মশা ও মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়া বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্যতম সমস্যা। মশাবাহিত এই রোগগুলোর মধ্যে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়ংকর রূপে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো জেলায় ডেঙ্গু এখন এন্ডেমিক (Endemic) বা স্থানীয় আকার ধারণ করেছে।
ঢাকাতে প্রথম ডেঙ্গু দেখা দেয় ১৯৬৩ সালে। তখন একে ঢাকা ফিভার হিসেবে চিহ্নিত করা বা নাম দেওয়া হয়েছিল। ডেঙ্গুর প্রথম বড় আউটব্রেক হয় ২০০০ সালে আর তখন বিজ্ঞানীরা একে ডেঙ্গু হিসেবে চিহ্নিত করে। ওই বছর বাংলাদেশ ৫৫৫১ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ৯৩ জন মারা যায়।
এরপর প্রায় প্রতিবছরই কমবেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে তবে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু এপিডেমিক আকার ধারণ করে। ওই বছর সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১০১৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৭৯ জন মারা যায়।
করোনার সময় ডেঙ্গু কিছুটা নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে থাকলেও ২০২৩ সালে বাংলাদেশের সব ইতিহাস ভেঙে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় সর্বোচ্চ রোগী ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মারা যায় ১৭০৫ জন। এ বছরও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থেমে নেই। এ পর্যন্ত ৯০০০ এরও বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে এবং ৭০ জন মারা গেছে। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর দিক থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এগিয়ে।
২০০০ সালে যখন ডেঙ্গু প্রথম চিহ্নিত হওয়ার পর থেকেই থেকেই ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণা শুরু করি। বাংলাদেশ ও জাপানে তাত্ত্বিক পড়াশোনা ও মাঠ পর্যায়ের জ্ঞান দিয়ে বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেছি মশা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক পরামর্শ দিতে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে পরামর্শের বাস্তবায়ন দেখিনি।
মশা ও মশা নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীতে ব্যবহৃত প্রায় সব ধরনের কীটনাশক নিয়ে আমার গবেষণা দল কাজ করেছে এবং করছে। বাংলাদেশে মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত অনেক কীটনাশক পরীক্ষা করে দেখেছি যার মধ্যে বেশকিছু কার্যকরী নয়।
মশাবাহিত রোগ নির্মূলের মূল উপায় হচ্ছে মশা নিয়ন্ত্রণ। ডেঙ্গুর বাহক মশা হলো এডিস প্রজাতির। বাংলাদেশে দুই প্রজাতির এডিস মশা ডেঙ্গু ছড়ায়। তার মধ্যে এডিস ইজিপ্টটি ডেঙ্গুর জন্য ৯৫ ভাগ দায়ী। এডিস ইজিপ্টটিকে নগরের বা শহরের মশা বলা হয়। অপরিকল্পিত নগরায়নের সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আরেকটি মশা হলো এডিস অ্যালবোপিকটাস। একে এশিয়ান টাইগার মশা ও বলা হয়। এটি গ্রামাঞ্চল বা যেসব এলাকায় গাছপালা বেশি আছে সেই জায়গাগুলোয় বেশি জন্মায়। গাছের কোটরে এটির আদর্শ জন্মস্থান। এটি ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য মাত্র পাঁচ ভাগ তাই বলে বিজ্ঞানীরা বলেন।
দুটি মশাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাত্রে জমা পানিতে জন্মায়। যেটি তার জন্মস্থানে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন নয়। এই মশাগুলো কীটনাশকের প্রতিও সহনশীল। কীটনাশক প্রয়োগ করে সহজেই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে ডেঙ্গুর বাহক মশা নিয়ন্ত্রণে সেই কীটনাশকেরই ব্যবহার করতে হবে যেটি কার্যকরী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত অনেক কীটনাশক রয়েছে যেগুলো ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বিরুদ্ধে কার্যকরী, পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত।
দীর্ঘ সময় ধরে আমার শতাধিক লেখায় মশা নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত ব্যবস্থাপনার বিস্তারিত প্রস্তাবনা তুলে ধরেছি। মশা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে একবার বিচার বিভাগীয় কমিটি হয়েছিল যেখানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমার মতামত দিয়েছি। ঢাকা বিমানবন্দরে মশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ২০১৯ সালে আদালতে গড়িয়েছিল।
মহামান্য হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চে এক্সপার্ট হিসেবে আমি আমার মশা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক মডেলটি মৌখিক ও লিখিতভাবে পেশ করি। মহামান্য আদালত আমার প্রস্তাবনা অনুযায়ী ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখ একটি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান করেন। সেই রায়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে বাংলাদেশে মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে একটি স্বতন্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান করার।
আদালত সেই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির নামক প্রস্তাব করেন ‘ভেক্টর কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টার (VCRC)’। আদালতের নির্দেশনা থাকলেও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেমন ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এমন গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আমাদের গবেষণা দল নিয়মিতভাবে কাজ করে থাকে। মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত মশার ঘনত্ব, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ইত্যাদি তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে আমরা ফোরকাস্টিং মডেল (EWS) তৈরি করি। কয়েক বছরে আমরা যে ফোরকাস্টিং করেছি তার ৯০ ভাগ সঠিক হয়েছে।
২০২৪ সালের দুই মাস আগেই আমরা বলেছি আগস্ট সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু রোগীর বাড়বে এবং এটি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ডেঙ্গু ইতিমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে এবং আগামী মাসে আরও বাড়বে।
জনগণের দাবির মুখে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়েছে নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস এর নেতৃত্বাধীন সরকার। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রবীণ ও অসীম সম্ভাবনাময়ী তরুণদের সমন্বয়ে গঠিত এই সরকারের কাছে বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া অপরিসীম।
বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করছে তরুণদের হাতে বদলে যাবে বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ডেঙ্গু একটি সমাধানযোগ্য সমস্যা যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ করে দেখিয়েছে। আর এই সমস্যাটির সমাধানও এই সরকারের মাধ্যমে হবে বলে বিশ্বাস করি।
মশার নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদের। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এই অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো মশা নিয়ন্ত্রণে উপযোগী করা ও এখানে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করা প্রয়োজন।
মশা নিয়ন্ত্রণে অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদের কাজে লাগানো দরকার। বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনে কীটতত্ত্ববিদদের পদ থাকলেও অজানা কারণে সেই পথগুলো ফাঁকা। বিভিন্ন সময়ে এই পথগুলো পূরণের জোর সুপারিশ করলেও সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো সম্পন্ন হয়নি।
ডেঙ্গু মৌসুম আসন্ন তাই এখনই জোরেশোরে কাজ শুরু করা প্রয়োজন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে গবেষক ও অংশীজনদের নিয়ে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজ করা দরকার। সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ এখনই শুরু করতে পারলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখা সম্ভব।
ডেঙ্গু এমন রোগ নয় যে মানুষের মৃত্যু হবে। সঠিক সময়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে ডেঙ্গুর মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। নতুন সরকারের প্রগতিশীল নেতৃত্বে মশা ও মশাবাহিত রোগমুক্ত বাংলাদেশ পাওয়ার প্রত্যাশা করি।
লেখক: ড. কবিরুল বাশার – অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।