1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

হেফাজত : কে আসল কে নকল?

সম্রাট দেব চৌধুরী : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ৩ মে, ২০২১

রাজনীতিতে দুটো কথা খুব জনপ্রিয় ও জরুরি। একটি হলো চিরস্থায়ী শক্র মিত্র নেই। অন্যটি হলো ছদ্মবেশ। মানে কৌশলগত অবস্থান নিতে হয়। বর্তমান সময়ে দেশীয় রাজনীতির মোটামুটি আলোচিত একটি ইস্যু হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের আকষ্মিক ভাবে নিজেদের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্তকরণ। বিষয়টি নিয়ে নানা জনে নানা ভাবে ভাবছেন। এছাড়াও যেকোনো রাজনৈতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন পক্ষ চেষ্টা করে ঘটনাটিকে একটি নিজস্ব এজেন্ডার ছাঁচে ব্যাখ্যা করে একটি জনপ্রিয় জনমত গড়ে তোলার। এ ক্ষেত্রেও এমন চেষ্টা হয়েছে। সব মিলে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে মোটামুটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে দুইটি মতামত।
যেমন, হেফাজতে ইসলাম মূলত গা ঢাকা দেওয়ার এবং মোদীবিরোধি আন্দোলনের নামে করা সহিংসতার কারণে হওয়া মামলাগুলি এড়ানোর উদ্দেশ্যে তাদের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দিয়েছে। তারা অন্য নামে আসার চেষ্টাও করতে পারে। (এটা মূলত সরকার সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে)
এবং, ভাস্কর্যবিরোধী অবস্থান ব্যক্ত করা এই কমিটিকে সরকার টিকতে দিবে না, এবং সেই লক্ষ্যে নানা দমনপীড়ন চালাবে বলে অনুধাবন করতে পেরে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া হেফাজতে ইসলাম বাধ্য হয়েছে এই কমিটি ভেঙে দিতে। (এটা খুব সম্ভবত জামায়াতে ইসলামীর মস্তিকপ্রসুত মতবাদ। এটির মূল প্রচারণা জামাতমনস্ক মহলের লোকজনই করছেন।)
আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই দুই মতবাদের কোনোটিতেই আস্থা রাখতে পারছি না। আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ আমাকে স্পষ্টভাবে পুরো ঘটনার পিছনের রাজনীতিটি তুলে দেখাচ্ছে। যে রাজনীতি ক্ষমতালিপ্সার,শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার, হত্যা ও ধ্বংসের।আমি তাই চেষ্টা করবো এই লেখায় এই পিছনের রাজনীতির শুরু থেকে বর্তমান তুলে ধরার।
 
হেফাজতের এই কমিটি এসেছে মূলত শফী সাহেবের মৃত্যুর ওপর ভর করে। হেফাজতের নিয়ন্ত্রণ শফীর হাত থেকে সরে যাওয়ার ও বাবুনগরীর হাতে যাওয়ার ব্যাপারে এই ঘটনাটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো, বলা চলে এটি ছিলো এই পুরো কাহিনীর প্রথম অধ্যায়।
প্রথমেই  তাই আমাদের এই অধ্যায়টি একটু ফিরে দেখা প্রয়োজন। গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর আহমদ শফীর পদত্যাগ,  তার ছেলে আনাস মাদানীকে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কারসহ ৫ দফা দাবি নিয়ে দারুল উলুম হাটহাজারীর ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। দুপুর থেকে এ আন্দোলন শুরু হয়, রাতে আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করা হয় এবং পরদিন ১৭ সেপ্টেম্বর আহমদ শফী পদত্যাগ করেন।
এই আন্দোলনটির পুরো প্রক্রিয়া সারা বাংলাদেশের কাছে গোপন রাখা হয়। মাদ্রাসায় যখন ভাঙচুর ও সহিংসতা চলছিলো তখন সেখানে বাইরে থেকে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ রোধে আন্দোলনকারীরা তীব্র হুমকি দিয়ে রাখে। উল্লেখ্য, শতবর্ষী আল্লামা শফী তখন গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। আন্দোলনের সময়ে একাধিকবার তার রুমে সশস্ত্র হামলা হয় বলে তার সার্বক্ষণিক সহযোগী এবং তার নাতি জানিয়েছেন। এসবের প্রেক্ষিতে যখন তার উচ্চতর চিকিৎসা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে তখন তাকে আন্দোলনকারীরা জানায় দাবী মেনে না নেওয়া পর্যন্ত তাকে চিকিৎসার্থে বাইরে হসপিটালে যেতে দেওয়া হবে না।
এ ব্যাপারে প্রশাসন হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারে দ্বিধায় ভুগছিলো কারণ পুরো আন্দোলনের বিষয়টি যে একটি বড় রাজনৈতিক চক্রান্তের অংশ তা তখন বোঝা যেতে শুরু করেছিলো। এর একটি উদাহরণ সবাই দেখেছেন। হাটহাজারীর দারুল উলম মাদ্রাসায় হওয়া আন্দোলনে প্রশাসন যাতে হস্তক্ষেপ না করে সেজন্যে ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা নুরের “ঢাকা অচল করে দেওয়ার” হুমকি কেউ ভুলে যাননি।
মূলত আকষ্মিক ভাবে এই সহিংস আন্দোলনকারীদের পক্ষে ভিপি নুরদের আত্মপ্রকাশ প্রশাসনকে উপস্থিত মুহুর্তে অনেকটা নিরুপায় করে দেয়। ভিতরে অবরুদ্ধ গুরুতর অসুস্থ ও নির্যাতিত আল্লামা শফী বাধ্য হোন আন্দোলনকারীদের দাবী মেনে সই করে দিতে, যার বিনিময়ে আরো বেশ দীর্ঘ সময় পর তাকে হসপিটালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে দেওয়া হয়। শফীর হসপিটালে যেতে হওয়ার দায় ও যেতে বিলম্বের দায় এই আন্দোলনকারীরা এড়াতে পারেন না।
হসপিটালে আঠারো তারিখে শফি মৃত্যুবরণ করেন। যা মূলত হাটহাজারীতে তার সাথে হওয়া নির্যাতনেরই পরিণাম ছিলো বলে তখনই প্রতিপন্ন করা গিয়েছিল।
যাক, আঠারো সেপ্টেম্বর তারিখে শফী মারা গেলেন, আর  ১৫ নভেম্বরই হেফাজতের ১৫১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হলো।  ওই কমিটি প্রত্যাখ্যান করেন হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফির ছেলে আনাস ও আনাসপন্থিরা।

 
মূলত কমিটি হওয়ারও আগে ওই সম্মেলনটাই প্রত্যাখ্যান করেন আনাসপন্থীরা৷ কেবল তাই নয়, তারা স্পষ্ট অভিযোগ ওঠান যে- শফীকে হত্যা করা হয়েছে।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আনাসপন্থীদের উপেক্ষা করেই নিজেদের মতো করে হেফাজতের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে বাবুনগরী-মামুনুল বলয়। অর্থাৎ যে আল্লামা শফীর দ্বারা হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশে নিজ অবস্থান গড়েছিলো সেই শফীর ছেলে ও তার অনুসারীদের বাদ দিয়েই সংগঠনটিকে নিজেদের এজেন্ডা অনুযায়ী চালাচ্ছিলেন বাবুনগরী-মামুনুলরা।
এই পুরো প্রক্রিয়াটিতে তাদের নেপথ্যে থেকে ইন্ধন ও পূর্ণ সহায়তা যোগায় জামায়াতে ইসলাম। অন্তত তাদের নবগঠিত কমিটিতে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের তীব্র সংখ্যাধিক্য তেমনটারই ঈঙ্গিত দেয়।কমিটি হওয়ার পরপর কমিটিতে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে প্রচুর আলোচনাও শুরু হয় মিডিয়াতে।
ওই সময় শফীর মৃত্যু, তার ছেলে ও নাতির শফীকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি এবং জামাতি কানেকশন নিয়ে আলোচনার ঝড়ে হেফাজত বেশ ভালো চাপে পড়ে। সেসময় সাংবাদিকরা এ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নের ঝড় তুলেন।
মিডিয়াতে এ বিষয়টি হয়ে উঠে অন্যতম আলোচনার বস্তু। এবং মোটামুটি এটাও এক রকম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ ধরে যে মূলত সরকারের সাথে সৌহার্দ্য গড়ে ওঠা আল্লামা শফির হাত থেকে হেফাজতের নেতৃত্ব ছিনিয়ে নিয়ে জামাত হেফাজতকে নিজেদেরই একটি রাজনৈতিক কভার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
ঠিক এমন সময়ে, এই জায়গা থেকেই জন্ম হলো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধিতার রাজনীতির” প্রয়োজনীয়তার। কীভাবে?
কেননা, তার ঠিক পরপরই আমরা দেখলাম বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বিদ্যমান শত শত ভাস্কর্য বাদ দিয়ে হুট করে মামুনুল ঘোষণা দিয়ে বসলেন বঙ্গবন্ধুর নির্মীয়মান ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে না, করলে ভেঙে দেওয়া হবে।
খুবই সেনসেটিভ বিষয় নিয়ে আলাপ দিয়ে বসলেন, সুতরাং খুবই দ্রুত মিডিয়া তো মিডিয়া, মায় সোশ্যাল মিডিয়া সহ সারা দেশের ফোকাস চলে এলো ভাস্কর্যে। পুরো এক মাস ভাস্কর্য নিয়েই উত্তপ্ত রইলো পরিস্থিতি৷ আর মাঝখান থেকে ম্রিয়মাণ হয়ে গেলো শফি হত্যার অভিযোগ, জামাতি কানেকশনের অভিযোগ, সব কিছু। আর এটাও নিশ্চিত হয়ে গেলো যে পরে শফি হত্যার অভিযোগ আবার মাথাচাড়া দিলে মামুনুল সেটাকে তার ভাস্কর্যবিরোধীতার কনসিকোয়েন্স বলে চালিয়ে দিতে পারবেন।
এবং ধীরে ধীরে ঘটলোও তাই। শফী হত্যাকান্ড একদমই আলোচনার বাইরে চলে গেলো। জামায়াতের সম্পৃক্ততার বিষয়টি আকর্ষণ হারালো। সর্বোপরি, শফিপূত্র আনাস যখন শফি হত্যার দায়ে বাবুনগরী ও মামুনুল সহ বেশ কয়েকজনের নামে হত্যা মামলা করলেন তখন সেই মামলাটিও গুরুত্ব কম পেলো।
 
ফলাফলে যা ঘটলো তা হচ্ছে,মামুনুল-বাবুনগরী খুব নিখুঁত ভাবে হেফাজতের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে আসতে এবং তা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলেন। ভাস্কর্যবিরোধিতার উত্তাপ ছড়িয়ে শফিহত্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার পাশাপাশি মামুনুল নিজের আলাদা পরিচিতিও গড়ে তুলতে সক্ষম হন। এটি মূলত তার জন্যে পারফর্মেন্স দেখানো একটি স্ট্যান্ট ছিলো। এছাড়াও এই পদক্ষেপ হেফাজতকে আয়ত্ত্বে নেয়া বাবুনগরীর মনে এমন ধারণা  জন্ম দেয় যে বাংলাদেশে এখন হেফাজত “আফগানিস্তানে মোল্লাদের অবস্থানের” মতো অবস্থান গড়ে তুলতে পেরেছে।
এই জায়গা থেকেই মূলত হেফাজত মোদীবিরোধী আন্দোলনের ইস্যু বানিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত মারমুখী ও উগ্র ভূমিকা গ্রহণ করার দূঃসাহস করে।
তারা নিজেদের ধীরে ধীরে তালিবানদের মতো অবস্থানে নিয়ে যেতে চাইছিলো। যে অবস্থান থেকে তারা রাষ্ট্রে এক ধরনের ছায়াশাসন চালাতে পারবে।
কিন্তু ক্ষমতার লোভ, প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাব ও মূলধারার সামাজিক জীবন ও মানুষ থেকে বিচ্ছিন্নতা তাদের অত্যন্ত অসংযমী করে তোলে। মূলত যে প্রশ্রয় একটি জনগোষ্ঠীর কাছে তারা পাচ্ছিলো তাদের পিছনে জামায়াত ও বিএনপির সমর্থন থাকায়, সেটাকে তারা নিজেদের অর্জন বলে ভাবার হাস্যকর ভুলও করে বসে।
নিজেদের তারা তখন এতোটাই ক্ষমতাশালী ভাবছিলো যে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিলো অগ্রপশ্চাৎ চিন্তাবিহীন এবং খামখেয়ালী।
যার ফলাফলে মূলত মোদীবিরোধী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে তারা থানা আক্রমণ, পুলিশ হত্যাচেষ্টার মতো সব রাষ্ট্রদ্রোহিতা করতেও বিন্দুমাত্র ভয় করেনি।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই সরকার দীর্ঘ নমনীয় ভূমিকা পালনের পর তাদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে যেতে বাধ্য হয়।তা যখন সরকার হার্ডলাইনে যাওয়া শুরু করলো তখন কী কী হলো? একের পর এক হেফাজত নেতা সহিংসতা ও নাশকতার দায়ে গ্রেফতার হওয়া শুরু হলেন। হেফাজত করোনাকালীন লকডাউনকে তাদের দমনের ক্র‍্যাকডাউন বলে প্রচার করা শুরু করলো, যদিও করোনা বাস্তবতায় লকডাউন এমনিতেও প্রাসঙ্গিক ছিলো। তো এই প্রক্রিয়ায় এক পর্যায়ে নিজের মাদ্রাসা (সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে এটি মূলত মামুনুলের জবরদখল করা মাদ্রাসা) থেকে মামুনুল গ্রেফতারও হলেন। তো বহু ঘটনা ঘুরে আজকের এই সময়ে এসে মামুনুল জেলে। রিমান্ডে তিনি শফির অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলার কথা স্বীকার করেছেন। এ সবের বিনিময়ে বাবুনগরী তাকে বড় পদ দিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন।
আবার পূর্ণাঙ্গ কমিটি বিলুপ্তির রাতে,বাবুনগরীর মাদ্রাসা ঘেরাও করেছিলো পুলিশ। সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে “সে রাতে বাবুনগরীকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত ছিলো তবে কমিটি ভেঙে দেওয়ায় খুব সম্ভবত সে সিদ্ধান্ত স্থগিত হতে পারে।”  উপরিউক্ত সকল তথ্যাদি কী এটাই নিশ্চিত করে না যে মামুনুল যখনই রিমান্ডে শফিহত্যা বিষয়ক তথ্যাদি জানানো শুরু করলেন বাবুনগরীর তখনই কমিটি বিলুপ্ত করে দেওয়াটা মূলত সরকারের উদ্দেশ্যে আপোষের সর্বশেষ অনুনয়মিশ্রিত প্রস্তাবই ছিলো?
সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে আপোষের জন্যে অন্য পন্থা বেছে না নিয়ে বাবুনগরী “কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্তির” মতো পন্থাই কেনো বেছে নিলেন? অর্থাৎ এই কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্তির পেছনের রাজনীতিটা কী?
বাবুনগরীর এবং মামুনুলের প্রত্যক্ষ নির্দেশে দীর্ঘদিন ধরে হেফাজতের নামে বাংলাদেশে সহিংসতা চলেছে।রিমান্ডে মামুনুলের বয়ান থেকে এমনটা বর্তমানে জানা গেছে যে হেফাজতের ত্রিশ ভাগ কর্মী সরাসরি জামাত এবং আরো ত্রিশ ভাগ কর্মী তালেবান ঘরানা থেকে আগত।
মূলত আমরা যদি চিন্তা করি শফি নিয়ন্ত্রিত হেফাজত শফীর মৃত্যুর সাথে সাথে বাবুনগরী কীভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলেন, আনাসপন্থীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ; সে ক্ষেত্রে আমাদের এটাই প্রতিপন্ন হতে হয় যে নিঃসন্দেহে এই নিয়ন্ত্রন গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বাবুনগরী বাহ্যিক শক্তির পূর্ণ সমর্থন ও সহায়তা পেয়েছেন।
এছাড়াও বিপরীত ভাবে চিন্তা করলে এই প্রশ্নটিও জাগা স্বাভাবিক যে ; যে হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামীলীগের এতোটা সখ্যতা ছিলো যে, আওয়ামী সভানেত্রীকে হেফাজতের আমীর আল্লামা শফী কওমীজননী উপাধিতেও ভূষিত করেছিলেন বা আওয়ামীনেত্রী শেখ হাসিনাও যে হেফাজতের আহ্বানে কওমী মাদ্রাসার সার্টিফিকেট মর্যাদা মাস্টার্স সমমান করেছিলেন  এবং তাদের অন্যান্য বিবিধ দাবীও পূরণ করেছিলেন সেই হেফাজতের সাথেই শফির মৃত্যুর পর আওয়ামীলীগের এতোটা তিক্ত বা দ্বন্দ্বমুখর অবস্থার সৃষ্টি কীভাবে হলো?
এ ব্যাপারগুলি খতিয়ে দেখলে পালটা এই প্রশ্নটাই উঠে আসে যে, যদিও জুনায়েদ বাবুনগরী পূর্বেও হেফাজতের নেতৃত্বে ছিলেন কিন্তু শফি নিয়ন্ত্রণাধীন হেফাজত আর তার মৃত্যুপরবর্তী সময়ে তার প্রত্যক্ষ  অনুসারীদের বাদ দিয়ে গড়া হেফাজত নামে এক হলেও বাস্তবে এক ছিলো কী?
মূলত হেফাজতে ইসলাম যা কি না বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হয়ে উঠেছিলো, তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেই সংগঠনের নামে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টাই যে কেউ করেছে তাই নয় কী? এবং এ জন্য ২০১৩’র পরে উগ্রতার পথ থেকে সরে এসে আলোচনা ও যুক্তির পথ বেছে নেওয়া হেফাজতকেই শফী পরবর্তী পকেট কমিটির অধীনে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে পরপর দুই বার অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক ভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকারের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে দেখতে পেয়েছি আমরা। প্রথম বার ভাস্কর্যবিরোধিতার স্বার্থে তারা সংবিধানকেও পর্যন্ত অস্বীকার করেছে, আর দ্বিতীয় বার সকল পররাষ্ট্রনীতি  বিষয়ক যুক্তির উপেক্ষা করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার নামে দেশে উত্তাল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে।
যার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে দেশের তিনটি থানায় সশস্ত্র হামলা হতে; যে দৃশ্য সর্বহারা চরমপন্থীদের বিলুপ্তির পর বিগত তিন দশকে বাংলাদেশ দেখেনি।
অর্থাৎ,  মূলত হেফাজতে ইসলামের নামটি ব্যবহার করে দেশে এক ধরণের ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দেখা যায় যা শফি নিয়ন্ত্রণাধীন হেফাজতের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। এ থেকে ধরেই নেওয়া যায়, মূলত সরকারের জন্যে মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল হেফাজত না, বরং হেফাজতের নামটি ব্যবহার করা গোষ্ঠীটি, খুব স্বাভাবিক ভাবেই যাদের অস্তিত্বের নির্ণায়ক ছিলো হেফাজতের এই কেন্দ্রীয় কমিটি।
এখন যদি আমরা সবকটি সমীকরণকে এক করি, তবে আমরা দেখতে পাই; উচ্চাভিলাষী মামুনুল ও বাবুনগরীর যে যৌথ পথচলা সেটি স্পষ্টত কোনো বাহ্যিক শক্তি (আপাতভাবে ধারণ করা যায় জামায়াতে ইসলামী) দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলো।
এই বাহ্যিক শক্তির দেওয়া বরাভয় এদেরকে শফির হত্যা বা মৃত্যু প্রক্রিয়াতেও যুক্ত হতে নিঃশঙ্ক করেছে।
 
কিন্তু বর্তমানে যখন সরকার বনাম হেফাজতী উগ্রতার লড়াই একটি নির্দিষ্ট ফলাফলের দিকে এগোচ্ছে, সেই পরিণতিতে বাবুনগরী চোখের সামনে অনিবার্য বাস্তবতা দেখতে পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন  যে সরকার এখন চাইলেই তাকে শফি হত্যা মামলায় গ্রেফতার করতে পারে।
ভয়াবহ রকম বিতর্কিত মামুনুলের সাথে জোটবদ্ধতাও বাবুনগরীর নিজস্ব স্বকীয় ইমেজকে বেশ সঙ্কটে ফেলেছে। এছাড়া অসংযমী উগ্রতার প্র‍তিঘাতে জনসমর্থনহীন ভাবে উনিশ জন কর্মীর মৃত্যু ঘটা বাবুনগরীকে এই সত্যও অনুধাবন করিয়েছে যে তিনি অন্তত কোনো তালেবান ইউনিটের কমান্ডার নন, এবং তার যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা সরকারের একটিমাত্র পদক্ষেপে কারা প্রকোষ্ঠে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে শেষ হওয়াটা মূহুর্তের ব্যাপার মাত্র।
এমন পরিস্থিতিতে বাবুনগরীর সামনে নিজেকে নিরাপদ করার জন্যে মূলত একটি চেষ্টা করারই সুযোগ থাকে। আর তা হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের নামটি ব্যবহার করে যে ভিন্ন গোষ্ঠীকে তিনি তাদের এজেন্ডায় কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, হেফাজতকে সেই গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে “সেই গোষ্ঠীরই একজনের” অবস্থান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। বা অন্তত সরিয়ে নিয়েছেন বলে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করা।
যে জায়গা থেকে তার জন্যে জামায়াতে ইসলাম ও তালিবান অধ্যুষিত কমিটিকে বিলুপ্ত করে দেওয়াটা হয়ে ওঠে অত্যাবশ্যক।
মূলত পরের ঘাড়ে ভর দিয়ে নিজের উচ্চাভিলাষ পূরণ করার যে স্বপ্ন তিনি দেখছিলেন, রুঢ বাস্তবতায় তাই তাকে কারা প্রকোষ্ঠের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো৷ এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় তার হাতে থাকে সেই ঘাড়টিকে ত্যাগ করা।
এবং নিঃসন্দেহে সেই ত্যাগটি তিনি ভালো ভাবেই করেছেন, এবং যথেষ্ট দ্রুততার সাথেই করেছেন।
তবে বাবুনগরীর উচ্চাভিলাষ তাকে যে সহিংসতার পথে নিয়ে গিয়েছিলো তার কর্মফল ভোগ করা থেকে এতো সহজে তিনি পরিত্রাণ আসলে পাবেন কিনা তা শুধু সময়ই বলতে পারবে!
 
লেখক- সম্রাট দেব চৌধুরী, শিক্ষার্থী- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। 


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ