1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

২১ আগস্ট: নির্মম বিভীষিকার সেই বিকেল : জাফর ওয়াজেদ

ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ২০ আগস্ট, ২০২১

জাফর ওয়াজেদ : সেই দৃশ্যপটের দিকে এখনো চোখ মেলে তাকাতে পারি না। কী বীভৎস! কী নির্মম বিভীষিকাময় সেইসব চিত্রাবলি। রক্ত আর মানবদেহের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খণ্ড খণ্ড টুকরো রাস্তাজুড়ে, আর্তনাদের পাশাপাশি পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ, আহতদের হাসপাতালে নিতে বাধা প্রদান, সরকারি হাসপাতালের গেট বন্ধ কিংবা চিকিৎসা প্রদানে অপারগ চিকিৎসক- এমন অমানবিকতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল ১৬ বছর আগে রাজধানী ঢাকায় রাজনৈতিক নেতাকর্মী আর জনসভায় আগত শ্রোতাদের।

ববর্রতার নিকৃষ্ট উদাহরণ সেদিন তৈরি হয়েছিল। প্রাণহরণের খেলায় মেতেছিল তৎকালীন সরকার তথা রাষ্ট্র। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় চালানো হয়েছিল গণহত্যা। খুবই সুপরিকল্পিতভাবে এক সংগঠিত শক্তি সংঘটন করেছে এই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। সভ্যতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বর্বরতার আশ্রয় নেওয়া শক্তি ক্ষমতার দণ্ডমুণ্ড সেজে যে ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি করেছিল, তাতে লক্ষ্যবস্তু নিশ্চিহ্ন করা না গেলেও গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন অনেকেই। এই পাশবিকতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অমানবিক আচরণের উল্লম্ফন সেদিন দেখেছে দেশবাসীসহ বিশ্ববাসী।

সভ্যতাকে ছিন্নভিন্ন করে অসভ্যতার বিস্তার ঘটানো হয়েছিল সেদিন সরকারি উদ্যোগে। অগণতান্ত্রিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ বুঝি এই গণহত্যা; যা ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে সংঘটিত গণহত্যাকেও হার মানিয়েছিল। শেখ হাসিনাকে হত্যার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলেও প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল ২৪ জন সাধারণ মানুষসহ রাজনৈতিক কর্মীকে। সামরিক জান্তা শাসক সরকারি বাহিনীকে সেদিন ব্যবহার করেছিল। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে ট্রাকযোগে লালদীঘি ময়দানে যাচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। সেখানে জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। তাঁর গাড়িবহর লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছিল। সেদিন আইনজীবীরা আদালত থেকে বেরিয়ে এসে শেখ হাসিনাকে ‘কর্ডন’ করে রেখেছিলেন। এরপর শেখ হাসিনা আদালত ভবনে আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে ভাষণও দেন। এরশাদ সেদিন ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার পোষ্য বাহিনী পাকিস্তানফেরত সেনা কর্মকর্তা, যিনি জান্তা শাসনকালে পুলিশে যোগ দিয়ে পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনার হয়েছিলেন। তারই নির্দেশে সংঘটিত হয়েছিল গণহত্যা, যার বিচার এখনো ঝুলন্ত। সভ্যতা সেদিনও ধুলায় লুণ্ঠিত হয়েছিল।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বাঙালির ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক এবং মর্মান্তিক অধ্যায়ের আরেক নাম। বর্বর শাসক প্রশাসন এবং জঙ্গীদের সম্মীলনে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য সেদিন আবারও উদ্যোগী হয়েছিল। এজন্য তারা সেদিন যে পথ বেছে নিয়েছিল, তা মানবসভ্যতাকে বিদ্রূপ করার নামান্তর। সভ্যতা মূলত মানবজীবনের আধার। মানবতা বলতে যা বোঝায়, তারও আধার। মানুষ জানে, সভ্যতার অগ্রগতির সামগ্রিক অর্থ মানুষেরই অগ্রগতি। সভ্যতার অগ্রগতির অর্থ দাঁড়ায় পারিপার্শ্বিকতার অগ্রগতি বা নিরন্তর বল। যদিও তাতে মানবসমাজের অগ্রগতি হয় না। কোনো ক্ষেত্রে অগ্রগতি কিছু মানুষের হয়, কোনো ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শ্রেণির।

মানবতা জান্তা শাসক ও তার উত্তরসূরির হাতে বারবার লাঞ্ছিত হয়েছে। আইভী রহমানের পা-বিহীন রক্তাক্ত সেই ছবিটির দিকে আজও তাকাতে পারি না। মাতৃসম মহীয়সী নারী ছিলেন তিনি। পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। ১৯৮০ সালে ডাকসু নির্বাচনে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে ছাত্রলীগের কাদের-চুন্নু পরিষদ থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বাসায় ডেকে নিয়ে নিজ হাতে রান্না করা খাবার খাইয়েছিলেন। স্বামী জিল্লুর রহমানের স্নেহ ও আশীর্বাদও পেয়েছি। ১৯৮৪ সালে আওয়ামী লীগের ১৫ আগস্টের সংকলন সম্পাদনা পরিষদের সদস্য হিসেবে জিল্লুর রহমান ও আইভী রহমানের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। তাঁরা তখন থাকতেন মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে, আর আমি পৈতৃক নিবাস বাবর রোডে। তাঁদের বাসার সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হতো। কত কাছের মানুষ ছিলেন দুজন।

পঁচাত্তর-পরবর্তী ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে ‘সংস্কৃতিসভা’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম আইভী রহমানের পরামর্শে। এই সংগঠনে তাঁর কন্যারাও ছিলেন। আয়োজিত অনুষ্ঠানে ও রিহার্সেলে তানিয়া ও তনিমারা গাইতেন। নেত্রী সাজেদা চৌধুরী, নেতা মালেক উকিলের কন্যারাও এই সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন। টিএসসিতে রিহার্সেল হতো। মাঝেমধ্যে জিল্লুর রহমান ও আইভী রহমান একসঙ্গে কিংবা পৃথকভাবে রিহার্সেল দেখতে আসতেন। নানা পরামর্শ দিতেন। সুন্দরের পূজারি এই নেতানেত্রীরা কর্মীদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত মানবিক ও উদার। তাদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াতেন। সংসার, রাজনীতি ও সমাজকর্ম- সবকিছুই সুচারুভাবে পালন করতেন বেগম আইভী রহমান। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাশবিক, অমানবিক আক্রমণের শিকার হলেন তিনি। হাসপাতালে তিনদিন কষ্টকঠিন অবস্থায় কাটিয়ে চলে গেলেন অনন্তলোকে। কী অদ্ভুত! হামলাকারীদের নেত্রী খালেদা জিয়া ২৩ আগস্ট বিকালে সিএমএইচ-এ দেখতে গিয়েছিলেন আইভী রহমানকেই। তিনি বোধহয় দেখতে এসেছিলেন, বীভৎসতার স্বরূপ। সর্প হয়ে দংশন করলেও ওঝা হয়ে ঝাড়তে আসেননি। নিজের কৃতকর্মের ফল তিনি দেখেছিলেন সানগ্লাসের আড়াল থেকে। এই বেগম জিয়াই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, গ্রেনেড হামলা আওয়ামী লীগ নিজেরাই ঘটিয়েছে। শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। কী নির্মম ভাষ্য! মিথ্যাচারে পূর্ণ এসব ঘৃণ্য ভাষ্য মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছিল।

যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যে গ্রেনেড এবং সেনাবাহিনী যা ব্যবহার করে, সেই গ্রেনেড ব্যবহৃত হয়েছিল আওয়ামী লীগের জনসভায়। বিস্ফোরণের পর সভাস্থলে উপস্থিত পুলিশ আহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি। বরং লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় উদ্ধারে আসা মানুষজনকে। জনসভা চলাকালে মঞ্চের পেছনে থাকা সাংবাদিকদের মধ্যে আমিও ছিলাম। ‘পূর্ণিমা’ নামক খাবার দোকানে জিলাপি খাওয়ার জন্য শ্রমিকনেতা হাবিবুর রহমান আকন্দ আমন্ত্রণ জানালে তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলাম বলে হামলার শিকার হইনি। আহতদের উদ্ধারে যখন দু’জন এগিয়ে যাই, পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হই পিঠে। এরপরই টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় চোখ জ্বলতে থাকে। রুমাল ভিজিয়ে চোখ রক্ষার চেষ্টাও একসময় ব্যর্থ হয়। আহতদের আর্তনাদে এবং পুলিশি হামলার শিকার যারা হয়েছিলেন তাদের চিৎকারে রমনা এভিনিউয়ের আকাশ-বাতাস তখন ভারী। তারই আগে শেখ হাসিনার গাড়ি লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলি হতচকিত করেছিল আমাদেরও। সেসব ঘটনা ভাবতে গেলে মানসিক চাপের মুখোমুখি হতে হয় আজও।

কেন সেদিন গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল? খালেদা জিয়ার জ্ঞাতসারেই যে সবকিছু ঘটেছিল, তা স্পষ্ট হয় এই ঘটনার কয়েকদিন আগে প্রকাশ্য এক জনসভায় তার ভাষণে। বেগম জিয়া বলেছিলেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, কোনোদিন বিরোধীদলীয় নেতাও হতে পারবে না। এই বক্তব্যের বহিঃপ্রকাশই দেখা গেল ২১ আগস্টে। অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই আর কোনো দিন বিরোধীদলীয় নেত্রী হতে পারবে না।

এ ঘটনার আগে ‘হাওয়া ভবন’স্রষ্টা তারেক রহমান ধানমন্ডিতে শ্বশুরবাড়িতে টানা ১০ মাস থাকার পর ১ আগস্ট সেনানিবাসের বাসায় মায়ের কাছে ফিরে যায়। এই ঘটনা তাৎপর্যবহ। কেননা এই হামলার সঙ্গে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। জাতির পিতা শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হলেও তার দুই কন্যা প্রবাসে থাকায় বেঁচে যান। ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তা শাসক জিয়া তাদের দেশে ফিরতে দেননি। দেশি-বিদেশি চাপে ১৫ আগস্টের পাঁচ বছর পর শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে আসতে দিতে বাধ্য হয় জিয়া। শেখ হাসিনা তত দিনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়েছেন। দেশে ফেরার পরও তাঁকে পৈতৃক বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। পিতার কবরেও যেতে দেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনার এই বেঁচে থাকা জিয়ার কাছে ছিল সহ্যাতীত। দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনাকে আরও ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার বেঁচে থাকাটাও খালেদা-তারেকের কাছে সহ্যাতীত হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালে তারেক বগুড়ার জনসভায় হাত নাড়িয়ে বলেছিলেন, তাদের কচুকাটা করতে হবে ধান কাটার কাস্তে দিয়ে। ইউটিউবে এই ভাষণ এখনো দেখা যায়।

একুশে আগস্টের নৃশংস ঘটনার সঙ্গে তারেক ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত জোটের মন্ত্রী, এমপিরাও জড়িত ছিল বলে শুনানিতে বলা হয়েছে। মন্ত্রীর বাড়িতে বসে পরিকল্পনা হয়েছিল হামলার। সেনা ব্যবহৃত গ্রেনেডও তারাই জোগাড় করেছিল। আইভী রহমানসহ নিহত ২৪ জনের আত্মা আজও কেঁদে বেড়ায়। আর ক্ষোভে ফেটে পড়ে খালেদা গং- কেন হাসিনা বেঁচে আছে? এই হত্যাকাণ্ডের দায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ওপরও বর্তায়। ঘটনার পূর্বাপর তার বক্তব্য ও আচরণ প্রমাণ করে- এই হত্যা ছিল তার কাঙ্ক্ষিত। শেখ হাসিনা অলৌকিকভাবে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদাকে কেন এই মামলার আসামি করা হলো না, জানেন তদন্ত কর্মকর্তারা ও আদালত। পাকিস্তানে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকে হত্যার নির্দেশের অভিযোগে কুখ্যাত ভুট্টোর ফাঁসি হয়েছিল। অথচ দুর্বল তদন্তের কারণে খালেদা জিয়া পার পেয়ে গেলেন।

খালেদা জিয়া দেশবাসীকে বোকা ভাবেন বলেই আসল ঘটনা আড়াল করে জনগণকে বোঝাতে চেয়েছেন, আওয়ামী লীগাররাই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল। শেখ হাসিনা নিজেই এই হামলার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু ম্যাডাম উপলব্ধি করতে পারেননি- ছাই চাপা থাকে না। তার পুত্র ও দলীয় নেতাকর্মীরা যে এতে জড়িত ঘটনার ১৪ বছর পরও জনগণ তা-ই জানে। সেদিনের হামলায় সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছেন অনেকে। দলের সাধারণ সম্পাক ওবায়দুল কাদের আজও স্প্লিন্টার বহন করে চলেছেন।

হত্যার পর হামলাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে জজ মিয়া নাটকও সাজানো হয়েছিল। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের লালনকারী বেগম জিয়া ২১ আগস্ট সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ ভণ্ডুল করতে পাল্টা সন্ত্রাস চালিয়েছিলেন সেদিন। শেখ হাসিনা এখন ‘এক্সটেনশন’ জীবন কাটাচ্ছেন। মৃত্যুভয় তাঁকে ভীত করে না। আদিম হিংস্র মানবতার ধারক হয়ে খালেদা জিয়া সেদিন যা করেছেন, দেশবাসী আগামী নির্বাচনে তার উপযুক্ত জবাব দেবেই।

লেখক: মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ