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের।
কক্সবাজার
ঈদুল ফিতরের দিন থেকে দর্শনার্থীদের পদচারণায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে পর্যটননগরী কক্সবাজার। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর হাসি ফুটেছে হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীদের মুখে। পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানান, পুরো রমজান মাস কক্সবাজার পর্যটকশূন্য ছিল। দর্শনার্থীর সেই খরা কেটেছে। ঈদের দিন থেকে ঢল নামে ভ্রমণপিপাসুর। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রবিবার পর্যন্ত সমুদ্রসৈকতের কলাতলী, সুগন্ধা ও লাবণি পয়েন্টে পর্যটক নামতে শুরু করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়তে থাকে।
সকাল থেকে কলাতলী থেকে লাবণি পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সমুদ্রসৈকতে অন্তত ৫০ হাজার দর্শনার্থী নামেন বলে জানিয়েছেন সৈকতে দায়িত্বরত কর্মীরা। বিকেলে সৈকত ঘুরে দেখা গেছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ সাগরের নোনাজলে গোসলে নেমেছেন। কেউ সৈকতে ঘোড়ায় চড়ে সমুদ্র দর্শন করছেন, কেউ আবার ওয়াটার বাইক ও বিচ বাইকে সৈকত দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার কেউ কিটকটে (চেয়ার-ছাতা) গা এলিয়ে দিগন্ত ছোঁয়া নীলজলরাশিতে মজে আছেন। কেউ কেউ বালুচরে দাঁড়িয়ে প্রিয়জনদের এসব আনন্দঘন মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করে রাখছেন।
চট্টগ্রামের মোহাম্মদ মিয়া সাগরে নেমেছেন স্ত্রী ও স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে। কোমর সমান পানিতে ভাসছেন টিউবে। আধা ঘণ্টা পর বালুচরে উঠে বসেন চেয়ার-ছাতা কিটকটে। সৈকতে দায়িত্বরত বিচকর্মী সৈয়দ নুর বলেন, ঈদের দিন থেকে স্থানীয়দের পাশাপাশি পর্যটকরা কক্সবাজারমুখী হয়েছেন। শুধু ঈদের দিনেই অন্তত ৫০ হাজার পর্যটক সৈকতে নেমেছেন।
কুয়াকাটা
টানা ছুটিতে কুয়াকাটায় ছিল পর্যটকের উপচেপড়া ভিড়। ঈদের দিন বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই পর্যটকের ভিড় বাড়তে থাকে। শুক্রবার দুপুরে গোটা সৈকত কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। সাগরের নোনাজলে গোসলে মত্ত হয়ে পড়েন হাজার হাজার পর্যটক। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি জিরো পয়েন্টের এক কিলোমিটার এলাকায় এমন দৃশ্য দেখা যায়। আগতরা ঘুরেছেন সৌন্দর্যম-িত স্পটগুলোতে। দীর্ঘ একমাস পরে কুয়াকাটায় পর্যটকের উপচেপড়া ভিড়ে হোটেল মোটেলসহ ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি ফোটে।
তারা আগে থেকেই ব্যবসায়িক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ঈদ-নববর্ষের টানা ছুটিতে হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরা চুটিয়ে ব্যবসা করেছেন। তবে খাবার হোটেলে গলাকাটা দাম রাখার এন্তার অভিযোগ রয়েছে। এখানে প্রশাসনের কোনো তদারকি ছিল না। এবারে স্থানীয় পর্যায়ের দর্শনার্থী ছিল চোখে পড়ার মতো। হোটেলে অবস্থান না নিয়ে এরা রিজার্ভ করা যানবাহনে সকালে কুয়াকাটায় পৌঁছে আবার সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য অবলোকন করে গন্তব্যে ফিরেছেন। হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ জানান, তাদের দেড় শতাধিক হোটেলের ৮০ শতাংশ কক্ষ আগাম বুকিং ছিল। ঈদে দুই দিন টোটাল বুকড হয়ে যায়।
নারায়ণগঞ্জ
নারায়ণগঞ্জে ঈদের ছুটিতে বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে এসেছেন বিনোদন প্রিয়াসী হাজারো মানুষ। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী লোকজন ঈদুল-ফিতরের দিন থেকে বিনোদনকেন্দ্রগুলোয় ভিড় করছেন। প্রতিটি বিনোদনকেন্দ্রে উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের বিনোদন প্রিয়াসী লোকজন নারায়ণগঞ্জের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ছুটে এসেছেন। এছাড়াও শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ও ¯িপডবোর্টে চড়েও আনন্দ উপভোগ করেছেন শত শত মানুষজন।
সোনারগাঁয়ের লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে নাগরদোলা ও চরকায় চড়া, বায়োস্কোপ এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য, লোকশিল্প ও সংস্কৃতির অনন্য উপাদান অবলোকনসহ নানার ধরনের হস্তচালিত খেলনায় চড়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করেছেন বিনোদন প্রিয়াসী লোকজন। ঈদের দিন থেকে শুরু করে ঈদের পঞ্চম দিন সোমবারও নানা বয়সী লোকজন ছুটে আসেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে।
এ ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ নগরীর খানপুর, সোনারগাঁও, বন্দরের সাবদি, হাজরাদি, ফতুল্লার পঞ্চবটি ও রূপগঞ্জের জিন্দাপার্ক ও রাসেল পার্কসহ বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে দর্শনার্থীদের উপপেড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। ঈদুল- ফিতরের ছুটিতে আনন্দ উপভোগ করতে অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে।
সোনারগাঁয়ের বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, বাংলার তাজমহল, ঐতিহাসিক পানাম নগরী, নারায়ণগঞ্জ নগরীর খানপুরে বিআইডব্লিউটিএ’র ইকোপার্ক (চৌরঙ্গী পার্ক), ফতুল্লার পঞ্চবটির অ্যাডভেঞ্চারল্যান্ড পার্র্ক, রূপগঞ্জের জিন্দাপার্ক ও রাসেল পার্ক, নগরীর শীতলক্ষ্যা নদীর তীরের ওয়াকওয়ে (হাঁটাচলা রাস্তা)সহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঈদের দিন থেকে সোমবারও দর্শনার্থীর উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। প্রতিটি বিনোদন স্পটই মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
বরিশাল
বরিশাল শহর ও জেলার বাহিরের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ঈদের দিন বিকেল থেকে ভ্রমণ পিপাসু সব বয়সের মানুষের ঢল নামে। যা ছিল ঈদ পরবর্তী আরও দুইদিন। নগরীর প্রধান বিনোদনকেন্দ্র নগরীর কীর্তনখোলা তীরের ত্রিশ গোডাউন, বঙ্গবন্ধু উদ্যান, শিশুপার্ক, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, আমানতগঞ্জ এলাকায় নবনির্মিত শহীদ সুকান্ত বাবু শিশুপার্ক, গ্রিন সিটি শিশুপার্ক, প্লানেট ওয়ার্ল্ড, মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন পার্ক, কালিজিরা ব্রিজ, শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ব্রিজ ও চৌমাথা লেকপাড়সহ সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ তালতলী ও চরবাড়িয়া এলাকার বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণ পিপাসুদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল।
নগরীর বাইরের বিনোদন কেন্দ্রের মধ্যে বাবুগঞ্জের দুর্গাসাগর, গুঠিয়ার নয়নাভিরাম বায়তুল আমান জামে মসজিদ কমপ্লেক্স, গৌরনদীর বাটাজোর এলাকার শাহী ৯৯ পার্ক, ফারিহা গার্ডেন, প্রকৃতিতে ঘেরা পয়সারহাট ব্রিজ, দোয়ারিকা ও শিকারপুর সেতু, লেবুখালী সেতুসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রত্মতাত্বিক স্থাপনাকে ঘিরে বিনোদন প্রিয় মানুষের ভিড় ছিল লক্ষ্যণীয়।
বাগেরহাট
টানা ছুটিতে বাগেরহাটের দু’টি বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ ও সুন্দরবনসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে পর্যটকদের ঢল নামে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা বয়সের পর্যটকরা ৬শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ষাটগম্বুজ মসজিদ ও বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন। করমজল, হারবারিয়া, হিরণ পয়েন্ট, কচিখালী ও দুবলার চরসহ বনের প্রতিটি ভ্রমণ স্পটে ঘুরে আনন্দ উপভোগ করছেন তারা। একইসাথে বলেশ্বর ও ভৈরব নদের বাঁধে পর্যটকদের ঢল নামে। গত বৃহস্পতিবার ঈদের দিন থেকে শনিবার হাজার হাজার হাজার পর্যটক এসব স্থানে এসেছেন।
ঈদুল ফিতর ও নববর্ষের দীর্ঘ ছুটির কারণে আগামী কয়েকদিন পর্যটকের চাপ অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা থেকে সুন্দরবনে ঘুরতে আসা ইসমত আরা বেগম ও আবির আহমেদ বলেন, অনেকদিন থেকে ইচ্ছা ছিল সুন্দরবন ঘুরতে আসব। ঈদ ও নববর্ষ উপলক্ষে মোট ৬ দিনের ছুটি পেয়ে সুন্দরবনে চলে এলাম। এখানে এসে অনেক ভালো লাগছে। বিভিন্ন রকম বন্যপ্রাণী দেখলাম। নিজ হাতে হরিণকে গাছের পাতা খাইয়েছি। কাছ থেকেই বানরের লাফালাফি দেখেছি। সুন্দরবনের এই বন্য পরিবেশ দেখে অনেক ভালো লাগছে।
পর্যটক রাতুল হাসান বলেন, মোংলা থেকে সুন্দরবনের করমজল পয়েন্টে আসা খুবই সহজ। প্রতিবছর ঈদের সময় বন্ধুরা মিলে মোংলা থেকে ট্রলার ভাড়া করে সুন্দরবনে আসি। এবছর মানুষের চাপ একটু বেশি, ফলে ট্রলার ভাড়া নিতে একটু হিমশিম খেতে হয়েছিল। আজ করমজল পয়েন্ট ঘুরেছি, কাল হারবাড়িয়াসহ আরো কিছু স্পট ঘুরব।
অপর পর্যটক মোহাম্মদ সাঈদ বলেন, পরিবারের সঙ্গে সুন্দরবনে এসে ঈদের আনন্দ বহুগুণ বেড়ে গেছে। এর আগে চিড়িয়াখানায় অনেক বন্যপ্রাণী দেখেছি।
অনেক ইচ্ছা ছিল সুন্দরবন এসে খোলা পরিবেশে বন্যপ্রাণী দেখার। ঈদ ও নববর্ষের ছুটি পেয়ে সেই ইচ্ছা পূরণ হলো। গাছ গাছালির ভেতর থেকে হেঁটে বনের আসল পরিবেশ উপভোগ করেছি। কচ্ছপ, কুমির, বানর, হরিণ এবং বিভিন্ন রকমের পাখি দেখে ভালো লাগছে।
সিলেট
সিলেটের হোটেল-মোটেলগুলোতে ঠাঁই নেই। স্বজন, পরিচিতজনদের বাসাবাড়িতে অবস্থান নিয়েছেন অনেকে। জমজমাট এখন সিলেটের পর্যটন স্পটগুলো, যেন বাঁধভাঙা জোয়ার বইছে সর্বত্র। প্রাণ খুলে ঘুরে বেড়ানোর স্বাদই আলাদা। এই অঞ্চলে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মুখে হাসির ঝিলিক। শত কোটি টাকার ব্যবসার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। ঈদের আগে থেকেই পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় পর্যটন খাতের আশানুরূপ ব্যবসায়িক উন্নয়নের বিষয়টি আঁচ করা যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলেছিলেন- পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় থাকবে। ঈদের দিন থেকে সিলেটে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক সিলেটের জাফলং, সাদাপাথর, বিছনাকান্দি, রাতারগুল, পান্থমাইসহ চা-বাগানগুলোতে ভিড় করছেন।
রাঙ্গামাটি
প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য রাঙ্গামাটিতে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় পরিলক্ষিত হয়েছে। পাহাড়ি এই জনপদ এক এক মৌসুমে এক এক রূপ ধারণ করে। এই রূপ অলোকন করাও হ্রদ-পাহাড় আর মেঘ মিতালীর দেখার জন্য ঈদের পরদিন থেকে ছয় দিনব্যাপী রাঙ্গামাটিতে পর্যটকের ঢল নেমেছে।
হোটেল-মোটেল ও সরকারি বিশ্রামাগারগুলোতে ঠাঁই নেই। দেশের একমাত্র বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রিজ, পলওয়েল পার্ক, আরন্যাক এলাকায় পর্যটকদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। শহরের পর্যটন স্পটগুলো এখন পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। পর্যটকের আগমনে প্রতিদিনই রাঙ্গামাটির অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।