1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ইতিহাস 

জয়ন্ত ঘোষাল : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ২৭ জুন, ২০২২

‘আহা! কি দেখিলাম! জন্ম জন্মান্তরে ভুলিব না। ’ সেই সুদর্শন জলরাশি দেখে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের নবকুমার এ কথা বলেছিল। আর ২০২২ সালের ২৫ জুন এই বিশ্বকে তাক লাগানোর দিনে ঢাকার পদ্মা সেতুতে দাঁড়িয়ে আমার মুখ থেকেও এই বাক্যটা বেরিয়ে এলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

সুদীর্ঘ অপেক্ষার শেষ।

মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ঐতিহাসিক ক্ষণের সাক্ষী থাকতে ভারতীয় সাংবাদিকদলের প্রতিনিধি হয়ে ঢাকায় এসেছি। দেখছি দেশজুড়ে এক সাংঘাতিক উন্মাদনা।

সবুজ জ্যাকেট পরে, লাল আর সাদার বিশেষ জামদানি শাড়িতে প্রধানমন্ত্রী এলেন। রঙিন আলো ছড়িয়ে গেল পদ্মার আকাশে। শুধু দেখছি আর দেখছি। আমাজনের মতো খরস্রোতা পদ্মার ওপর সাংঘাতিক শাসন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘আমি পারি। আমরা পারি। ’ এ ছিল তাঁর আত্মবিশ্বাস আর ভবিষ্যতের অঙ্গীকার।

অর্থনীতির চাকা ঘুরে গেল। সারা বিশ্ব থেকে এলো অভিনন্দন। পদ্মা সেতু দিয়ে রেলও চলবে। সে কথাও আমরা জানতে পারলাম।

এই অভাবনীয় দৃশ্য যখন আমি দেখছি, ঠিক তখন এই দেশের নানা জেলায়, নানা প্রান্তে উৎসাহী মানুষ কেক কাটছে, মিছিল করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শোনা যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর এ রকম উন্মাদনা বাংলাদেশে নাকি নজিরবিহীন। এ কথা বলছেন সেখানকার প্রবীণ মানুষরা।

বাংলাদেশের পাঠককুল—তাঁরা এরই মধ্যে একনজরে জেনে নিয়েছেন, কেন বিশ্ব ইতিহাসে পদ্মা সেতু মাইলফলক। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য, সেতুর উচ্চতা ইত্যাদি সব তথ্য এরই মধ্যে প্রকাশিত।

আমি একজন ভারতীয় সাংবাদিক, ঢাকায় এসে এ দৃশ্য দেখে যে জিনিসগুলো নিয়ে ভাবছি এবং আমার মাথার মধ্যে যেসব প্রশ্ন কামড়াচ্ছে সেগুলো হলো, আগামী দিনে যেভাবে আমি ঢাকার চলার পথ দেখতে পাচ্ছি সেগুলো মনে হচ্ছে আপনাদের জানাই। এটা শুধু ঢাকায় এসে ঢাকাকে দেখা নয়, ঢাকার বাইরে থেকে ভারতীয় সাংবাদিকের নজরে পদ্মা সেতু, সাহসী শেখ হাসিনার সাফল্য আর বাংলাদেশের ভবিষ্যেক দেখা।

এই গৌরবের পদ্মা সেতুর রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে চাইছি আপনাদের কাছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কোনো একটি বস্তুগত সৌধ বা আইকনের মাধ্যমে দেশের ব্র্যান্ড ইকুইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয়তাবাদী সংবেদনশীলতাকে মানুষ অনুভব করে দশকের পর দশক, শতকের পর শতক। বিভিন্ন দেশে তার রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ বিভিন্ন প্রকার হতে পারে।

প্যারিসে গিয়ে মানুষ ‘আইফেল টাওয়ার’ দেখে। তার উচ্চতা যেন ফ্রান্সের গৌরবগাথার উচ্চতার কথা বলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ দেখে লিংকন এবং আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে নীতি ও ন্যায্যতা প্রাপ্তির কথা মনে পড়ে।

এই বাংলাদেশেই ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত শহীদ বেদি বারবার দেখেছি। আবার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ দেখতে আসেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা। বাংলাদেশের এই দুটি স্মৃতিসৌধ মনে করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে। মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং সংগ্রামের অতীত কাহিনি।

এই পদ্মা সেতুর কথা কিন্তু ইতিহাস বলছে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর এই ২৫ জুন পদ্মা সেতু আরেক বিজয়ের কথা বলে। শেখ হাসিনার এই সাফল্য ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে কেন? তার প্রধান কারণ ইতিহাসের পটে তিনি এক সাম্প্রতিককে রচনা করলেন, যে পদ্মা সেতু শুধু ইতিহাসের কথা বলে না, এই পদ্মা সেতু আধুনিকমনস্ক চেতনাসমৃদ্ধ হয়ে ভবিষ্যৎ উন্নয়নের কথা বলে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতির কথা জানায়। এই পদ্মা সেতু দেশজুড়ে গড়ে তুলেছে এক পদ্মা-জাতীয়তাবাদ।

এর আগে আমরা বাংলাদেশে ক্রিকেট-জাতীয়তাবাদে দেখেছি যে কিভাবে বাংলাদেশের ছেলেরা আপ্রাণ চেষ্টা করে ক্রিকেটে সাফল্য নিয়ে এসে বাংলাদেশের মানুষের এক ধরনের ক্রিকেট জাতীয়তাবাদের চেতনাকে জাগিয়েছেন। তবে পদ্মা-জাতীয়তাবাদ তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি শক্তিশালী। কেননা এই পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে শুধু আর্থিক স্বাধিকারের কথা বলে না, এই পদ্মা সেতু রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি এবং সামাজিক বহু ঘটনার সঙ্গে যুক্ত।

বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি ধরার চেষ্টা করেছিল এই পদ্মা সেতুকে নিয়ে। কানাডার আদালত দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের লড়াইয়ের পর জানিয়েছিলেন, কোনো প্রমাণ নেই। কোনো দুর্নীতি নেই। আহত বাহিনী হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা। বিদেশের কারো কাছ থেকে কোনো অর্থ সাহায্য না নিয়ে বাংলাদেশ তার নিজের টাকায় পদ্মা সেতু রচনা করতে বদ্ধপরিকর হয়।

সুতরাং একদিকে অন্য কোনো দেশের ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল না হয়ে নিজের সেতু নিজে গড়া—সে এক সাংঘাতিক সাফল্য। আবার এই পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে গড়ে উঠবে যোগাযোগব্যবস্থা। ভারত এবং বাংলাদেশ শুধু নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এই পরিকাঠামো গড়ে তুলবে এক সাংঘাতিক কমিউনিকেশন।

চীন বিভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে রাস্তা গড়া নিয়ে কথা বলছিল। নানা কারণে তা থমকে যায়। বাংলাদেশ যখন পদ্মা সেতু গড়তে যায়, তখন বিশ্বব্যাংকের ভূমিকায় এই পদ্মা সেতু হবে কি না, এই পদ্মা সেতু তৈরি করা যাবে কি না—সে ব্যাপারে কিন্তু সন্দেহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার জাপানে গিয়ে শুধু যমুনা সেতু নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। পদ্মা সেতুর বিষয়টি নিয়েও তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন তাঁর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

যমুনা সেতু, যেটি বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নামে পরিচিত, সেটিও শেখ হাসিনাই বাস্তবায়িত করেন। আর ১৯৭৩ সালে জাপানে গিয়ে সেতুর স্বপ্ন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আজ তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর অদম্য শক্তি এবং ‘কারেজ অব কনভেকশন’ দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করলেন।

সুতরাং এই পদ্মা সেতুর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রের অবজ্ঞার আত্মনির্ভরতা, গোটা বিশ্বের অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলা। আবার দেশের দীর্ঘদিনের যে সমস্যা, অর্থাৎ দক্ষিণ আর উত্তরের মধ্যে যে ভারসাম্যহীনতা এবং দক্ষিণের যে বিচ্ছিন্নতাবোধ, সেসব ঘুচিয়ে দিয়ে এই পদ্মা সেতু এক নতুন অধ্যায় তৈরি করল।

শেষ করি নিজেদের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলে, বেশ কয়েক বছর আগে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধু মিলে খুলনা থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম। তখন পদ্মা সেতু তৈরি হয়নি। আলাপ-আলোচনা চলছে, কী হবে পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ—এসব নিয়ে। কে তৈরি করবে পদ্মা সেতু? কে দেবে টাকা? আর সেই সময় সেতু না থাকায় আমরা ছয় ঘণ্টা ধরে পদ্মা নদীর তীরে অপেক্ষা করেছিলাম। কখন আমাদের জেটি খুলবে তা-ও জানি না। কখন আমরা সেই দোতলা স্টিমারে করে ভয়ংকর একটা ভিড়ের মধ্যে হুড়াহুড়ি-ছোটাছুটির মধ্য দিয়ে ঢাকায় এসে পৌঁছব, সে-ও জানি না।

সেই সময় আমরা ভারতীয় সাংবাদিকরা আলোচনা করেছিলাম, এই এতক্ষণ ধরে যদি একটা বিরাট অঞ্চলের মানুষকে অপেক্ষা করতে হয় ঢাকায় যাওয়ার জন্য, তাহলে কিভাবে এ দেশের উন্নয়ন হবে এবং কিভাবে এই সংকট থেকে বাঁচবে বাংলাদেশের মানুষ?

২৫ জুন শেখ হাসিনা সেই পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেন। তিনি গাড়িতে চেপে সেতুর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে এলেন। তারপর জনসভা করলেন এবং পরদিন রবিবার এই সেতু উন্মুক্ত করে দিলেন সাধারণ মানুষের জন্য।

শুধু দু-একটা নয়, মোট ২১টা জেলা উপকৃত হবে এর ফলে। এখন পৃথিবীর সব দেশ বাংলাদেশকে ধন্য ধন্য করছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে শেখ হাসিনার এই পদ্মা সেতুর সাফল্যকে ছোট করা সম্ভব নয়। এই পদ্মা সেতুর নির্মাণ শেখ হাসিনাকে এক ধাক্কায় পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে এগিয়ে দিল। মুন্সীগঞ্জের পদ্মাপার থেকে তাঁকে তুলে দিল অনন্য এক উচ্চতায়।

মাওয়া থেকে জাজিরা। তারপর সেই জাজিরা থেকে শিবচরে গিয়ে জনসভা করে মানুষের জাতীয়তাবাদী আবেগকে স্পর্শ করলেন শেখ হাসিনা। ভারতের শুধু নয়, পাকিস্তান এবং চীনের সংবাদমাধ্যমেও এই পদ্মা সেতুর ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে শেখ হাসিনা বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি পদ্মা সেতুর ওপর। জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। গাড়িঘোড়া চলছে। পরদিন অর্থাৎ রবিবার ২৬ জুন আমরা পদ্মা সেতুর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত হাঁটছি আর দেখছি শক্তিশালী সেই পিলারগুলো। বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্পগোষ্ঠীগুলো কিভাবে নিজেদের অবদানের মধ্য দিয়ে এই সেতুর ক্ষেত্রে স্বদেশিয়ানাকেও প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এই সেতুর জন্য সিমেন্ট পর্যন্ত দিয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্পগোষ্ঠী ‘বসুন্ধরা’। এভাবে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্পমহলকেও এক ধাক্কায় অনেকটা এগিয়ে দিয়েছেন। চাঙ্গা করে দিয়েছেন মানুষের ভবিষ্যৎ স্বপ্নকে। তাই পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ইতিহাসকে খুঁজে পাচ্ছি।

এ এক স্বপ্ন লাভের কাহিনি।

লেখক : জয়ন্ত ঘোষাল – নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ