শুক্রবার (৫ অক্টোবর) বিকেলে রাজধানীর গুলশানে বার্তা২৪.কম- এর কাছে গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতার স্মৃতিচারণ করেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন স্টাফ করেসপন্ডেন্ট রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান।
২১ আগস্ট দিনটির বিভৎসতার বর্ণনা দিয়ে আশরাফুল আলম খোকন বলেন, সাংবাদিক হিসেবে আওয়ামী লীগের সমাবেশ কাভার করতে গিয়েছি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রাকমঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বক্তব্য দিচ্ছিলেন। মাইক্রোফোন হাতে ধরা ছিলাম আমি। হঠাৎ করেই একটা বিকট শব্দ। প্রথমটা আমাদের সামনে পড়েছে। পাবলিকের ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেছি। মানুষ চিল্লাচিল্লি করতেছে, দৌঁড়াদৌড়ি করতেছে। আমি ট্রাকের নিচে চলে যাই। নিজেকে সেফ ভেবে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলাম।
অফিসে কল দিলাম বললাম, ‘আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা পড়ছে।’ চিৎকার করে বলতেছি, ‘আপনারা স্ক্রল চালান।’ আমি ঠিক আছি কি-না অফিস জানতে চাইলো-তখন নিজের দিকে তাকালাম। দেখলাম পুরা প্যান্টের পা রক্তাক্ত, টি-শার্টের উপর দিয়ে পেটের ওখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে।
তখনো জ্ঞান ছিলো। রমনা ভবনের পাশ দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ করে টিয়ারশেল এসে পড়ল আমার মুখের সামনে। আমি আবার ট্রাকের নিচে আসলাম। সেই সময় দেখলাম পায়ের নিচে কি একটা পড়ে আছে।
তখন দেখলাম, ‘জলপাই কালারের একটা গ্রেনেড’। ভাবলাম, ‘এটা যদি ব্লাস্ট হয় তাহলে সবশেষ’।
এদিকে পুরো পা অবশ হয়ে গেছে। যখন বের হচ্ছি তখন দেখেছি কি ভয়ংকর অবস্থা। কারো হাত পড়ে আছে, কারো পা পড়ে আছে। কেউ রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। মহিলারা কি অবস্থায় পড়ে আছে ওই দৃশ্য যারা না দেখছে তারা বিশ্বাস করতে পারবে না। কি ভয়ংকর দৃশ্য! মৃত্যুর আগ মুহূর্তটাকে যেন মনে হয়েছে।
আমি আইভি রহমানকে দেখলাম। উনি ট্রাকের নিচে মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুই সহকর্মী আমাকে দেখে টেনে ফুটপাতে নিয়ে শোয়াল। দেখি পুলিশ লাঠিপেটা করছে। একদিক তখনি অবাক লাগছে যে উদ্ধার তো দূরে থাক; উল্টা লাঠিপেটা ও টিয়ারশেল।
পরে আমাকে একটা ভ্যানগাড়িতে উঠাল কয়েকজন। ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসল। একটা সময় আস্তে আস্তে যে শক্তিটুকু ছিল সেটাও কমে যাচ্ছে। আমার দুই সহকর্মী সন্তোষ দা ও শামীম খোঁজ করছিলেন। আমি যে ডাক দিব, কিন্তু মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। শামীম যখন আমাকে ক্রস করতেছে, তখন আমি হাত দিয়ে প্যান্টের দিকটা টেনে ধরলাম। তখন ওরা আমাকে দেখল।
এরপর আমাকে হলিফ্যামিলিতে নিলো। সেখানে ট্রিটমেন্ট শুরু হয়। সেদিন হাসাপাতালগুলোর রক্তাক্ত দৃশ্য যারা দেখেনি তারা বিশ্বাস করতে পারবে না যে কতটা ভয়ঙ্কর ছিল, কতটা নৃশংস ছিল-সেদিনটা।
হামলার সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার অবস্থা তখন কেমন ছিল জানিয়ে খোকন বলেন, হামলার পর অনেকেই চিৎকার করতেছে যে নেত্রী কই? নেত্রী কই? আপা কই? আপা কই? আমি যখন ঢাকা মেডিকেলে তখন আমি জানি শেখ হাসিনা সহ সবাই মারা গেছেন।
ওই হামলায় টার্গেট কিন্তু একজনই, শেখ হাসিনা। প্রথমটা ট্রাকের ডালার নিচে পাশে লেগে বাইরে পড়ে গেছে। ট্রাকে পড়লে কি ঘটনা ঘটত এটা কল্পনা করতেও ভয় লাগে। প্রথম টার্গেটটা মিস হওয়ার কারণেই কিন্তু ওরা এলোপাথারি মারছে। শেখ হাসিনাকে তো মানববর্ম তৈরি করে গাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। যারা মানববর্ম তৈরি করেছে সবার শরীরে কিন্তু আঘাত আছে। ওনার একজন সিকিউরিটি অন দ্যা স্পটে মারাও গেল। এরপর ওনাকে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলে গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে। যেহেতু গাড়ি বুলেটপ্রুফ ছিল উনি আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছেন।
তিনি বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় মদদ দেয়া বলা হলে সেটা ভুল। পুরো ঘটনাটা ঘটিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। মদদ দেয়া এক জিনিস আর পুরো ঘটনা ঘটনো আরেক জিনিস। এটা কিন্তু এক দিনের ঘটনা নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২১ বার হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে। ওরা কিন্তু প্রথম আঘাতটা হানছে ৭৫ এর ১৫ আগস্ট। দেখবেন যে ওরা কিন্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে আসে। কখনো জামায়াত, কখনো বিএনপি, কখনো হুজি, কখনো নব্য জেএমবি, কখনো বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে, ওরা কিন্তু একই জিনিস। এরা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। কিন্তু কথায় আছে না, রাখে আল্লাহ মারে কে? যে বাংলাদেশের ডেভেলমেন্টের জন্য, উন্নতির জন্য, সভ্য সমাজের মর্যাদার জন্য আমাদের প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা বেঁচে আছেন।
ভয়াবহ হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া সাবেক এই ছাত্রনেতা জীবনের উপলব্ধি নিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আমানত। যারা ২১ আগস্ট যারা আহত হয়েছি, যারা মারা গেছেন তারা ভাগ্যবান। এ গ্রেনেড হামলার উদ্দেশ্য ছিলো বঙ্গবন্ধুকন্যাকে মারার। যে গ্রেনেডগুলো মারা হয়েছিল সেগুলো খেয়ে আমরা ওনাকে রক্ষা করেছি। সে ক্ষেত্রে আমরা ভাগ্যবান যে বঙ্গবন্ধুর আমানতকে সেদিন রক্ষা করতে পেরেছি।
আমি হয়ত তুলনামূলক সুস্থ মানুষ, কিন্তু ট্রমা এখনো আছে, ঘরের দরজায় একটু জোরে শব্দ হলে ভয় পাই। এখনো মাঝে মাঝে রাতে ব্যথায় ঘুম আসেনা। ডান পায়ের হাটুর মধ্যে ১৪টা স্প্লিন্টার আছে, এগুলোর যন্ত্রনা নিয়েই থাকতে হবে, এটাই ভাগ্য। অনেক পরি দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। সে পরিবারগুলোর প্রধানমন্ত্রী খোঁজ নেন। দিনের পর দিন তাদের সহায়তা করে যাচ্ছেন।
১০ অক্টোবর রায় নিয়ে ২১ আগস্টের হামলায় বেঁচে যাওয়া এই ভুক্তভোগী বলেন, রায় তো আদালত দেবে। দুই পক্ষের আইনজীবীরা ছিলেন। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া। এক সময় জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছিল, এই মামলাকে পুরা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল, উল্টা দিকে। তারপর উল্টা জিনিসটাকে রাইট ট্রাকে এনে বিচারকার্য পরিচালনা প্রক্রিয়া করা হয়েছে।