1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

ড. কাজল রশীদ শাহীন : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০২২

বাংলাদেশ একটা দেশের নাম। কীভাবে হয়েছে এই নাম আর কীভাবেই হয়ে থাকে একটা দেশের নাম- সেসবের আদ্যোপান্ত কি জানি আমরা? প্রাচীন কাল থেকে কিংবা অনেক আগে থেকেই কোনো একটি নাম প্রচলিত থাকে এবং মানুষের মুখে মুখে সেই নাম ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে একটা স্থায়িত্ব পেয়ে যায় বলেই কি দেশ কিংবা কোনো জনপদের নাম ওই নামেই হয়ে যায়।

কথাটা অনেকাংশেই সত্য বটে কিন্তু সর্বাংশে নয়। কেননা এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। কোনো কোনো দেশের নামের সঙ্গে আবেগ জড়িত থাকে। যে আবেগ ধারণ করে পুরো জাতি এবং সেই আবেগের প্রশ্নে তারা একবিন্দু ছাড় দিতে রাজি নয়। কোনো কোনো দেশের নাম অবশ্য যুদ্ধ করে অর্জন করতে হয়। যেমনটা হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। পৃথিবীতে বাঙালিই সম্ভবত একমাত্র জাতি যারা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা যেমন অর্জন করেছে তেমনি দেশের নামটাও প্রতিষ্ঠিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ তত্ত্বের আলোকে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা জারি থাকবে এই লেখায়।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিজয় অর্জিত হয়, স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয় একই বছরের ২৬শে মার্চ। এর আগে বাংলাদেশ শব্দটি মুখে মুখে উচ্চারিত হলেও রাষ্ট্র কাঠামোর সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাংলাদেশ’ শব্দটিকে রাষ্ট্র কাঠামোর সঙ্গে যেমন যুক্ত করেন তেমনি বাংলাকে প্রথমবারের মতো স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মর্যাদা দেন। বঙ্গবন্ধু যেমন আমাদের জাতির জনক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি; তেমনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নামকরণের প্রবক্তা। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে এতদ্বিধ গুণের সমাহার শুধু বিরল নয়, চিত্তাকর্ষকও বটে।

বঙ্গবন্ধুকে আমরা রাজনৈতিক নেতা হিসেবে যতটা জানি, ঠিক সেইভাবে অবগত নয় তাঁর তাত্ত্বিক সত্তার সঙ্গে। অথচ তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের যেমন উদ্গাতা, তেমনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নামকরণেরও প্রবক্তা। বঙ্গবন্ধুর দর্শন নিয়েও আলোচনা সীমিত। রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধুকে দর্শনের আলোকে মূল্যায়ন করা জরুরি ও অবশ্যাম্ভাবি। বঙ্গবন্ধুর লড়াই-সংগ্রামকে যদি আমরা দার্শনিক ভাবনা থেকে দেখার চেষ্টা করি তাহলে দেখব, তাঁর পুরো জীবনে আত্মপ্রতিষ্ঠার দর্শনই ছিল মূখ্য ও অভীপ্সা। সেই দর্শনই তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির গৌরব ও মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছে। এই লেখায় বঙ্গবন্ধু কেন ও কোন যুক্তির আলোকে এই ভূ-খণ্ডের নাম ‘বাংলাদেশ’ রাখলেন তাঁর বাংলাদেশ তত্ত্বের আলোকে সেটা নিরূপণ ও অন্বেষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। রাজনীতিক ও তাত্ত্বিক বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন ও অবলোকন দীর্ঘ আলোচনা ও নিবিড় গবেষণা ব্যতিরেকে দুরুহ ও অসম্ভবও বটে। ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ তত্ত্ব’ও দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে। আমরা সীমিত পরিসরে শুধু এর চৌম্বকীয় অংশটুকু জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করব।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই এই অঞ্চলের মানুষের স্বপ্নভঙ্গ ঘটে। এর পেছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে অনেক। বঙ্গবন্ধু বিষয়টি উপলব্ধি করেন ১৯৪৮ সালেই, অর্থাৎ মাত্র এক বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে। এর মধ্যেই ভাষার অধিকারের বিষয়টা সামনে চলে আসে। তারপর ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে স্পষ্ট হয়ে যায় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নয়। কারণ যৌক্তিক দাবি হওয়া সত্ত্বেও তারা ‘বাংলা ভাষা’র রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে কুণ্ঠাবোধ করে এবং ন্যায্য দাবির জবাব বুলেটের মাধ্যমে দেয়া হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারির বিয়োগান্তক ঘটনার মধ্যে দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ভাষাভিত্তিক চেতনা জাগ্রত হয়। সমাজের যারা অগ্রসর অংশ লেখক-কবি-সাহিত্যিক-অধ্যাপক-সাংবাদিক তারা স্ব-স্ব জায়গা থেকে নিজেদের ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হয়। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয় হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামক সংকলনটি, রচিত হয় কালজয়ী কবিতা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ আবদুল গাফফার চৌধুরীর এই কবিতাটি প্রথমে আবদুল লতিফ এবং পরে আলতাফ মাহমুদের সুরে সঙ্গীতের মর্যাদা পায় এবং গীত হতে থাকে।

পাঁচ-এর দশকের প্রায় পুরোটা সময় ধরে যখন কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী সমাজ এভাবে মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভাষাপ্রীতিকে উজ্জীবিত ও উচ্চকিত করছেন। ঠিক তখন বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এই অঞ্চলের নামকরণ নিয়েও বজ্রকণ্ঠ হচ্ছেন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে। বঙ্গবন্ধুর এই সময়ের ভাষণের দিকে আমরা যদি দৃষ্টি দেই এবং গবেষণামনস্ক হই তাহলে স্পষ্ট হবে যে এই সময়কালেই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ‘বাংলাদেশ তত্ত্ব’র বীজ উপ্ত হয়। একটু খেয়াল করলেই বিষয়টি পরিষ্কার ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বঙ্গবন্ধু সেই সময়ের একটা ভাষণে বাংলা ভাষার অধিকারের কথা বলতে গিয়ে স্পষ্ট করে বলছেন, মাননীয় স্পীকার আমরা শুধু বাংলা ভাষার অধিকার চাই না। আমরা চাই পাকিস্তান রাষ্ট্রে অন্যান্য ভাষাভাষি যারা আছে তাদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হোক। এ সময় তিনি পশুতু, বেলুচসহ পাকিস্তানের প্রত্যেকটি অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন ভাষার অধিকার রক্ষায় জোর দাবি জানান।

সংসদের সেই সময়ের প্রতিদিনের কার্যক্রম তিনটি ভাষায় লেখার নিয়ম জারি ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে লেখা হচ্ছে শুধু দুটি ভাষায় উর্দু ও ইংরেজিতে। বঙ্গবন্ধুর কাছে এই বিষয়টাও এড়িয়ে যায়নি। তিনি এ প্রসঙ্গে সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং প্রতিকার চাওয়ার পাশাপাশি তিনটি ভাষায় লেখার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু এই অঞ্চলের নামের পরিবর্তন নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছেন এবং গণভোট অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন। সংসদে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলছেন, ‘মাননীয় স্পীকার, উনারা এই অঞ্চলের নাম পরিবর্তন করতে চায়। এর নাম পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান নয়। বাংলার একটা ঐতিহ্য আছে, ইতিহাস আছে। অথচ উনারা সবকিছু থেকে এটাকে বাদ দিতে চান। যদি নাম পরিবর্তন করতেই চায় তাহলে গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করুন। দেখুন-জানুন এই অঞ্চলের মানুষেরা এই পরিবর্তন চান কিনা।’

বঙ্গবন্ধু এমনও বলেছেন, মাননীয় স্পীকার, এই অঞ্চলের নাম পরিবর্তন করতে করতে সব জায়গা থেকে বঙ্গকে, বাংলাকে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন শুধু বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে এই শব্দটি যুক্ত রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর এসব ভাষণের ভেতর-বাহির এবং পরম্পরাকে যদি আমরা বুঝতে চেষ্টা করি তাহলে দেখব বঙ্গবন্ধুর ভেতরে সেই দিনগুলোতে ‘বাংলাদেশ তত্ত্ব’র বীজ উদগারিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যখন সংসদে এসব কথা বলছেন তার কয়েক বছরের ব্যবধানে ঢাকার রাজপথে একটা শ্লোগান সবথেকে বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ পাঁচ-এর দশকের শেষাশেষি আর ছয়-এর দশকের প্রারম্ভিক লগ্নের সময় আরও একটা ঘটনা ঘটে। নিউক্লিয়াস নামে ছাত্রলীগের একটা গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। যারা এই অঞ্চলকে ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’ বলতেন।

আমরা একটু পেছন ফিরে দেখি, এ অঞ্চলের নাম কখনো বাংলা বা বাংলাদেশ ছিল না। নানা মুনির নানা মত এখানে বিরাজিত। তবে ইতিহাসের সঙ্গে এখানে যুক্ত হয়েছে পুরাণ। এবং সেখানে হিন্দু পুরাণ যেমন রয়েছে তেমনি ইসলামের আলোকেও একটা শক্তিশালী যুক্তি খাড়া করা হয়েছে।

নূহ (আঃ) এর পুত্র হামের তিন পুত্রের মধ্যে এক পুত্র ছিল বঙ্গ। মনে করা হয় তারই নামানুসারে বঙ্গ বা বঙ্গদেশ নামের উৎপত্তি হয়। এবং এও বলা হয়, অন্য দুই পুত্র হিন্দের নামানুসারে হিন্দুস্থান আর সিন্দের নামানুসারে সিন্ধু নামের উৎপত্তি হয়। হিন্দু পুরাণ মতে, রাজা বালির তিন পুত্র। পশ্চিমবঙ্গ, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের শাসক ছিল অঙ্গ। ঢাকা, ত্রিপুরা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের শাসক ছিল বঙ্গ। উত্তরবঙ্গ ও আসাম অঞ্চলের শাসক ছিল পুন্ড্র।

আরও একটি মত প্রতিষ্ঠিত যে, আর্যরা অঞ্চলকে ‘বঙ্গ’ বলতেন। সংস্কৃত শব্দ বঙ্গের সঙ্গে ফার্সি শব্দ ‘আল’ যোগ করলে হয় বাঙাল বা বাঙালাহ। আল বা আইল বলতে জমির পৃথকীকরণ কিংবা নদীর বন্যা রক্ষার বাঁধকে বোঝানো হয়। এখনও কুষ্টিয়া, ফরিদপুর অঞ্চলে এই রীতি বা পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। ইতিহাসের সেই ধূসর অধ্যায় আলো-আঁধারিতে ঘেরা থাকলেও মোটামুটি এই মত প্রতিষ্ঠিত যে বঙ্গের সঙ্গে আল বা আইল যোগ করেই নানা পথ ও পরিক্রমার মধ্য দিয়ে বাংলা নামটি এসেছে।

সুলতানি ও মোঘল আমলে এই অঞ্চলের বাঙাল বা বাঙালাহ নামকরণের বিস্তার ঘটে। এরপর বিভিন্ন সময়ের শাসকেরা তাদের মতো করে এই অঞ্চলের নামকরণ করেন। তবে পাকিস্তান সময়ের মতো আমূল পরিবর্তন করে নয়। শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাম দিয়েছিলেন বঙ্গ। তিনি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসামকে একীভূত করে এই অঞ্চলের নাম দেন বঙ্গ।

ব্রিটিশদের সময় নামকরণ হয় বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। এটা আবার দ্বিখণ্ডিত হয় বঙ্গভঙ্গের সময় প্রশাসনিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। বাংলার পশ্চিম অংশ হয়ে যায় ‘পশ্চিম বঙ্গ’ আর পূর্ব অংশ ‘পূর্ব বাংলা’। বঙ্গ বিভক্ত হয়ে যায় ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের মধ্য দিয়ে। এবং পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার নামকরণ করে পূর্ব পাকিস্তান। এই জনপদের দীর্ঘ এই পরিক্রমণের আলোকে বঙ্গবন্ধু ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিবেচনায় রেখে দাঁড় করান বাংলাদেশ তত্ত্ব।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি যিনি গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলে অবিসংবাদিত। বঙ্গবন্ধু তাঁর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশ তত্ত্ব পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসেন। দিনটা ছিল ১৯৬৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ।’ আলোচনায় অবশ্য স্বাধীন পূর্ব বাংলা, বাংলা, বেঙ্গল, ইস্ট বেঙ্গল, বঙ্গ, বঙ্গ দেশ নামগুলোও আসে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল ‘বাংলাদেশ’ নামটার পক্ষে।

‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে উল্লেখিত হয়েছে-‘বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, একসময় এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।… একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনও কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। … জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ।’

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ নামকরণের খবর পরদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হলে আতাউর রহমান খান, মওলানা ভাসানী এই নামকরণ সমর্থন করেন। উনারা বিবৃতি ও বক্তৃতায় স্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশ নামকরণই হবে যৌক্তিক, যথার্থ ও সুবিবেচনাপ্রসূত। তারপর ‘বাংলাদেশ’ নামটি কাগজে কলমে লিখিত না থাকলেও সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

এক্ষণে একটু পেছন ফেরা দরকার। বাংলাদেশ কিংবা বাংলা, বিশেষ করে বাংলাদেশ নামটি আগেও কিন্তু সরকারের নথিপত্রে জায়গা না পেলেও মুখে মুখে উচ্চারিত হতো; বিশেষ করে কবি লেখক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর লেখায় এই অঞ্চলকে বঙ্গদেশ বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন সোনার বাংলা কিংবা বাংলা। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন রূপসী বাংলা। আর কাজী নজরুল ইসলাম ও সত্যজিৎ রায় বলেছেন বাংলাদেশ। অর্থাৎ কাগজ কলম মনে হয় সবসময় ফ্যাক্টর নয়। কাগজ কলম দিয়ে মনে হয় সবসময় দাবায়ে রাখা যায় না। আর সেটা যায় না তার প্রামাণিক উদাহরণ আমরা পাই পাকিস্তানের শেষ দিনগুলোতে। নথিপত্রে পূর্ব পাকিস্তান, কিন্তু সাত কোটি মানুষের মুখে মুখে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ শব্দটি ববহৃত হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণায়ও। মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার যে ঘোষণা সেখানেও নতুন দেশটির নাম দেওয়া হয় বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বাংলাদেশের প্রত্যাশিত বিজয়। এরপর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম যে সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয় সেখানে দেশটির সাংবিধানিক নাম দেওয়া হয় বাংলাদেশ। আর এর মধ্যে দিয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নামটির দালিলিক স্বীকৃতি মেলে, এবং সত্য হয় বঙ্গবন্ধুর ‘বাংলাদেশ তত্ত্ব’।

বঙ্গবন্ধু ‘বাংলাদেশ তত্ত্বে’ জারি রেখেছিলেন দুটো গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যা একটা জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের আকর বিশেষ। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে জাতির সকল নাগরিকের আবেগ ও দেশপ্রেমের নিবেদন। এগুলো হলো, এক. ইতিহাস। দুই. সংগ্রাম। তিনি মনে করেন ইতিহাস থেকে পেয়েছেন বাংলা। যার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায়-ইতিহাসকে রাঙায়িত করা অধ্যায় হলো ১৯৫২ এর মহান একুশে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু ইতিহাস থেকে আহরণ করেছেন, খুঁজে পেয়েছেন বাংলা। আর তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই সংগ্রাম এবং এর প্রাপ্তি হলো একটি দেশ। এই দুইয়ের সমন্বয় হলো বাংলাদেশ। এবং এই হলো বাংলাদেশ নামকরণের মৌল কথন এবং বঙ্গবন্ধুর ‘বাংলাদেশ তত্ত্ব’র নির্মোহ অবলোকন ও অনুসন্ধান।

লেখক : ড. কাজল রশীদ শাহীন – সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও গবেষক।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ