1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক প্রয়াস

ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন-দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকা পৌঁছেছিলেন। মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার গঠনের সময় বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এসে পুনরায় সরকার গঠন করেছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন আর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল। প্রবাসী সরকারের সব মন্ত্রী নবগঠিত মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরের মতো তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। এই সময়টা বাংলাদেশের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি লাভ, জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তি ছিল সেই সময়কার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বঙ্গবন্ধু তার সময় মাত্র তিন-চারটি গুরুত্বপূর্ণ সফরে বিদেশ গিয়েছিলেন। এই সফর কয়টি তিনি কত যোগ্যতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন, তার কিছু নিয়ে আলোচনায় উদ্দেশ্যে আমার আজকের লেখা।
বিশ্বে তখন দুই পরাশক্তি—সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার আধিপত্য। আমেরিকা আগাগোড়াই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা বর্তমান রাশিয়া বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে ছিল। বঙ্গবন্ধু তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে যান সোভিয়েত ইউনিয়নে। তিনি ১৯৭২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ৫ দিনের সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন যান আর ৫ মার্চ দেশে ফিরে আসেন। সফরে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের একটা উড়োজাহাজও ছিল না। বঙ্গবন্ধুর সফরের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন একটি মধ্যম আকৃতির বিমান পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে একটি ব্যাকআপ বিমানও পাঠিয়েছিলেন।
আজকের রাষ্ট্রীয় সফরের মতো বঙ্গবন্ধুর সে দিনের সফর কোনও রাজকীয় আড়ম্বর ছিল না। ক্ষুদ্র একটি দল নিয়ে তিনি তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার দল নিয়ে রাত ২টায় বোম্বের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। বোম্বেতে মহারাষ্ট্র এবং গুজরাট রাজ্যের সরকার বঙ্গবন্ধুকে বীরোচিত সংবর্ধনা জানিয়েছিল। দুই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদ্বয় তাদের মন্ত্রিসভা নিয়ে বোম্বাই বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন আর এই গভীর নিশিতে বিমানবন্দরে লাখ লাখ লোক উপস্থিত ছিল।
বঙ্গবন্ধু তার জন্য নির্মিত মঞ্চে গিয়ে ১৫ মিনিটের এক বাংলা বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন। আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা শাহ এএমএস কিবরিয়া তাৎক্ষণিক তার ইংরেজি তরজমা পেশ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার পরেরদিন এগারোটায় জর্জিয়া হয়ে মস্কো বিমানবন্দরে পৌঁছেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এক অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা প্রদান করে। প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনসহ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা তাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তান প্রচার করেছিল বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের তাঁবেদার রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধুর প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের সিদ্ধান্ত ছিল সুদুরপ্রসারী সিদ্ধান্ত। বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধুকে শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেনি, তারা তাকে বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের নেতা হিসেবে বিমানবন্দরে গ্রহণ করেছিল এবং তাকে নির্যাতিত মানুষের মহান নেতার মর্যাদা প্রদান করেছিলেন। এতে পাকিস্তানের রটনার ভিত্তি হালকা হয়ে যায়।
পাকিস্তানের তখন সবকিছুর ভিত্তি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধকালে বাংলাদেশের আন্তরিক সহযোগিতা বাংলাদেশকে আরব দেশগুলোর কাছাকাছি নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু কিউবার পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম মেডিক্যাল টিম পাঠিয়ে ছিলেন সেখানে। এছাড়া ছয় হাজার স্বেচ্ছাসেবক পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যারা সবাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা।
যাহোক, সফরের সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন, প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পডগর্নির সঙ্গে বৈঠক হয়। তখন চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে বাংলাদেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। যুদ্ধের সময়ে বন্দরের প্রবেশমুখে ডুবোজাহাজ, ভাসমান মাইন ইত্যাদি পুঁতে রাখার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ চলাচল অনিরাপদ হয়ে যায়। যার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম বন্দর পরিষ্কারের দায়িত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর এই সফরের পরে সোভিয়েত বিশেষজ্ঞরা খুব দ্রুত বন্দর পরিষ্কারের কাজ শুরু করে দেয়। মোট ৮০০-এরও বেশি রাশিয়ান মেরিনার বঙ্গোপসাগরে মাইন অপসারণ অভিযানে অংশ নেয় ৭২ থেকে ৭৪ সাল পর্যন্ত। বাংলাদেশ এসব বীরকে ২০১৬ সালের বিজয় দিবসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তাদের মধ্যে কেবল চারজনই এসেছিলেন, কারণ তাদের অনেক সহকর্মী হয় বয়সের কারণে মারা গেছেন বা ভ্রমণ করতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধুর সোভিয়েত সফর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়িয়ে উজ্জ্বল করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর সোভিয়েত সফরের পর পর, ১৯৭২ সালের মার্চ মাসেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোও মস্কো সফর করেন। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক নর্মাল করে দেওয়ার জন্য সোভিয়েত নেতাদের অনুরোধ করেন।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সফর ছিল ওআইসি সম্মেলন উপলক্ষে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান সফর। এই সফর নিয়ে বাংলাদেশ খুবই কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এই সফরের বিরুদ্ধে ছিলেন। আবার ওআইসিতে যোগদান করলে ভারতও অসন্তুষ্ট হবে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের মালিক রাষ্ট্রগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার পক্ষে কোনোভাবেই ছিলেন না। এই সম্মেলনে যোগদান প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু তার নিজের এবং বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তাকে প্রকাশ করেছিলেন। অনেক মন্ত্রী এমন কথাও মন্ত্রিসভার মিটিংয়ে বলেছিলেন—সম্মেলনে যদি যোগদান করতেই হয় তবে দিল্লি হয়ে যাওয়াই উচিত হবে।
অন্যদিকে লাহোরে ওআইসি সম্মেলনের আগের দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সভায় সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওআইসির একটি প্রতিনিধি দল তাৎক্ষণিক বঙ্গবন্ধুকে আমন্ত্রণ জানাতে ঢাকায় আসে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো লাহোরে সংসদে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের ঘোষণা দেন। পরে বাংলাদেশও পাকিস্তানকে পাল্টা স্বীকৃতি দেয়।
শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে সরাসরি পাকিস্তান গিয়েছিলেন। নিজের দেশের সার্বভৌমত্বকে কোনও দেশের কাছে জামিন রেখে বঙ্গবন্ধু কোনও কাজ করতে রাজি ছিলেন না, সেটা তিনি বুঝিয়ে দেন। সম্মেলনে যোগদানের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ এবং তৎপরতা মুসলিম বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি জেলে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা বিপুলভাবে সংবর্ধনা দিয়ে গ্রহণ করেছিল। রাজনীতির এটি এক বিরাট লীলাখেলা।
দেশে দেশে বিরোধ থাকবে, এজন্য পরস্পর পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে—এমন নীতিতে বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন না। সেকারণে ‘Friendship to all and malice towards none বা ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়’—এই নীতিকে পররাষ্ট্রনীতি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যা আজও বাংলাদেশ মেনে চলে।
সাহসী পুরুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪ সালের জুনে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। বাংলাদেশে এসে ভুট্টোও ব্যাপক অভ্যর্থনা পান সাধারণ মানুষের। বলা হয়, ভুট্টো সাভারে স্থাপিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতে চাননি শহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে। বঙ্গবন্ধু নাকি তখন তাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, তুমি যদি সাভারে না যাও তবে আমি তোমার সফর এখনই বাতিল করে দেবো। তখন ভুট্টো ভালো ছেলের মতো সাভারে গিয়েছিলেন।
সৌদি বাদশাহ ফয়সাল ইসলামিক বিশ্বে পোপের ভূমিকায় ছিলেন। পাকিস্তানের প্রভাবে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে দেরি করে। আলজেরিয়া বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পর পরই স্বীকৃতি দেয়। দুই দেশের সম্পর্ক আরও বেড়ে গিয়েছিল যখন বঙ্গবন্ধু প্রথম সরকার প্রধান হিসেবে আলজিয়ার্সে ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। ন্যাম সম্মেলনের ফাঁকে সৌদি বাদশাহ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, বাংলাদেশ তার নামের আগে ইসলামিক রিপাবলিক বসালে সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। সৌদি বাদশাহের জবাব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বিনয়ের সঙ্গে বাদশাহকে বলেছিলেন, আপনার দেশের নামের আগে রেখেছেন কিংডম অব সৌদি আরবিয়া, আর আপনি আমার দেশের নামের আগে চাচ্ছেন ইসলামিক রিপাবলিক লিখতে!
ফিদেল ক্যাস্ত্রোর কথাই মনে হয় যথাযথ। আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ২০২০ সালে তার জন্মশতবর্ষে এসেও আমাদের অনেকে উপলব্ধি করতে পারছি না—বাংলাদেশের জন্য কত বড় হিমালয় ছিলেন এই শেখ মুজিব।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ