1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়মুক্তি দিল কে?

রেজা সেলিম : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২১

বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্য কুশীলবরা শুধু ’৭৫ সালেই তৎপর হয়েছিলেন এমন নয়, এদের পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। এ যাবৎকালে প্রাপ্ত সব তথ্য সাজিয়ে নিলে দেখা যায় কয়েকটি মোটা দাগে এসব পরিকল্পনার ছক আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় যার উদ্দেশ্যমূলে আছে-

১. প্রকৃতই হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে অপরাধীদের মুক্ত রাখা, চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা ও

২. কুশীলবদের অপর একটি অংশ সরকারের দায়িত্বভার নেয়া। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যারা এই কাজে এই দুই অংশকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জগতে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে সহায়তা করেছে ও যে সহায়তা ছাড়া এদের পক্ষে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংঘটনের কাজ কখনও সম্ভব ছিল না ও হত্যাকাণ্ড-উত্তর রাষ্ট্রকে স্বাধীনতার মৌলিক নীতি থেকে সরিয়ে নিয়ে উল্টোমুখী নীতি স্থাপন করে পরিচালনা করা কখনই সম্ভব হতো না তারা কারা? ইতিহাসের তথ্য প্রমাণে দেখা যায়, বাংলাদেশের এই তথাকথিত ‘ক্রান্তিলগ্ন’ তৈরি করে তাকে ভিন্ন ভাবধারায় পরিচালনার জন্যে

স্বাধীনতার পর পরই এদেশে যেসব অবাস্তব রাজনৈতিক তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছিল সেসব অর্বাচীন দার্শনিকেরা ইতিহাসের এই রূপান্তর পটের জন্যে কম দায়ী নয়। এসব তত্ত্বভূতের নায়কেরা বঙ্গবন্ধু সরকারকে অশান্ত করে রাখতে কোনো একটি শক্তির কাছে দায়বদ্ধ ছিল যার প্রমাণ ৩-৭ নভেম্বরের অস্থির সময়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা কিন্তু আর একটি অক্ষ শক্তির ক্রীড়নক হয়ে তারা পরাস্ত হয়েছিল কারণ সে পরাশক্তির কৌশল বুঝবার ক্ষমতা তাদের ছিল না।

দ্বিতীয়ত, আমাদের মিলিয়ে দেখতে হবে বঙ্গবন্ধুহত্যা সংঘটনের পর কারা বেশি সুবিধা ভোগ করেছে? খন্দকার মোশতাক, নাকি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দেবার ওই ১২ জন অপরাধী নাকি পরেরকালের সরকারপ্রধান জিয়াউর রহমান ও এরশাদ? আমাদের প্রশ্ন মোশতাকের আমলের আপত্তিকর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বহাল রাখল কেন? এরশাদ শুধু তা বহালই রাখেনি হত্যাকারীদের রাজনীতিও করতে সুযোগ দিয়েছে, এমনকি সংসদেও যাবার পথ করে দিয়েছে।

এমনকি সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে এসে খালেদা জিয়াও সে দায়মুক্তির আদেশ বহাল রেখেছে! পাঠক একবার ভাবুন, প্রকাশ্য স্বীকারোক্তি দেয়া হত্যাকারী যারা জাতির পিতাকে, একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করেছে আর তাদের সে হত্যাকে আইন করে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে, তারা দেশে বুক ফুলিয়ে রাজনীতি করেছে এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের আইনসভার নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে এসেছে- এসব তথ্য জেনে একটি গর্বিত স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেকের কাছে কী উত্তর আপনার দেবার আছে?

আমাদের তথ্য অনুসন্ধান ও গবেষণায় দেখা যাচ্ছে মোশতাক সরকারের সঙ্গে পরাশক্তির সম্পর্ক গঠনে যেসব আমলা ও কূটনীতিক ভূমিকা রেখেছেন তাদের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করা যা গুটিকয় দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা ছাড়া বেশিরভাগই করেননি কারণ তাদের চাকরি ও জীবন রক্ষার অজুহাত ছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করায় বা মেনে না নেবার ফলে কেউ কেউ নানারকম ঝামেলায় পড়েছিলেন ঠিকই কিন্তু বেসামরিক কাউকে মেরে ফেলা হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই। চাকরি বজায় রেখেও সে প্রতিবাদ করা যেত যদি বিবেকের দংশন তাদের থাকত।

তারা ভুলে গিয়েছিলেন যে বঙ্গবন্ধুর আপসহীন সংগ্রামের ফলে যদি বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডের জন্ম না হতো তারা কোনোদিন রাষ্ট্রদূত বা সচিব হওয়া তো দূরের কথা পাকিস্তানিদের গোলামি করেই নিম্নস্তরে থেকে চাকরির বেতন পেতে হতো, তাও কোনো স্বাধীন দেশের কর্তব্যপরায়ণ নাগরিকের অধিকারে নয়। কিন্তু যে সৌভাগ্যের দরজা বঙ্গবন্ধু তাদের খুলে দিয়েছিলেন প্রকৃতপক্ষে দেখা যায়, তারা সে আনুগত্যের বদলে বিশ্বাসঘাতকতাই করেছেন। সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তা, যাদের জিয়াউর রহমান ও এরশাদ বেছে বেছে ফাঁসি দিয়েছে, যদিও সেসব হত্যাকাণ্ডের ন্যায্যবিচার আজও হয়নি।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ৭ নভেম্বর রিয়াল অ্যাডমিরাল এম এইচ খানকে নৌ বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেন, যিনি দেখা গেল ৭৫-এর পট পরিবর্তনের পরে জিয়াউর রহমানের অধীনে উপ-সামরিক আইন প্রশাসক হলেন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি নথিপত্রে ১ জুলাই ১৯৭৬ সালে কিসিঞ্জারের লেখা একটি প্রতিবেদনে পাওয়া গেল এই অ্যাডমিরাল খানের দূতিয়ালি, ওয়াশিংটনে তখনকার রাষ্ট্রদূত এম আর সিদ্দিকীকে (বঙ্গবন্ধুর প্রথম সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী) নিয়ে ইউএস এইডের প্রশাসক ড্যানিয়েল পার্কারের সঙ্গে দেখা করতে যান ও জিয়াউর রহমা্নের সামরিক সরকারের জন্যে কৃষি-খাদ্য, রেলওয়ে ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়তা প্রার্থনা করেন যেগুলোর অধিকাংশই মঞ্জুর হয়।

এছাড়া অ্যাডমিরাল খান ছটি হেলিকপ্টার সহায়তা চাইলে পার্কার তা প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, সাহায্য সহায়তায় এরকম সুযোগ নেই। কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য এই প্রতিবেদনে আছে যা হলো- বঙ্গবন্ধুর আমলে কিউবায় পাট বিক্রয়ের অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র যে খাদ্য সহায়তা বন্ধ করেছিল অ্যাডমিরাল খান তা তুলে নিতে অনুরোধ করেন। উপস্থিত মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সহকারী সচিব গার্ডিনের থ্যাকার নিশ্চিত করেন যে তা মঞ্জুর করা হয়েছে (The Admiral asked that we consider a waiver to permit Bangladesh to sell Jute to Cuba. Gardiner confirmed that waiver has been granted).

এখন যদি আমরা প্রশ্ন করি কিউবার সঙ্গে পাট বিক্রয় নিয়ে কিসিঞ্জার যে হুলস্থুল করে বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করল, এক আলোচনায় তা প্রত্যাহার হলো কেমন করে? তাহলে পরের সরকারগুলো টিকিয়ে রাখতে যে মার্কিন চেষ্টা তার সঙ্গে এই বিবেকহীন সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের আর দায়মুক্তি পাওয়া খুনিদের পার্থক্য থাকল কোথায়!

এই দায়মুক্তির সুবিধা নিয়েছে মার্কিন ও চীন সরকার। পরের সরকারগুলোর আমলে এই দুই পরাশক্তি যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা তাদের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণ ছাড়াও বাংলাদেশকে আদর্শচ্যুত করতে যেসব পদক্ষেপ জিয়াউর রহমান নিচ্ছিলেন সেসব কর্মকাণ্ডকে প্রকারান্তরে বৈধতা ও সমর্থন দিচ্ছিল।

এরকম অমানবিক নৈরাজ্যে পরাশক্তির পুতুল হয়ে বা দাসত্ব মেনে স্বাধীন বাংলাদেশে পরাজিত রাজনৈতিক অপশক্তি ও আমলাতন্ত্রও মিলেমিশে একাকার হয়েছিল, যার মূল্য বাংলাদেশকেই দিতে হয়েছে। আর এ সুযোগে এদেশে জন্ম নিয়েছে একটি লুটেরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যে শ্রেণি পরবর্তীকালে আদর্শহীন রাজনীতি ও অপসংস্কৃতিচর্চার মধ্যে বিকশিত হয়ে বাংলাদেশকে তার বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র থেকে সরিয়ে নিতে প্রয়াস পেয়েছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে ঐতিহাসিক বন্ধন তা সাংস্কৃতিক। ১৯৭১ সালের মার্কিন নীতিতে তাকেও তুচ্ছ করে দেখা হয়েছিল যার প্রমাণ দেয় হোয়াইট হাউসের নিক্সন ট্যাপ ও সেসময়ের নথিপত্রে। ২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুরাগী মার্কিন গবেষক অধ্যাপক গ্যারি বাস লিখেছিলেন-

“নিক্সন এবং কিসিঞ্জার কেবল চৈতন্য বা ভারতের সোভিয়েতপন্থি ঝোঁকের গোপন কারণে পাকিস্তানের প্রতি সহায়তার বৈষম্যমূলক রিয়েলপলিটিক্স দ্বারা অনুপ্রাণিত হননি। হোয়াইট হাউসের অডিওগুলো নিক্সনের অভ্যাসগত অশ্লীলতা ও মানসিক ক্রোধেরই বহিঃপ্রকাশ। ওভাল অফিসে নিক্সন কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন- ভারতীয়দের ‘একটি বিশাল দুর্ভিক্ষের দরকার’ ছিল। কিসিঞ্জারও এমনই কটাক্ষ করেছিলেন যারা মৃত্যুমুখী বাঙালিদের জন্য রক্তপাত করেছিলেন। (Nixon and Kissinger were not just motivated by dispassionate realpolitik, weighing Pakistan’s help with the secret opening to China or India’s pro-Soviet leanings. The White House tapes capture their emotional rage, going far beyond Nixon’s habitual vulgarity. In the Oval Office, Nixon told Kissinger that the Indians needed “a mass famine.” Kissinger sneered at people who “bleed” for “the dying Bengalis.”)। এমন বিকৃত মার্কিননীতির সুবিধা কিসিঞ্জারের শেষদিন পর্যন্ত অব্যাহতই ছিল আর সে সুবাদে জিয়াউর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত প্রতিশোধপরায়ণ মৌলবাদী শক্তি, চীনাপন্থি বাম ঘরানার অপরাজনৈতিক শক্তি মিলেমিশে যে ক্ষমতাভোগী চক্রের জন্ম হয়েছিল ভারতবিরোধিতা ছাড়া আর কোনো অস্ত্র তাদের হাতে ছিল না।

আর আমরা জেনেশুনে পরবর্তীকালে ভারতের প্রতি অকৃতজ্ঞ রাজনৈতিক দাসে পরিণত হয়েছি কারণ বঙ্গবন্ধুহত্যার দায়মুক্তি সে পথ সহজ করে দিয়েছিল। ফলে, এখন এ কথা বলতে কোনোই দ্বিধা নেই যারা বঙ্গবন্ধুহত্যা পরবর্তীকালের সুবিধাভোগী তারা দায়মুক্তির সুবিধা নিয়েই নিজেদের ভোগ চূড়ান্ত করেছে। সুতরাং দায়মুক্তি আইনের বিলোপ বা হত্যাকারীদের বিচার হলেও এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে বের করা আর সুবিধাভোগীদের বিচারের কাজ।

পরিকল্পনাকারীদের চক্র তাদের কাজ সমাধা করে দিয়েছে বটে কিন্তু এর সুবিধা নিয়ে যারা কষ্টার্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের দর্শন, চিন্তা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি অপসমাজ গড়ে তুলেছে তার দায়ীদেরও বিচারের সন্মুখীন করা দরকার। এমন হতে পারে না যে কেউ এসে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে তার জন্মের ইতিহাস মুছে দেবে, বিকৃত করবে ও মিথ্যা ইতিহাস গড়তে সচেষ্ট থাকবে আর সেসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না। যদি এদের বিচার না করা হয় তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সব ত্যাগের তাৎপর্য মূল্য হারাবে।

লেখক: রেজা সেলিম, পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প, কলাম লেখক। rezasalimag@gmail.com


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ