1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

জামায়াত ॥ আওয়ামী লীগের ভেতরে ট্রয়ের ঘোড়া

ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০২০

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী
আমি যখন গ্রামের জুনিয়র মাদ্রাসায় ক্লাস টু’তে পড়ি, তখন প্রেতাত্মা শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হই। আমাদের বাংলার টিচার ছিলেন ওয়াজেদ মাস্টার। তিনি একই সঙ্গে ছিলেন গ্রামের পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার এবং আমাদের বাংলার টিচার। আমি ভূত-প্রেত শব্দের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু প্রেতাত্মা শব্দ এবং তার অর্থের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে। এ সময় সংবাদপত্রে খবর বেরুল, কলকাতায় একটি গলির মধ্যের একতলা বাড়িতে প্রতি রাতে ইটপাটকেল পড়ছে। বাড়ির বাসিন্দারা রাত্রে ঘুমুতে পারছেন না। পুলিশী তদন্তেও এই ইটপাটকেল নিক্ষেপকারীরা শনাক্ত হয়নি। পাড়ার লোকেরা সন্দেহ করছেন এটা প্রেতাত্মার কাজ। আর এই প্রেতাত্মা আর কেউ নয়, ওই বাড়িরই সদ্য প্রয়াত এক ঠাকুরদা। তিনি তার জীবনকালে অত্যন্ত অনাচারী ছিলেন। মৃত্যুর পর তার সদগতি হয়নি। তার প্রেতাত্মাই ওই বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং ওই বাড়িরই তার এক নাতির দেহে ঢুকে রাত্রে এই উপদ্রব সৃষ্টি করেছে। পাড়ার লোকেরা এই প্রেতাত্মার আবির্ভাবের খবর বিশ্বাস করে। পুলিশ বিশ্বাস করে না। তারা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
আমি তখন খবরের কাগজ পড়তে পারি না। সুতরাং এই খবর সম্পর্কেও অনবহিত ছিলাম। কিন্তু ওয়াজেদ মাস্টার একদিন ক্লাশে বসে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে এই প্রেতাত্মা সম্পর্কে আলোচনা করার সময় শব্দটি আমি জানতে পারি এবং তার অর্থ জানার জন্য আগ্রহী হই। পরে ওয়াজেদ স্যারকে শব্দটির অর্থ জানতে চাইলে তিনি আমাকে প্রেতাত্মার অর্থ বুঝিয়ে বলেন। বয়স না বাড়া পর্যন্ত আমি এই প্রেতাত্মার ভয়ে অস্থির ছিলাম। দোয়াকালাম পড়ে রাত্রে বিছানায় শুতে যেতাম।
এটা ছিল আমার অল্পবয়সের কথা। এখন এই পরিণত বয়সেও দেখছি, আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রেতাত্মার উৎপাত। জীবিত অবস্থায় এরা বিএনপির কাঁধে ভর করেছে। এখন মৃত্যুর পর প্রেতাত্মা হয়ে আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করতে চাইছে। জামায়াতের শীর্ষ নেতারা একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মৃত্যুদ-ে দ-িত হওয়ার পর জামায়াতের কার্যত মৃত্যু ঘটে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়ায় জামায়াতের মৃত নেতাদের আত্মার সদগতি হয়নি। তারা এখন প্রেতাত্মা হয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্তি ও প্রভাব বিস্তার করছেন এবং এজন্য সুকৌশলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাঁধেই ভর করার চেষ্টা করছে। এটা দেশের রাজনীতির জন্য এক ভয়ানক বিপদের সঙ্কেত।
গত ১৯ অক্টোবর ঢাকার একটি দৈনিক জামায়াতের আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি এবং আওয়ামী লীগে তাদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ সম্পর্কে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পর অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় দলটি। ওই শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে সহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে নাশকতার মামলায় জড়িয়ে যান কয়েক হাজার নেতাকর্মী। এতে প্রায় বন্ধ হয়ে যায় দলীয় কর্মকা-। হাল সময়ে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে দলটি সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে।’
দলটির এই বিভিন্ন কৌশল গ্রহণের মধ্যে একটি হচ্ছে দ্রুত আওয়ামী লীগার সেজে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ। এই অনুপ্রবেশের অনেক উদাহরণ রয়েছে ওই দৈনিকের প্রতিবেদনে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘গত ৫ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ওই কমিটির শ্রমবিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে আবুল কালাম আজাদকে। তিনি ছিলেন জামায়াতের সদর উপজেলা কমিটির প্রচার সম্পাদক। নাশকতার ১৭টি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।’
মাত্র এই সেদিন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার দলে জামায়াতীদের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগে নির্বিবাদে জামায়াতীদের এই অনুপ্রবেশ চলছে কিভাবে? শুধু সাতক্ষীরায় নয়, ঢাকার মিরপুরসহ দেশের বহু স্থানে জামায়াত শক্ত ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছে আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ডের আড়ালে। মিরপুরের প্রভাবশালী এবং জামায়াতী ব্যবসায়ী শফিউদ্দীন মাত্র গত বছর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় এমপির বন্ধু হয়ে যান। শফিউদ্দিন এখন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, শফিউদ্দিনের মিরপুরের ১৩/৩ বাইশটেকীর বাসার নিচতলায় আওয়ামী লীগের দলীয় সাইনবোর্ড টাঙ্গানো রয়েছে। কিন্তু রাত্রে ওই অফিসে জামায়াতের নেতাকর্মীদের সভা হয়।
অভিযোগটি সঠিক হলে বলতে হবে শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়, গোটা দেশের জন্যও এটা একটা দশ নম্বর বিপদসঙ্কেত। ঢাকার দৈনিকটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘দেশের বেশিরভাগ জেলা-উপজেলায় জামায়াতের নেতা কর্মীদের আশ্রয় দিচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এবং কোন কোন জেলায় তারা পুলিশেরও সহায়তা পাচ্ছে। তাদের গোপন বৈঠক হয় মসজিদে এবং হাসপাতালে। রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য জামায়াত কর্মীরা তাদের উর্ধতন মহল থেকে তিনটি নির্দেশ পেয়েছে। এক. আওয়ামী লীগে যোগদান। দুই. আইনজীবীর পেশা গ্রহণ। তিন. গণমাধ্যমের কর্মী সাজা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে ঢোকার একটি কৌশল জামায়াতীরা শিখেছে বাংলাদেশের কম্যুনিস্টদের কাছ থেকে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকার কম্যুনিস্ট দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তাদের অনেক নেতা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান এবং বাকি নেতাদের আওয়ামী লীগে যোগ দিতে বলা হয়। আওয়ামী লীগে শক্তিশালী বামপন্থী গ্রুপ গড়ে ওঠে। কিন্তু ১৯৫৭ সালে যখন পাকিস্তানে সামরিক জান্তা দেশের গণতান্ত্রিক ঐক্যে ভাঙ্গন ধরিয়ে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করে, তখন আওয়ামী লীগের এই বামপন্থীরা মওলানা ভাসানীকে দলে নিয়ে এক সঙ্গে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাপ নামে নতুন দল গঠন করে এবং দেশের গণতান্ত্রিক ঐক্যে ভাঙ্গন ধরিয়ে আইয়ুব খানের জন্য ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখল সহজ করে দেয়।
বর্তমানে জামায়াতীরা আওয়ামী লীগে ঢুকে কি ধরনের ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে, তা এখন পর্যন্ত কেউ জানে না। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বারংবার কঠোর সাবধান বাণী উচ্চারণ করা সত্ত্বেও দলের একশ্রেণীর নেতা, এমপি এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে জামায়াতীরা দেশের রাজনীতিতে ভালই প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। যেহেতু এলাকার কোন এমপি বা উপজেলা চেয়ারম্যান জামায়াতীদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন, ফলে সে জেলার পুলিশও তাদের সহযোগিতা দিতে বাধ্য হয়। বিএনপি সরকারের আমলে রিক্রুট করা কিছু পুলিশও (সাবেক ছাত্রদল ও যুবদল কর্মী) স্বেচ্ছায় জামায়াতীদের বন্ধু সাজে।
আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী ভাবেন, মতিউর রহমান নিজামী গংদের ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে জামায়াত প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাদের ভাবনাটা ঠিক নয়। ১৯৭১ সালেও আওয়ামী লীগের একদল নেতাকর্মী এই ভুলটা করেছিলেন। তারা ভেবেছিলেন একটা সশস্ত্র যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতি শেষ। জামায়াত মরেনি। মসজিদ-মাদ্রাসা আশ্রয় করে গোপনে বেঁচে রয়েছে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের অভিভাবকত্বে প্রকাশ্য রাজনীতিতে মাথা তুলেছে। তারপর জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়ার সাহায্যে রাষ্ট্র ক্ষমতাতেও অংশীদার হয়।
জামায়াত সাপের মতো ধূর্ত এবং খোলস বদলে পারদর্শী। ওপরে ভদ্র-বিনয়ী চেহারা, ভেতরে ঘাতক সীমারের চরিত্র। জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য অনেক নিম্নশ্রেণীর কৌশলও গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে একটি হলো-বিভিন্ন প্রভাবশালী পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে মিশে গিয়ে নিজেদের প্রভাব বাড়ানো। ’৭১ সালে পাকিস্তানীদের গণহত্যার দোসর হওয়ার জন্য বাংলাদেশে জামায়াত সর্বজনীন ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। এই ঘৃণা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য জামায়াত তখন একটি ঘৃণ্য কৌশল গ্রহণ করে। দলের যুবক কর্মীদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী হয়ে ঢুকে প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে অথবা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করা এবং ওই পরিবারের সহায্য ও সমর্থন লাভ করা।
এই কৌশলটি রাজশাহী অঞ্চলে খুবই সফল হয়েছিল এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসার পর জামায়াতীদের প্রধান কৌশল জনহিতকর প্রতিষ্ঠান যেমন- হাসপাতাল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান- যেমন ব্যাংক, ইনসিওরেন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। আওয়ামী লীগের নেতা, এমপিরা অনেকেই খুব সচ্ছল নন (এখন অবশ্য অবস্থা বদলেছে)। সুতরাং তাদের অনেককে অর্থ সাহায্য দিয়ে অথবা ব্যবসায়ে পাটর্নার করে তাদের নামে জমজমাট ব্যবসা করা। এই শেষোক্ত কৌশলটিই কাজ দিয়েছে বেশি। অভিযোগ আছে সংখ্যায় তারা খুব কম হলেও কোন কোন এলাকায় আওয়ামী লীগের এমপি বা উপজেলা চেয়ারম্যান তাদের নির্বাচনে জয় লাভে জামায়াত অর্থ সাহায্য দিয়েছে এবং জামায়াতের মস্তান বাহিনী ওই এমপি বা উপজেলা চেয়ারম্যানের ছত্রছায়ায় এলাকায় যথেচ্ছ অত্যাচার করে বেড়ায়। দোষ পড়ে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে। ছাত্রশিবিরের মতো কর্মী ছাত্রলীগে ঢুকেছে ছাত্রলীগের নেতারাও তা জানেন না। একই অবস্থা অনেক আইনজীবী সমিতির।
জামায়াতকে এখন বলা চলে আওয়ামী লীগের ভেতরে ট্রয়ের ঘোড়া। গ্রীক ইতিহাসে এই ট্রয়ের ঘোড়ার সর্বনাশা ভূমিকার উল্লেখ আছে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভেতরে জামায়াতের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে কেবল সাবধান বাণী উচ্চারণ করে লাভ হবে না। শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানাই, দলের ভেতরে অনুপ্রবিষ্ট এই ট্রয়ের ঘোড়া ধ্বংস করার জন্য চিরুনি অভিযান চালান। নইলে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য বিএনপিকে উপদেশ দিয়ে লাভ নেই। জামায়াত থাকবে বিএনপিতে। তার প্রেতাত্মা এসে ঢুকছে আওয়ামী লীগে।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ