1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ভিয়েনা কনভেনশন ও সমতা নিশ্চতকরণ

অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ২১ মে, ২০২৩

বাংলাদেশে নিযুক্ত কয়েকজন বিদেশি কূটনীতিকের প্রটোকল-বিষয়ক আলোচনায় সম্প্রতি আমাদের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম বেশ মুখর হয়ে উঠেছে। এর সূত্রপাত ঘটে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারদের ‘অতিরিক্ত নিরাপত্তা’ প্রত্যাহার করার খবরটি প্রকাশ পেলে। পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষে বলা হয়েছে, যেসব রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার বাইরে চলাচলের সময় অতিরিক্ত পুলিশি নিরাপত্তা বা এসকর্ট সুবিধা পেয়ে থাকেন, তাঁরা আর এই সুবিধা পাবেন না।

শুরুতেই কয়েকটি প্রশ্নোত্তর খেয়াল রাখতে হবে। যেমন কোন কোন দেশ এতদিন প্রটোকল সুবিধা পেত? বাংলাদেশে অনেক দেশের দূতাবাস রয়েছে। তার মধ্য থেকে কেবল এই ক’টি দেশই এতদিন বাড়তি প্রটোকল সুবিধা পেয়ে আসছিল। এখন যে ছয়টি দেশের প্রটোকল প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে, তারা ছাড়া আর কোনো দেশ এই বাড়তি প্রটোকল পেত না।

কোন বিশেষ কারণে তারা এটা পেয়ে আসছিল? এই কয়টি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আমাদের দেশের সঙ্গে তাদের  সম্পর্ক– এসব বিষয় বিবেচনায় এনে এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। আবার  এইসব দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবেও কিছু ঘটনা ঘটেছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নিরাপত্তা জোরদার করার বিষয়টি সামনে এসেছিল। তার মানে অন্য মিশনগুলো যে প্রটোকল পেত না বা নিরাপত্তা পেত না তা কিন্তু নয়।

২০১৬ সালে ঢাকায় হলি আর্টিসান জঙ্গি হামলার ঘটনার পর থেকেই বেশ কিছু রাষ্ট্রদূতের উদ্বেগ ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তি কিছু লোকবল দেওয়া হয়েছিল। তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এক ধরনের জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ দ্রুতই জঙ্গি দমনে তার সুফল পেয়েছিল। এ ছাড়া ২০০৪ সালে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের তৎকালীন হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর সিলেটে গ্রেনেড হামলার পর থেকে তাঁকে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের অন্য হাইকমিশনাররাও এই নিরাপত্তা সুবিধা পেয়ে আসছিলেন। যদিও আনোয়ার চৌধুরীকে হামলার ঘটনায় মুফতি হান্নানকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। দ্রুত সময়ের মধ্যেই তার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছিল। সেই ঘটনায় তৎকালীন ব্রিটিশ মুখপাত্র দ্রুত সময়ে বিচার চালু করার ঘটনায় সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছিলেন। তবে মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর করার বিষয়ে তাঁর আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। সেটি ছিল তাঁদের নিজস্ব বিচারপদ্ধতির জন্য। যেহেতু সেখানে বিচারের জন্য ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড বিধানের ব্যবস্থা নেই, তাই তাঁরা সেই প্রক্রিয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে অবশ্য বেশ কিছু মামলা ছিল।

এখন কেন অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হচ্ছে? ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি নিরাপত্তা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো। কূটনীতিকদের বাড়তি নিরাপত্তা সুবিধা দিলে বিদেশিদের কাছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা নিয়ে ভুল বার্তা যায়। তাই বাংলাদেশ কোনো ভুল বার্তা দিতে চায় না। এ ছাড়া কয়েকটি দেশকে বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা দেওয়ায় অন্যান্য দেশও তা চাইছিল। সে কারণে এভাবে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া অব্যাহত রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না।

প্রসঙ্গত, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কূটনীতিকদেরও বাড়তি কোনো নিরাপত্তা সুবিধা দেওয়া হয় না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মিশনসমূহে ও মিশনপ্রধানদের বাসভবনেও কোনো পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হয় না। তাদের জন্য পৃথক গানম্যানও নেই। তারা সেসব দেশে স্বাভাবিক মানুষের মতোই চলাফেরা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা প্রাপ্তবয়স্ক হলেই আগ্নেয়াস্ত্র বহন করার পারমিশন পায়। স্কুল, কলেজ, শপিংমলসহ বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে গুলি ছোড়ার ঘটনা সেই দেশে সাধারণ। কিন্তু আমরা জানি যে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কোনো পুলিশি নিরাপত্তা পান না, যেটা যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেক্ষাপটে জরুরি বলা যেতে পারে। আমাদের দেশে পাবলিক প্লেসে জনসাধারণের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা প্রায় ঘটেনি বললেই চলে। আমরা দেখেছি নিউজিল্যান্ডের মতো একটি শান্তিপ্রিয় দেশেও ক্রাইস্টচার্চে একটি মসজিদে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছিল।

এখন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্সের দিক থেকে তাকালে দেখা যাবে, এর অবস্থান ভালোর দিকে। বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে– ৪৩। তালিকায় এই অবস্থান পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও ভালো। এমন ভালো নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও কেন কূটনীতিকদের জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা চালু রাখবে? এসবের পেছনে কেন বাড়তি অর্থ খরচ করবে?

আমি মনে করি, বর্তমানে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই কূটনীতিকদের অতিরিক্ত নিরাপত্তার আবশ্যকতা নেই। এ ছাড়া বারিধারা, গুলশানসহ কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তার জন্য পুলিশের আলাদা ‘ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি ডিভিশন’ তৈরি করা হয়েছে। তাঁরা দূতাবাস এলাকার নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক কাজ করছেন। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস, আমেরিকান সেন্টার, আমেরিকান ক্লাব ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবনকে কেন্দ্র করে কমবেশি ২০০ পুলিশ সদস্য প্রতিদিন দায়িত্ব পালন করছেন। এখন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এসকর্টের দায়িত্বে যে সাতজন ছিলেন, শুধু তাঁদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাকি পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থা, বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের দায়িত্ব আগের মতোই পালন করবেন।

ভিয়েনা কনভেনশনে (১৯৬১) বলা হয়েছে, স্বাগতিক দেশ দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সেই নিয়ম মেনেই তো বাংলাদেশ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসছে। এসকর্ট বা অতিরিক্ত নিরাপত্তার কথা আলাদাভাবে বলা নেই। আর ভিয়েনা কনভেনশন শুধু ছয়টি দেশের জন্য নির্ধারিত নয়; সব দেশের কূটনীতিকদের জন্যই সমান প্রযোজ্য। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ছয়টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের এসকর্ট বা অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রত্যাহারে ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘিত হবে না। নতুন সিদ্ধান্তের এই বিষয়টিও যৌক্তিক যে, কোনো দেশ বাড়তি নিরাপত্তা চাইলে এর পেছনের অতিরিক্ত ব্যয় সংশ্লিষ্ট মিশনকে বহন করতে হবে। অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত অর্থ বাংলাদেশ সরকার বহন করবে না।

এখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, অর্থ খরচে লাগাম টানা, এক ধরনের কৃচ্ছসাধনের চেষ্টা– এইসব কারণেও বাংলাদেশকে নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা উচিত হবে না। ছয় দেশের বাইরে চীন, রাশিয়া, ইরান, তুরস্কের মতো ‘প্রভাবশালী’ অন্য দেশগুলোও অতিরিক্ত নিরাপত্তা চাইলে তখন কী হবে? ঢাকার সব দূতাবাসের জন্য নিজেদের অর্থ ও জনবল ব্যয় করে অতিরিক্ত নিরাপত্তা দেওয়া কি বাস্তবসম্মত? আমার মনে হয়, না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি যে, যেসব মিশনপ্রধান বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা বাড়তি নিরাপত্তার আওতায় ছিল তাঁরাও কেউ কেউ সেটাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। এতে করে তাঁদের চলাফেরায় এক ধরনের বাড়তি মনোযোগ তৈরি হতো। তাঁদের স্বাভাবিক চলাফেরা প্রতিনিয়ত বিধিনিষেধের মুখে পড়তে হতো।

উপসংহারে এসে বলা যায়, প্রটোকল প্রত্যাহার করা নিয়ে যে আলোচনা ও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, তার কূটনৈতিক মূল্য সামান্য। একটি কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে অহেতুক আলোচনা করতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো আড়ালে চলে যাচ্ছে কিনা, সেটাই বরং ভেবে দেখা দরকার। মনে রাখতে হবে, অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অহেতুক আলোচনার আপদ বাজারে ছেড়ে দিয়ে জনসাধারণের দৃষ্টি ঘোরানোর কৌশল অনেক পুরোনো।

লেখক: অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ – আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ