1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার প্রতিবাদে প্রথম মিছিল এবং হরতাল

অজয় দাশগুপ্ত : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ৩ নভেম্বর, ২০২১

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কে হত্যা করেছিল? তার পরিবারের সদস্যদেরইবা কেন হত্যা করা হয়েছিল? ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেইবা কেন জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে গভীর রাতে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়েছিল?

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে- তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। ঘাতকের উদ্যত মারণাস্ত্রের মুখেও তিনি ছিলেন নির্ভিক, ধীরস্থির। খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. জিল্লুর রহমান খান ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সম্মোহনী নেতৃত্ব ও স্বাধীনতার সংগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন-

“ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির একতলা ও দোতলার সংযোগ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যদি বাঙালিরা তাদের জাতির পিতাকে হত্যা করতে চায়, তিনি জীবন দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। কিন্তু এর পরিণতি বাঙালিদের জন্য শুভ হবে না। তাদের জীবন কখনোই আগের মতো হবে না এবং তাঁকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রকেও তারা হত্যা করবে এবং মানবিকতা বিদায় নেবে।” (পৃষ্ঠা ২৬১)

তিনি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সামনে বুক চিতিয়ে ঘাতকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাকে হত্যা করা হয়, গণতন্ত্র বিদায় নেয়। মানবিকতা ভূলুণ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে সরে যায়। যে জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের মার্চে সেনাবাহিনীতে মেজর পদবিধারী ছিলেন, পাকিস্তানের ২৪ বছরের দুঃশাসন, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে কখনও একটি শব্দ যিনি উচ্চারণ করেননি, এমনকি ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি বাংলায় শুদ্ধভাবে লিখতে পারতেন না- তাকেই প্রচার করা

হতে থাকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে। খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে মার্শাল ল জারি করেন। আর সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পিত হয় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ওপর। তাকে ২৪ আগস্ট সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর গভীর রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করা হয়। খন্দকার মোশতাক বঙ্গভবন থেকে জেলরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এ হত্যা সংঘটনে বাধা না দিতে। জেলহত্যার পর একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা পুরোপুরি কবজা করে এ কমিশনকে কাজ করতে দেননি।

খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর যে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার বন্ধ করার জন্য, জিয়াউর রহমান সেটাকে আইনে পরিণত করেন ১৯৭৯ সালের জুলাইয়ে। সেটা ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট, সামরিক শাসন বহাল রেখে জিয়াউর রহমান যার নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন ওই বছরেরই ১৮ ফেব্রুয়ারি। তিনি ততদিনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে গেছেন।

১৯৭৮ সালের জুনে এ নির্বাচন হয়েছিল সামরিক শাসনের মধ্যেই। এর আগে জিয়াউর রহমান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে কিছুদিন অধিষ্ঠিত রেখেছিলেন শিখণ্ডী হিসেবে। তিনি ‘বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি’ গ্রন্থে লিখেছেন-

“রাজনীতিকরা আলাপ-পরামর্শের জন্য সেনানিবাসে যেতেন (যেখানে বসবাস করতেন সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমান)। বঙ্গভবনে থাকতেই আমি তা জেনেছি। অবশ্য আওয়ামী লীগ সেখানে যেত না।” [পৃষ্ঠা ১৮]

জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার শীর্ষে ওঠা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন- “…কীভাবে সেনাপ্রধান (জিয়াউর রহমান) একটি স্থায়ী সার্ভিসের অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন এবং সেইসঙ্গে স্থল, নৌ ও বিমান- তিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যেকটির ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলেছিলেন। এ সব পদে জেনারেল ইয়াহিয়া বহাল ছিলেন বাংলাদেশের চূড়ান্ত মুক্তি ও বিজয়-লাভ করা পর্যন্ত।” [পৃষ্ঠা ২২]

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রধান হোতা জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের তুলনা করা হয়েছে এ মন্তব্যে। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে সরিয়ে নিতে যার ভূমিকা ছিল মুখ্য, সেই জিয়াউর রহমানকে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তুলনা যথার্থ বৈকি।

বঙ্গবন্ধু হত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়নি- এটা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের কু-কর্মের সহযোগীরা কতবার যে বলেছে! কিন্তু সামরিক শাসনের মধ্যে প্রতিবাদ কি সহজ? আর প্রতিবাদ হলেও সেটা প্রচারের কোনো সুযোগ ছিল না। সামরিক আইনের কারণে সংবাদপত্র ছিল কঠোর সেন্সরশিপের আওতায়।

বেতার ও টেলিভিশন ছিল বরাবরই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। মোশতাক-জিয়া চক্র বঙ্গবন্ধু হত্যার যেকোনো উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই মাসের বেশি বন্ধ ছিল। রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়। আমরা জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিই- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সঙ্গে সঙ্গেই (১৮ অক্টোবর, ১৯৭৫) প্রতিবাদ কর্মসূচি নেয়া হবে।

আমাদের কর্মীরা বিভিন্ন অনুষদ ভবনে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এবং এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে’ স্লোগান লিখে ফেলে। ২০ ও ২১ অক্টোবর মধুর ক্যান্টিন থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মিছিল বের হয়। এরপর আমরা ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলা থেকে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসভবন পর্যন্ত শোক মিছিল নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করি। সে সময় এটা ছিল দুঃসাহসী উদ্যোগ। মোশতাক-জিয়া এবং তাদের অনুসারীরা দম্ভ করে বলেছিল- ‘শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করলে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হবে।’

যারা বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের নারী-শিশুসহ হত্যা করতে পেরেছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চারনেতাকে ব্রাশফায়ারে মেরে ফেলেছে, যারা আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীদের নির্বিচারে কারাগারে প্রেরণ করেছে- তারা কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে সেটা আমদের জানা ছিল। কিন্তু আমরা ৪ নভেম্বর (১৯৭৫) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় সমবেত হই। সামরিক বাহিনী, তৎকালীন বিডিআর ও পুলিশ বাহিনী আমাদের পথে নানা স্থানে বাধা দেয়। আমরা সেটা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু ভবনে পৌঁছাই।

সেখান থেকেই আমরা পরদিন বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকায় হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করি। হরতাল পালন শেষে বায়তুল মোকারকম দক্ষিণ গেটে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করা হয়। ৬ নভেম্বর বটতলায় অনুষ্ঠিত সমাবেশেও একই দায়িত্ব ধ্বনিত হয়।

৪ নভেম্বর বিকেলে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট অধিবেশন। সেখানে ছাত্র প্রতিনিধি অজয় দাশগুপ্ত, মাহবুবজামান ও ইসমত কাদির গামা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও দেশের সেরা ক্রীড়াবিদ সুলাতানা কামাল খুকি এবং অনন্য ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠক শেখ কামাল হত্যার নিন্দা জানান হয়। দাবি ওঠে ঘাতকদের বিচারের।

দুর্ভাগ্য, এ বিচার সম্পন্ন হতে আমাদের প্রায় ৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু তাতে প্রথম প্রতিবাদ ম্লান হয়ে যায় না। আমরা কঠিন সময়ে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পেরেছিলাম সেটা নিয়ে গর্ববোধ করতেই পারি। পরে এ পথে অনেকে এগিয়ে এসেছেন, অনেকে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন- কারোবা প্রাণ গেছে। তাদের অবদানের কথাও আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

লেখক: অজয় দাশগুপ্ত, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ