1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় আর্থিক নিরাপত্তার ভিত্তি

রেজাউল করিম খোকন : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ২৭ জুন, ২০২২

সরকার সর্বজনীন নাগরিক পেনশন চালুর একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের নীতিকৌশল প্রণয়ন করে আগামী বছরের জুলাই থেকে একটি পাইলট স্কিম চালু করবে। ২০২২-২৩ সালের বাজেট তৈরির প্রাক্কালে সর্বজনীন নাগরিক পেনশনের বিষয়টি নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে কিংবা ছয় মাসের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব সব নাগরিকের জন্য অবসরকালীন সুবিধা বা সর্বজনীন পেনশন চালু করতে যাচ্ছে সরকার। শুরুর দিকে ব্যবস্থাটি ঐচ্ছিক রাখা হলেও পরবর্তী সময় এটি বাধ্যতামূলক করা হবে। তবে নিবন্ধিতরা ১০ বছর পর থেকে এর প্রত্যক্ষ সুফল পাওয়া শুরু করবেন। জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি সব নাগরিকের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। প্রবাসীরাও এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। নিবন্ধিতরা ৬০ বছরের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পেনশন ভোগ করতে পারবেন। এজন্য আলাদা একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে, যার সব কাঠামোগত ও সুবিধাদি সরকার বহন করবে।

২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় এনে তাদের বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জাতীয়ভাবে একটি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে সরকারের প্রণীত জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রে একটি ব্যাপকভিত্তিক সমন্বিত অংশগ্রহণমূলক পেনশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছিল। দেশের শ্রমবাজারের ৮৫ শতাংশ জনবল অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত, প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাঠামো না থাকায় বৃদ্ধকালে তাদের জীবনযাপনে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ার আশঙ্কা আছে। তার দেয়া ২০২০ সালে দেশে ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ। এই সংখ্যা ২০৪১ সালে ৩ কোটি ১০ লাখ হবে বলে তার অনুমান। তিনি বলেন, গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ধীরে ধীরে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাদের নিরাপত্তা ক্রমান্বয়ে হুমকির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এসব কারণেই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের আপাতত নতুন জাতীয় পেনশন ব্যবস্থার বাইরে রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সরকার যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবে। সাধারণ মানুষ কীভাবে এবং কেমন সুবিধা পাবে, এমন একটি ধারণা দিয়ে এ ব্যবস্থার একটি অনুমানভিত্তিক হিসাব দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কোনো ব্যক্তি মাসিক চাঁদা ১ হাজার টাকা দিলে মুনাফা যদি ১০ শতাংশ ও আনুতোষিক ৮ শতাংশ ধরা হয়, তাহলে ১৮ বছর বয়সে যদি কেউ চাঁদা দেয়া শুরু করে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তা চালু রাখেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অবসরের পর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা পেনশন পাবেন। যদি ৩০ বছর বয়সে চাঁদা দেয়া শুরু করে ৬০ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখেন, তাহলে অবসরের পর প্রতি মাসে তিনি ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা পেনশন পাবেন। তবে চাঁদার পরিমাণ কম-বেশি হলে আনুপাতিক হারে পেনশনের পরিমাণও কম-বেশি হবে।
এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, একটি পেনশন আইন প্রণয়ন ও আইনের আওতায় একটি পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন। এ পর্যন্ত এই আইনের খসড়ার বিষয়ে যা জানা যায়, তা হচ্ছে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট একটি চাঁদা দিয়ে পেনশনের জন্য নিবন্ধিত হবেন। ন্যূনপক্ষে ১০ বছর এ চাঁদার ধারাবাহিকতা থাকলে তারা নির্দিষ্ট বয়সসীমা অতিক্রম করার পর রাষ্ট্রীয় পেনশন পাওয়ার উপযুক্ততা অর্জন করবেন। তা ছাড়া বেসরকারি খাতকে পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তিরও একটি পথরেখা করা হচ্ছে। পেনশন আইন ও এ বিষয়ক নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগে জনমত গ্রহণ ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে জনমিতির সুবিধা ভোগ করছে। আমাদের বর্তমান গড় আয়ু ৭৩ বছর, যা ২০৫০ সালে ৮০ ও ২০৭৫ সালে ৮৫ বছর হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, আগামী তিন দশকে একজন কর্মজীবী ব্যক্তির অবসর গ্রহণের পরও গড়ে ২০ বছর আয়ু থাকবে। বর্তমানে বাংলাদেশে নির্ভরতার অনুপাত ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে ২৪ ও ২০৭৫ সালে ৪৮ শতাংশে উন্নীত হবে। গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার অনুপাত বিবেচনায় আমাদের বার্ধক্যের নিরাপত্তা হিসেবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা খুবই জরুরি।

সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা সাধারণত চাকরিতে অবসর গ্রহণের পর এবং তার মৃত্যুর পর তাদের স্ত্রী ও পরিবারবর্গের ভরণপোষণে বড় একটি সহায় হিসেবে বিবেচিত হয় পেনশন। বাংলাদেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের জন্য আলাদাভাবে পেনশন প্রদানের ব্যবস্থা নেই। এর বাইরে চাকরিজীবী নন যারা, ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা স্বাধীন কোনো পেশাজীবী তাদেরও বৃদ্ধ বয়সে পেনশন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে যেখানে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা বাস্তবায়িত হয়েছে সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সব নাগরিকের জন্য পেনশন প্রদানের বিশেষ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যা নাগরিকদের জন্য বৃদ্ধ বয়সে এক ধরনের আর্থিক নিশ্চয়তা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় অসচ্ছল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রভৃতি কর্মসূচি চালু করেছে। যার আওতায় দেশের শহর ও গ্রামের বিশাল জনসংখ্যার একটি অংশ সামান্য হলেও মোটামুটি এক ধরনের আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন সরকারের কাছ থেকে। শুধু সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর পেনশন সুবিধা লাভ করলেও দেশের অবশিষ্ট চাকরিজীবী, পেশাজীবীরা সর্বজনীন পেনশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন। সেই সমস্যা নিরসনে এবার প্রথমবারের মতো দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার।

২০১৫ সালে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের খসড়া তৈরি করে দিয়েছিল। ওই খসড়ায় সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সুপারিশ করা হয়েছিল। পরে তা ওই কৌশলে সন্নিবেশিত করা হয়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তা চালু করে যেতে পারেননি। দেরিতে হলেও সরকার কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া অঙ্গীকার বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এর ফলে সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পেনশন সুবিধাভোগী মানুষদের বাইরে এই সুবিধাবঞ্চিত বৃহৎ অংশের নাগরিকরা বৃদ্ধ বয়সে নতুন এই স্কিমের আওতায় পেনশন লাভের সুযোগ পাবেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে সরকার সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে চাইছে। অতীতে এ রকম বৃহৎ কল্যাণমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সরকারের সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আওতাভুক্ত হতে হলে ব্যক্তি পর্যায়ে প্রতিজনকে সর্বনিম্ন কত টাকা চাঁদা দিতে হবে তা নির্ধারণে সরকারকে অবশ্যই দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষের আর্থিক সঙ্গতি, সক্ষমতা বিবেচনায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছেন নিত্যদিন, তাদের পক্ষে সংসারের যাবতীয় প্রয়োজনীয় খরচ মিটিয়ে পেনশন তহবিলে ন্যূনতম কত টাকা মাসিক কিস্তি হিসেবে জমা দেয়া সম্ভব হবে সেটা বিবেচনায় না রাখলে এ কর্মসূচি সাধারণ প্রান্তিক পর্যায়ে নাগরিকদের মধ্যে তেমন সাড়া জাগাবে না। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সামর্থ্য বিবেচনায় পেনশন তহবিলের মাসিক কিস্তি নির্ধারণ করতে হবে। সমাজের কারা কারা পেনশন সুবিধাভোগী হবেন, এর বৈশিষ্ট্য ঠিক করার ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা ভাবতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে বাছাই করে নির্দিষ্ট কিছু নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করে যেন এই তালিকা তৈরি করা না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে বেকারদের জন্য পেনশন সুবিধা রয়েছে। সেখানে একজন কর্মী যখন চাকরি করেন, তখন তিনি কিছু অর্থ জমা রাখেন। যদি কোনোভাবে তিনি বেকার হয়ে যান তখন সরকার কিছু অর্থ যোগ করে ওই ব্যক্তিকে পেনশন ভাতা প্রদান করে। এটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সেখানে প্রতারণা কিংবা জমানো অর্থ পেনশন হিসেবে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরকম হয়রানির সুযোগ নেই। পেনশন তহবিলে যারা টাকা জমা রাখবেন তারা যেন সঠিক জায়গায় ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার জন্য টাকাটা রাখতে পারেন- তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সর্বজনীন পেনশন তহবিলে জমানো টাকা যেন বেহাত, আত্মসাৎ বা লুটপাট হয়ে না যায় সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি, নিরীক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারকে যেন বিশাল ক্ষতি ও ঘাটতির মুখে পড়তে না হয়- তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন জাতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অনন্য উপহার সন্দেহ নেই। জনকল্যাণমুখী সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি হিসেবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা সর্বাত্মকভাবে সফল হোক- আমরা তা প্রত্যাশা করি।

লেখক : রেজাউল করিম খোকন – সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক। ananno86bolly@gmail.com


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ