1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বিশিষ্টজনের স্মৃতিতে বেগম মুজিব

রায়হানা রহমান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ৮ আগস্ট, ২০২২

বেগম ফজিলাতুন নেছা সম্পর্কে তাঁর নিকটজনের স্মৃতিচারণগুলো ইতিহাসের উপকরণ হিসেবে গণ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বেগম ফজিলাতুন নেছার পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থা তাদের স্মৃতিচারণে দেখা যায়। বিশেষ করে বেগম মুজিব যে বঙ্গবন্ধুর শুধু স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন তাই নয়, তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পরামর্শকও। মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন বেগম মুজিব? বেগম ফজিলাতুন নেছার ৯২তম জন্মদিনে কয়েকজন বিশিষ্টজনের স্মৃতিচারণ থেকে সেই জবাবই খুঁজব।

ড. রফিকুল ইসলাম
‘এরপর তিনি শেখ হাসিনাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার স্যারকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাও।’ হাসিনা আমাকে ৩২ নম্বর বাড়ির বসার ঘর থেকে আর একটি ঘরের ভেতর দিয়ে অন্দরমহলে নিয়ে গেলেন। ই ঘরে সারি সারি চৌকি পাতা। হাসিনা তাঁর মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

বেগম মুজিব অত্যন্ত ঘরোয়া পরিবেশে একটি চেয়ারে বসে ছিলেন। তাঁর সামনে একটি টেবিল। সেখানে নানা রকম খাবার সাজানো। আমি বেগম মুজিবকে সালাম জানিয়ে তাঁর কথামতো টেবিলের ওপাশের চেয়ারে মুখোমুখি বসলাম। আমি এই প্রথম বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে সামনাসামনি দেখার ও আলাপ করার সুযোগ পেলাম। তাঁকে দেখে চার বছর আগে হারানো আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। আমার মনে হলো, তিনি একজন চিরন্তন মূর্তিময়ী ‘বাঙালি মা’। আমার দিকে তিনি সস্নেহে তাকিয়ে কুলশাদি জিজ্ঞেস করলেন এবং আমার বাড়ির খোঁজখবর নিলেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনার ঘরে আসার সময় সারি সারি চৌকি দেখলাম, ওখানে কারা থাকেন?’ তিনি বললেন, ‘হাসুর বাবার মুক্তির পর থেকে বাংলাদেশের দূর-দূরান্ত থেকে কর্মীরা ছুটে আসছেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা রাত হয়ে যাওয়ার পর ফিরে যেতে পারছেন না তাঁরা থেকে যাচ্ছেন, ফলে বাড়িটা একটা বাজারে পরিণত হয়ে গেছে’। তিনি এরপর আমার আপ্যায়নের দিকে মনোযোগ দিলেন। টেবিলের ওপর বিচিত্র সব খাবার। সবই ঘরে তৈরি পিঠা-পায়েস। তিনি আমাকে নিজ হাতে প্লেটে তুলে দিতে লাগলেন এবং টিপে টিপে খাওয়ালেন আমার মায়েরই মতো। মজার বিষয় এই যে বঙ্গবন্ধুর মতো বঙ্গমাতাও আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধনে কথা বলেছিলেন। কারণ আমি তাঁদের মেয়ের শিক্ষক। কিন্তু তাঁদের আচরণে আমার প্রতি যে স্নেহ ঝরে পড়েছিল তা আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছিলাম। এমন সস্নেহ আচরণ আমি জীবনে খুব কম পেয়েছি। বেগম মুজিব আমাকে বললেন, ‘আপনি তো সব দেখে গেলেন,এর মধ্যেই হাসুকে লেখাপড়া করতে হয়, আপনি যদি ওর পড়াশোনায় একটু সাহায্য করেন তাহলে ভালো হয়’। আমি বললাম,‘আপনি চিন্তা করবেন না, ওর প্রতি বিভাগের সব শিক্ষকই সহানুভূতিশীল’। এরপর আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। কিন্তু তাঁর স্মৃতি আজও অম্লান।’

(সূত্র: ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা সমীপে এক অম্লান অভিজ্ঞতা’ শিরোনামের লেখা থেকে)
লেখক- শিক্ষাবিদ ও নজরুল গবেষক।

সুলতানা কামাল
‘ওই বছর আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করার অল্প কিছুদিন যেতে না যেতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তখন থেকেই শেখ মুজিবকে তাদের প্রধান নেতা হিসেবে চিনে নিতে শুরু করেছে। সেই শেখ মুজিবের মতো এমন ডাকসাইটে নেতাকে সামরিক বাহিনী গ্রেফতার করার ঘটনায় জনমানুষের দল করেন এমন রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। অনেকেই নিজেদের লুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হন। বামপন্থি দলগুলো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। সেই পটভূমিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন আমেনা বেগম নামে একজন নেত্রী। একদিন একটি জিপ-এ করে একজন ভদ্রমহিলাকে নিয়ে আমাদের তারাবাগের বাড়িতে আমার মা সুফিয়া কামালের কাছে আসেন। আমরা জানলাম, তিনি শেখ মুজিবের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তাঁর কাছ থেকে জানা যায়, শেখ মুজিব যে বাড়িতে তাঁর পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন সেই বাড়িওয়ালা বেগম মুজিবকে বলেছেন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। কোনো রাজবন্দির পরিবারকে তিনি তার বাড়িতে রাখতে সাহস পাচ্ছেন না। আমেনা বেগম বিভিন্ন জায়গায় কথা বলেছেন, কিন্তু কেউ বাড়িভাড়া দিতে রাজি হচ্ছে না। মা’র শরণাপন্ন হলেন, অ্যাডভোকেট আশরাফ আলী চৌধুরী নামে একজন মানুষের, যিনি সেই সময় সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে সহযোগিতা করেছেন নানাভাবে। তাঁর কয়েকটি বাড়ি ছিল সেগুনবাগিচায়। মা’র অনুরোধে তিনি শেখ মুজিবের পরিবারকে তাঁর একটি বাড়ি ভাড়া দেন।

সপ্তাহ না কাটতেই আমেনা বেগম আবার বেগম মুজিবকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলেন। শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের কারণে শেখ হাসিনা সেই বিদ্যালয়ে পড়তেন সেই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হাসিনাকে আর ছাত্রী হিসেবে রাখতে পারবে না। মা হাসিনাকে নারী শিক্ষা মন্দির বিদ্যালয়ে নিয়ে গেলেন, যেটা চৌষট্টির সাম্প্রদায়িক আক্রমণের পরে শেরে বাংলা স্কুল নামে পরিচিত, সেখানে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।’
(সূত্র: স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু-মোস্তফা হোসেইন)
লেখক- মানবাধিকারকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।

ড. শাহেদা
‘বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীকে সব বড় পর্যায়ের নেতারা ‘ভাবি’ বলে সম্বোধন করতেন। আমিও পরে তাঁকে ভাবি বলে ডেকেছি। যদিও বিয়েতে তিনি আসতে পারেননি। কিন্তু পরদিন সকালে কলাবাগানের বাসায় খুব সকালে এসেই আমাকে বাচ্চা মেয়ের মতো করে আগলিয়ে আদর করলেন। ব্যাগ থেকে বের করে একটা টিকলি পরিয়ে দিলেন। এত স্নেহময়ী আচরণে আমি অভিভূত হয়ে পরেছিলাম। আমার নিজের মায়ের পর শ্রদ্ধার আসনটা তার পাকাপাকি হয়ে গেল। এত বড় একজন নেতার স্ত্রী এতটা সাধারণ হতে পারেন! তার কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যেও তেমন গুণ রয়েছে বলে অনুভব করি।

ভাবি আমাকে সেদিন বললেন, ‘তুই বলে ঢাকা কলেজে পড়াস? তোরই তো এখন পড়ার বয়স। তুই আবার কী পড়াবি? জানোস তো আমি ৩২ নম্বরে থাকি- তোর কলেজের একেবারেই কাছে, রোজ কলেজে যাওয়ার আগে বাসায় আসবি, আর না হলে ক্লাসের ফাঁকে চইলা আসবি।‘ আমি নির্বাক! মাথা নাড়ালাম। কিন্তু কী এক অলঙ্ঘনীয় আকর্ষণে তার মাঝে ডুবে গেলাম। সেই যে শুরু, বঙ্গবন্ধু আর ভাবির সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেলাম। প্রায়ই যাওয়া হতো সেই ৩২ নম্বরের বাড়িতে। যেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সাদামাটা সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এক আলোকিত নীড়!

মনে পড়ে যায় আরেকটি দুর্লভ স্মৃতির কথা। বড় একটি রান্নাঘরে জলচৌকিতে বসে আছেন ভাবি। সামনেই মেঝেতে ছড়িয়ে আছে মাছ-মাংস, তরিতরকারি সবকিছু। তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন কার জন্য কী কী রান্না হবে, স্বামী কী খাবেন, বাচ্চারা কী খাবে, তার হাতের স্পর্শেই ঘরের পাকঘর। আমি আরেকটি জলচৌকিতে বসা। গল্প করছিলাম আর ভাবির বাঙালি নারীত্বের অনুকরণীয় দিকগুলো পরখ করছি। একপর্যায়ে বললাম- আসি ভাবি তাহলে? ক্লাস আছে। বললেন তিনি, ‘যাবি কিরে- ভাত হইয়া গেছে।‘ আমি বললাম, নিত্যদিন ভাত খাব না। ভাত খেলে ক্লাস নিতে কষ্ট হয়। তিনি বললেন, নারকেলের নাড়ু দিয়ে চা খেয়ে যা, ক্লাস নিবি, ক্ষুধা লাগবে না?’ কোনো দিনই না খাইয়ে তিনি ছাড়তেন না। অনেক খেয়েছি তার সঙ্গে।

১৯৭৪ সালের ১৪ মে আমার মেয়ের প্রথম জন্মদিন। ভাবি আসবেন। অপেক্ষায় রয়েছি। ফোন করে তিনি বললেন, ‘আমি একটু পরেই আইতাছি। তোরা কেক কাটিস না।‘ পরে অবগত হলাম, আমার মেয়ের জন্য কাকে যেন নিউমার্কেটে সোনার দুটি বালা কিনতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে রেডি হয়ে বসে আছেন। তিনি এলেন। ছোট্ট সেই রাসেলকে নিয়ে। জন্মদিনটাকে উৎসবে পরিণত করে গেলেন। সবসময় এত আপন মনে হতো- আমি যেন তার পরিবারের কেউ! আপন করে নেওয়ার এক জাদুকরী ক্ষমতা ছিল তার।’ (সূত্র: রাজনীতিবিদদের স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু- মোস্তফা হোসেইন)
লেখক: শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ।

মুনীরা খান
‘মুক্তিযুদ্ধের বছর কয়েক আগের কথা। তখন আমাদের একটা রাবার বোট ছিল। আমার স্বামী, আমার বোন ও আমি ধানমণ্ডি লেকে গেলাম বোট নিয়ে। উদ্দেশ্য লেকে ঘুরে বেড়াবো। কিছুটা সময় বোটে বেরিয়ে ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির সামনে এসে পাড়ে নামব। নৌকাটা পাড়ের কাছাকাছি হওয়ার পর আমার বোন লাফ দিয়ে পাড়ে ওঠে যায়। কিন্তু হালকা নৌকাটা তখন যায় ডুবে। পাড়ের কাছাকাছি হওয়ায় আমাদের তেমন কোনো অসুবিধা না হলেও কাপড়চোপড় তো ভিজে গেছে। সেখান থেকে তীরে উঠে ভাবছি ভেজা কাপড়চোপড় পড়েই কি বাসায় যেতে হবে?
আমাদের চিন্তামুক্ত করলেন বেগম মুজিব। মুজিব ভাই’র পায়জামা-পাঞ্জাবি দেওয়া হলো আমার স্বামীকে। তাই পরে বাসায় ফেরা হলো।’ (সূত্র: স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু- মোস্তফা হোসেইন)

লেখক : রায়হানা রহমান – সাবেক প্রেসিডেন্ট, ফেমা।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ