1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান

ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০২০

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দর্শন, আদর্শ, চেতনাকে হত্যা করে দেশকে আবার পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, ভঙ্গুর অর্থনীতি সচল, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, প্রশাসনকে পুনর্গঠন করে সচল, জনগণের সার্বিক জীবন-মান উন্নয়ন, বিশ^দরবারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় এবং সর্বোপরি একটি সংবিধান প্রণয়নের মত গুরুত্বপূর্র্ণ কাজ ছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে মোকাবেলা করতে হয়েছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানামুখী ষড়যন্ত্র ও চাপ। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো। বঙ্গবন্ধু যখন সৃষ্ট সকল সঙ্কট ক্রমান্বয়ে কাটিয়ে উঠে দেশকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে এনে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন, তখনই তাঁকে হত্যা করা হয় সপরিবারে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ও সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে উপলব্ধি করেছিলেন আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার অন্যতম বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সোচ্চার এবং দৃঢ় অবস্থানে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য, বিবৃতিতে ও লেখায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সুস্পষ্ট করেছিলেন। দেশ পুনর্গঠনে দুর্নীতি যে বিরাট একটি অন্তরায় এবং দুর্নীতির সঙ্গে যে মূলত শিক্ষিত সমাজের ক্ষুদ্রতম অংশ জড়িত, সে বিষয়টি তিনি একাধিকবার উচ্চারণ করার পাশাপাশি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সতর্ক করে আত্মশুদ্ধির উপদেশ ও আহ্বান জানিয়েছিলেন।
২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘করাপ্শন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপ্শন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ, যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপ্শন দেখবেন- আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান, করাপ্শন। খাদ্য কিনতে যান-করাপ্শন, জিনিস কিনতে যান-করাপ্শন, বিদেশ গেলে টাকার উপর করাপ্শন। তারা কারা? আমরা যে ৫ পারসেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরাই বড়াই করি। আজ আত্মসমালোচনার দিন এসেছে। এসব চলতে পারে না। মানুষকে একদিন মরতে হবে। কবরে যেতে হবে। কিছুই সে নিয়ে যাবে না। তবুও মানুষ ভুলে যায় কি করে, এ অন্যায় কাজ করতে পারে। আর এই দুঃখী মানুষ যে রক্ত দিয়েছে, স্বাধীনতা এনেছে, তাদের রক্তে বিদেশ থেকে খাবার আনিয়ে সেই খাবার চুরি করে খাবে, অর্থ আনব চুরি করে খাবে, টাকা আনব তা বিদেশ চালান দেবে। বাংলার মাটি থেকে এদের উৎখাত করতে হবে। আজ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, কালোবাজারি নতুন পয়সাওয়ালাÑএদের কাছে আমার আত্মবিক্রি করতে হবে, এদের অধিকারের নামে আমাদের এদের ফ্রি-স্টাইল ছেড়ে দিতে হবে। কখনও না। কোন দেশ কোন যুগে তা দেয়নি। দিতে পারে না। যারা আজকে আমার মাল বিদেশে চালান দেয়, চোরাকারবারি করে, যারা দুর্নীতি করে, এদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। মানুষকে যারা পয়সা দেয়, তোমার মাহিনা দেয়, তোমার সংসার চালানোর জন্য ট্যাক্স দেয়, তার কাছে তুমি আবার পয়সা খাও। মেন্টালিটি চেইঞ্জ করতে হবে। সরকারী কর্মচারী, মন্ত্রী, প্রেসিডেন্টÑ আমরা জনগণের সেবক, আমরা জনগণের মাস্টার নই। মেন্টালিটি আমাদের চেইঞ্জ করতে হবে। আর যাদের পয়সায় আমাদের সংসার চলে, যাদের পয়সায় আমরা গাড়ি চড়ি, যাদের পয়সায় আমরা পেট্রোল খরচ করি, আমরা কার্পেট ব্যবহার করি, তাদের জন্য কী করলাম? সেটাই আজ বড় জিনিস। এত বড় দুর্ধর্ষ, এত বড় শক্তিমান, এত বড় বন্দুক, এত কামান, এত মেশিনগান, এত পাকিস্তানী সৈন্য, এত বড় তথাকথিত শক্তিশালী আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, ইসকান্দার মির্জা, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী বাংলার মানুষকে অত্যাচার করতে চেষ্টা করেছে বন্দুক দিয়ে। তার বিরুদ্ধে বিনা অস্ত্রে আপনাদের নিয়ে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত যদি উৎখাত করতে পারি, তাহলে কিছু দুর্নীতিবাজ, কিছু ঘুষখোর, কিছু শোষক, কিছু ব্লাক মার্কেটিয়ার্স বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে পারব নাÑ এ কথা আমি বিশ^াস করি না।’
একই তারিখে সংসদের অপর অধিবেশনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু মাননীয় স্পীকারকে উদ্দেশ করে উপরোক্ত বক্তব্য পুনর্ব্যক্ত করে আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘দেশকে বাঁচান, মানুষকে বাঁচান, মানুষের দুঃখ দূর করুন। আর দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাকারবারিদের উৎখাত করুন।’
বঙ্গবন্ধু ওই ভাষণে বাংলাদেশকে যারা ভালবাসে না তাদের উদ্দেশ্য আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘যার যা ইচ্ছা লেখে, কেউ এ নামে বাংলাদেশকে ডাকে, কেউ ও নামে বাংলাদেশকে ডাকে; বাংলাদেশের নাম পর্যন্ত বলতে তারা লজ্জাবোধ করে। তাদের অধিকার নাই বাংলার মাটিতে থাকারÑ যেমন নাই চোরাকারবারি, ঘুষখোর, মুনাফাখোরদের, যেমন নাই দুর্নীতিবাজদের।’
২৬ মার্চ ১৯৭৫ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শিক্ষিত সমাজের উদ্দেশে বলেন- ‘শিক্ষিতদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন। আমি এই যে দুর্নীতির কথা বল্লাম, তা কারা করে? আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? ব্লাক মার্কেটিং করে কারা? বিদেশী এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান দেয় কারা। হোর্ড করে কারা? এই আমরা যারা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যেই রয়েছে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে, আত্মশুদ্ধি করতে হবে। দুর্নীতিবাজ এই শতকরা ৫ জনের মধ্যে, এর বাইরে নয়।’
ওই জনসভায় বঙ্গবন্ধু দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে আরও বলেন, ‘আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয়, সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায়- সে দুর্নীতিবাজ, যে স্মাগলিং করে- সে দুর্নীতিবাজ, যে হোর্ড করে- সে দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে- তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে, তারাও দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। যে ঘুষখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিস বিদেশে চোরাচালান দেয়, তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।’ ওই জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনগণকে আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনারা বহুদুর থেকে কষ্ট করে এসেছেন। গ্রামে গ্রামে ফিরে যান। গিয়ে বলবেন, দুর্নীতিবাজদের খতম করতে হবে।’
২১ জুলাই ১৯৭৫ নবনিযুক্ত জেলা গবর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কিন্তু শুধু নিজেরা ঘুষ খাওয়াই করাপ্শন নয়। এ সম্বন্ধে আমার কথা হলোÑ করাপ্ট পিপলকে সাহায্য করাও করাপ্শন। নেপোটিজমও কিন্তু এ টাইপ অফ করাপ্শন। স্বজনপ্রীতিও কিন্তু করাপ্শন। আপনারা এসব বন্ধ করুন। স্বজনপ্রীতি ছেড়ে দিলে আপনারা করাপ্শন বন্ধ করতে পারবেন। আর আজ আমার কাছে আপনারা তওবা করে যান যে, স্বজনপ্রীতি করবেন না। ঘুষখোরদের সাহায্য করবেন না।’
বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত বক্তব্য থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, তিনি ‘দুর্নীতি’ ও ‘দুর্নীতিবাজ’- এর সংজ্ঞা বিস্তৃত করেছেন। অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধু ‘ইন্টালেকচুয়াল করাপ্শন’ অর্থাৎ ‘বৌদ্ধিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির’ নতুন ধারণা দিয়েছিলেন। স্বীয় কর্তব্য পালন না করা অর্থাৎ, কাজে ফাঁকি দেয়া, নিজে দুর্নীতি না করলেও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে প্রশয় দেয়া, দুর্নীতিবাজকে সাহায্য করা এবং স্বজনপ্রীতিকে তিনি দুর্নীতির সংজ্ঞাভুক্ত করেছিলেন। আজকের বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত বক্তব্যসমূহ পুনঃপুনঃ স্মরণ করা প্রয়োজন সকল রাজনৈতিক নেতাকর্মী, মন্ত্রী-সংসদ সদস্য, সরকারী চাকরিজীবী, আদালত-বিচার অঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনে কারা অভ্যন্তরের বিভিন্ন দুর্নীতি প্রত্যক্ষ করেছেন। কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৩৭) বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘দুঃখের বিষয় কয়েদিদের কপালে ভাল ওষুধ কম জোটে। কারণ ভাল ব্যবহারের ডাক্তার যারাÑ যারা কয়েদিদেরও মানুষ ভাবে, আর রোগী ভেবে চিকিৎসা করে, তারা বেশি দিন জেলখানায় থাকতে পারে না। অনেক ডাক্তার দেখেছি এই জেলখানায়, যারা কয়েদিদের ডায়েট দিতে কৃপণতা করে না, অসুস্থ হলে ভাল ওষুধ দেয়। আবার অনেক ডাক্তার দেখেছি যারা কয়েদিদের কয়েদিই ভাবে, মানুষ ভাবে না, রোগ হলে ওষুধ দিতে চায় না। পকেটে করে ওষুধ বাইরে নিয়ে বিক্রি করে। ঘুষ খায় চিকিৎসার নামে। আবার টাকা পেলে হাজতিদের মাসের পর মাস হাসপাতালে ভর্তি করে রাখে, ব্যারাম নাই যদিও। এভাবে বাইরের থেকে জামিনের চেষ্টা করা যায়। ম্যাজিস্ট্রেট যখন জেলখানায় দেখতে যায় কয়েদিদের অবস্থা, তখন হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি দেখিয়ে দেয়। এতে জামিন পেয়ে যায়। বাইরে থেকে বিচারাধীন আসামির কেউ হয়ত কোন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে টাকা পয়সা দিয়ে গেছে, বলে গেছে জামিন হলে আরও দেবে। যার অসুখ নাই তাকে মাসের পর মাস হাসপাতালে সিট দিয়ে রেখে দিয়েছে, আর যে সত্যিই রোগী তার স্থান নেই। আবার এমন ডাক্তার দেখেছি যারা জেলখানায় পানিও মুখে দেয় না, ঘুষ তো দূরের কথা। রোগীদের ভালভাবে চিকিৎসা করে, রাতদিন পরিশ্রম করে। আবার এমন ডাক্তারও জেলে দেখেছি, সুন্দর চেহারা। মুখে দাড়ি, নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ পড়ে গেছেÑ দেখলে মনে হয় একজন ফেরেস্তা। হাসপাতালের দরজা বন্ধ করে কয়েদি রোগীদের ডায়েট থেকে ডিম, গোস্ত, রুটি খুব পেট ভরে খান, আর ওষুধও মাঝে মাঝে বাইরে নিয়ে বিক্রি করেন।’
বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত অভিজ্ঞতা আজ থেকে ৬০-৬৫ বছর আগের। সময় অনেক গড়িয়েছে। দেশও অনেক এগিয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালী ও বিত্তবান হাজতী-কয়েদীদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ডাক্তারদের ম্যানেজ করে মাসের পর মাস জটিল কোন রোগে অসুস্থ না হয়েও হাসপাতালে চিকিৎসার নামে দিন কাটানোর সংবাদ আমরা প্রায়শ জানতে পারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত সংবাদ থেকে।
৮ মার্চ, ১৯৭৫ টাঙ্গাইলের কাগমারীতে মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের শতকরা ২৫ ভাগ দুঃখ দূর হয়ে যাবে যদি দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যায়। যার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে সেই মানুষ হয়, সে জন্য আমি চাই মনুষ্যত্ব ফিরে আসুক। আজ দুঃখের সঙ্গে আমাকে বলতে হয় যে, আজকে আমরা অনেকে দুর্নীতিবাজ হয়ে গেছি। তারপর আমরা দুর্নীতিবিরোধী বক্তৃতা করি। লজ্জার মাথা নত হয়ে যায় আমার। আমি অনুরোধ করব যে, আত্মশুদ্ধি করে মানুষ হও। তা হলে মানুষকে মানুষ করতে পারবা। আমার অনুরোধ ভাইয়েরা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম চাই।’
ওই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আপনারা কেন দুর্নীতি করেন আমাকে বুঝায়া বলেন তো। আজ হোক, কাল হোক, এই যে কথা বলেছি, এই যে আপনারা বসে আছেন, কেউ কি বলতে পারেন বুকে হাত দিয়ে যে, কাল সকালে আমি বেঁচে থাকব? আল্লাহর হাতে আপনার মৃত্যু। আজও মরতে পারি। এক ঘণ্টা পরেও মরতে পারি। তাহলে কেন আপনারা দুর্নীতি করবেন? মরার সময় কী নিয়ে যাবেন? তাহলে কেন দুর্নীতি করবেন? রাতে যদি চিন্তা করেন যে আজ ঘুমের মধ্যে আরা মরতে পারি, তাহলে আর দুর্নীতি করতে পারবেন না।’
১৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একদল লোকের পয়সার লোভ অত্যন্ত বেড়ে গেছে। পয়সার জন্য তাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মৃত্যুর পর এ পয়সা তাদের কোন উপকারে আসবে না। পয়সায় যদি তাদের সন্তানরা মানুষ না হয়, তাহলে তারা নানা অপকর্মে তা উড়িয়ে দেবে। তাতে তারা লোকের অভিশাপ কুড়িয়ে আখেরাতেও শান্তি পাবে না। আপনারা একবার আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দুর্নীতির উর্ধে থাকব।’ প্রতিজ্ঞা করুন আমরা দুর্নীতিবাজ খতম করব।’
২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণে (সংসদে এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর শেষ ভাষণ) বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ছিল, ‘যদি সকলে মিলে আপনারা নতুন প্রাণে নতুন মন নিয়ে খোদাকে হাজির-নাজির করে, নিজের আত্মসংশোধন করে, আত্মশুদ্ধি করে, ‘ইনশাআল্লাহ্্’ বলে কাজে অগ্রসর হন, তাহলে জানবেন, বাংলার জনগণ আপনাদের সঙ্গে আছে, বাংলার জনগণ আপনাদের পাশে আছে। ইন্্শাআল্লাহ্্ আমরা কামিয়াব হবই।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রায় ৪৫ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। এ বছর জাতি পালন করছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, দেশে দুর্নীতি আরো বিস্তৃত হয়েছে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে দুর্নীতি দমন এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশ কয়েক দফায় (২০০১-২০০৫) দুর্নীতিতে বিশে^র মধ্যে শীর্ষ অবস্থান করে নিয়েছিল। বিদেশে অর্থ পাচারকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন আলোচনার বিষয়। শেয়ার মার্কেট, বিভিন্ন ব্যাংক লুণ্ঠন, ভুয়া আমদানি-রফতানির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার ও আত্মসাত, সরকারী-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের কেনাকাটা-টেন্ডার, চাকরিতে নিয়োগে অবাধ লাগামহীন দুর্নীতি, ঘুষ ছাড়া সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে সাধারণ জনগণের সেবা না পাওয়ার বিস্তর অভিযোগ। বিস্ময়ের বিষয় এই যে, প্রকৃত দোষীদের বিচারের আওতায় নিয়ে এসে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না।
বঙ্গবন্ধু তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন যে, দেশের শতকরা পাঁচ ভাগ শিক্ষিত লোক দুর্নীতি করে। কিন্তু আজকের বাস্তবতা হলো, বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত সোনার বাংলায় পরিসংখ্যান করার সময় এসেছেÑ ‘কতভাগ শিক্ষিত লোক দুর্নীতি করে না বা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় না বা নিজে দুর্নীতি না করলেও নিজের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে ও ভয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না।’
দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের নির্বাহী ও বিচার বিভাগের আরও দৃঢ়, কঠোর ও ত্বরিত ভূমিকা এবং দায়িত্ব পালন এখন সময়ের চাহিদাÑ বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে এ বিষয়ে চিন্তা, পরিকল্পনা ও যথাযথ আন্তরিক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তার সফল বাস্তবায়নেই হবে তাঁর প্রতি রাষ্ট্রের নির্বাহী ও বিচার বিভাগের প্রকৃত শ্রদ্ধা।
লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ