1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

সম্প্রীতিই হতে পারে বিশ্বশান্তি ও উন্নতির ভিত্তি

ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২১

এ কে এম আতিকুর রহমান

সম্প্রীতি শব্দটি যে অর্থ বহন করে, তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মানবসভ্যতা বিকাশের প্রারম্ভকাল থেকেই এর সর্বাদৃত অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। সমাজে সম্প্রীতি বিদ্যমান থাকলে সেখানে মানুষের মধ্যে অবশ্যই বিরাজ করবে সৌহার্দ্য, সদ্ভাব, বন্ধুত্ব আর প্রীতিময় সম্পর্ক। প্রকৃতিতে যেমন নানা প্রজাতির গাছপালা এবং পশুপাখি একত্রে বসবাস করে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে। আমরা লক্ষ করলেই দেখতে পারি যে এগুলোর মধ্যে বাঁচার জন্য কিভাবে একে অপরকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য আর সহযোগিতা করে যায়। এগুলোর এই সমাবেশ ধরিত্রীকে পরিণত করেছে এক অপার সৌন্দর্যের ভাণ্ডাররূপে। প্রকৃতির মতোই সম্প্রীতি মানুষের একটি সহজাত ধর্ম। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন ছিল বলেই আজকের পৃথিবীতে এত মানুষের বসবাস। নচেৎ বহু বছর আগেই যে পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যেত! আর সেই পরিস্থিতি যে মানুষকে কখনো অতিক্রম করতে হয়নি, তা নয়। মানুষকে দুটি বিশ্বযুদ্ধের নির্মমতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে সম্প্রীতি থেকে উৎসারিত অনুভূতি সেদিন মানুষকে শান্তির পথে যেতেই অনুপ্রাণিত করেছিল।

সম্প্রীতি মানবজাতিকে শুধু সভ্যতা বিকাশে সহায়তাই করেনি, উন্নতির দিকে ধাবিত করেছে। মানুষে মানুষে জানাশোনা, বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, ভাব বিনিময়—সব কিছুই সম্ভব হয়েছে তাদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন থাকার কারণে। জাতিগোষ্ঠীতে বিদ্যমান ঝগড়াবিবাদ মেটানোর ক্ষেত্রে সম্প্রীতির ভূমিকা অপরিসীম। ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা, মানবপ্রেম যে সম্প্রীতির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। সম্প্রীতির জন্যই মানবজাতি একটি বিশ্বসমাজ গঠনে এগিয়ে এসেছে। বলতে গেলে সম্প্রীতির বাঁধনই বিশ্বের সব মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। মানুষের সব অগ্রযাত্রার যে অনুপ্রেরণা, তা সম্প্রীতিরই বহিঃপ্রকাশ।

দেশপ্রেম, সংস্কৃতি, মানবতাবোধ এবং ভালোবাসা থেকে উদ্ভূত সম্প্রীতির শক্তি অপরিসীম। যদি আমরা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সেই দিনগুলোর (১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) কথা স্মরণ করি, যখন আমরা সব ধর্মের বাঙালি মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করেছি। কে মুসলিম, কে হিন্দু, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ, আমাদের মনে কখনো এমন প্রশ্ন জাগেনি। আমাদের সম্প্রীতির ওপর গড়ে ওঠা অনুভূতিটাই ছিল যে ভূখণ্ড, আমাদের সবাই সেই বাংলাদেশকে মুক্ত করার লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার ভিত্তি। সম্প্রীতির চেতনা ছিল একমাত্র সুতা, যা আমাদের একসঙ্গে গেঁথে রেখেছিল, আমরা কখনোই অন্য কিছু ভাবিনি। যা হোক, একসময় বাংলাদেশ অগণতান্ত্রিক শাসনের অধীনে চলে গেলে সেই সম্প্রীতিকে কিছুটা হলেও নষ্ট করার ঘটনা ঘটেছিল। এমনকি এটি যেকোনো সময় ঘটতে পারে যদি সম্প্রীতির বন্ধন সঠিকভাবে বজায় না থাকে। আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে এমন কোনো উপাদান আমাদের সমাজে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, যার ফলে আমাদের জনগণের মধ্যে বিদ্যমান সম্প্রীতি নষ্ট হয়।

সম্প্রীতির প্রয়োজনীয়তা বোঝার জন্য আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব এবং অবদান পর্যালোচনা করা আবশ্যক। সম্প্রীতি কোনো একটি নির্দিষ্ট সীমানা বা সীমিত এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটি বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওখানকার সীমানা অতিক্রম করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ সম্প্রীতি শুধু একটি দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীতেই নয়, বরং অন্যান্য দেশে, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, জাতিগত বা সম্প্রদায়গত—সব ক্ষেত্রেই আমরা সম্প্রীতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি। নির্দ্বিধায় বলা যায়, একটি দেশ ততটাই শক্তিশালী হবে তার জনগণের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন যতটা শক্তিশালী থাকে।

সাম্প্রায়িকতা সম্প্রীতির বন্ধনকে আলগা করে দেয়; বিশ্বাস, বন্ধুত্ব আর মানবিকতাকে বিনষ্ট করে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা সফরে গেলে সেখানকার প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত জনতার মহাসমুদ্রে ভাষণদানকালে বলেছিলেন, ‘এ দেশের মাটি থেকে আপনারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প নিশ্চিহ্ন করুন। আমার দেশের জনগণ সাম্প্রদায়িক নয়। সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী শ্রেণিই দুই দেশে সাম্প্রদায়িকতার উসকানি দিয়েছিল। আর এরই জন্য বারবার ব্যাহত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার জন্য জাতীয় আন্দোলন।’ বিশ্বশান্তির উন্নয়ন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই চ্যালেঞ্জিং কাজে ব্যর্থ হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। অবিশ্বাস এবং সংঘর্ষে ছিন্ন বিশ্বে এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জন অন্যদের জন্য একটি মডেল হতে পারে। আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে একসঙ্গে আমরা বিশ্বশান্তির উন্নয়নে মূল্যবান অবদান রাখব।’ বঙ্গবন্ধুর এই কয়েকটি শব্দ থেকে আমরা শান্তি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে আমাদের সমাজে সম্প্রীতির ভূমিকা উপলব্ধি করতে পারি। একই সময়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনো অপশক্তিই এই সম্প্রীতিতে ফাটল ধরাতে না পারে।

মানবজাতির উন্নয়নের জন্যই একটি দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্প্রীতি থাকা অত্যন্ত জরুরি। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সম্প্রীতির অর্থ হচ্ছে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্প্রীতি। এ সম্প্রীতি উভয় দেশকেই উন্নতির দিকে নিয়ে যায় পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা এবং বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে। এটি হচ্ছে এমন একটি সেতুবন্ধ, যা অবশেষে সবাইকে শান্তির প্রসবন ধারায় সিক্ত করে। সম্প্রীতি আমাদের সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করছে। সুতরাং এমন পরিবেশে বসবাসকারী মানুষ অবশ্যই শান্তিতে এবং সুস্থভাবে দিন কাটাতে সক্ষম হয়।

বাংলাদেশের মানুষ সম্প্রীতি ও শান্তিতে বিশ্বাসী। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে সম্প্রীতিরই মৌলিক কথা বলা হয়েছে। সেখানে বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রাখার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি হলো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বৈরিতা নয় এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। বাংলাদেশ এই অনুভূতির প্রতিফলন শুধু তার নাগরিকদের মধ্যে নয়, বরং বিশ্বসম্প্রদায় এবং সমস্ত জাতির মধ্যে দেখতে চায়।

এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে মি রবার্ট কেনেডি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সফরকালে বলেছিলেন, ‘আমেরিকার বাস্তব পররাষ্ট্রনীতি হলো নাগরিকের প্রতি নাগরিক, বন্ধুর প্রতি বন্ধু, জনগণের প্রতি জনগণ, ভ্রাতৃত্বের বৈদেশিক বন্ধন, যা কোনো শক্তি প্রয়োগ করে কমাতে পারে না। এক অর্থে, আমরা সবাই বাঙালি, আমরা সবাই আমেরিকান এবং আমরা সবাই মানবতার মহান জোটের অংশীদার। যারা সন্দেহ করে যে স্বাধীনতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ আজকের বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষমতাবান শক্তি, তাদের বাংলাদেশ ঘুরে আসতে দিন।’

এখনো আমরা অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বা যোগাযোগের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এর অর্থ হলো, দুটি দেশের মধ্যে কখনো সম্পর্ক স্থাপিত হবে না, যদি দুই জনপদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক না থাকে। প্রকৃতপক্ষে দুটি মানুষের মধ্যে বোঝাপড়া এবং অনুভূতিই দুটি দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ত্বরান্বিত করে। সেই বন্ধন আর কিছুই নয়, একই উদ্দেশ্যে দুই দেশের মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্প্রীতি।

আমাদের বিশ্বাস জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ধনী-দরিদ্র-নির্বিশেষে পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলেই পুরো বিশ্বের উন্নয়ন এবং তার জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় কল্যাণমূলক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। একবার শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা গেলে বিশ্ব নিজের থেকেই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে। এবং সেই উন্নয়নের ফলে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে শান্তির পতাকা দিনরাত পতপত উড়বে।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ