1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

‘দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক’

চিররঞ্জন সরকার : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১

১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা হয়েছে। বরিশাল জেলার আগরপুর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণদিয়া গ্রামে কয়েক হাজার হিন্দু আশ্রয় নেয়। তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন বরিশাল সদর মহকুমা মুসলিম লীগের সভাপতি, বরিশাল জেলা মুসলিম লীগের সহসভাপতি এবং আগরপুর ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট আলতাফউদ্দীন। তিনি কিছু গ্রামবাসী নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ করার সংকল্প করেন এবং নিজেই বন্দুক হাতে আশ্রয়প্রার্থীদের পাহারায় নিযুক্ত হন।

১৮ ফেব্রুয়ারি দাঙ্গাকারীরা দলবেঁধে আক্রমণ করতে আসে। আলতাফউদ্দীন তাদের নিরস্ত করতে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। দুর্বৃত্তরা দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করে পাল্টা বল্লম ছোড়ে। আলতাফউদ্দীন তাতে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে, তাকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার জের ধরে দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে অনেকে এগিয়ে আসে এবং পরদিন বরিশালের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে এক সশস্ত্র পুলিশবাহিনী ওই গ্রামে দাঙ্গা দমন করতে থেকে যায়।

আলতাফউদ্দীনের আত্মত্যাগের ফলে সেদিন অনেক প্রাণ রক্ষা পায়। তার জীবনদান নিয়ে জসীম উদদীন একটি মর্মস্পর্শী কবিতা লেখেন। রণদাপ্রসাদ সাহা তার স্মৃতিরক্ষায় ৩৫ হাজার টাকা দান করেন এবং আরও ৭০ হাজার টাকা দানের প্রতিশ্রুতি দেন। আগরপুরে আলতাফউদ্দীন-প্রতিষ্ঠিত মডেল একাডেমীর নাম পরিবর্তন করে শহীদ আলতাফউদ্দীন মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউশন করা হয় এবং সরকার তার পরিবারের সাহায্যার্থে ৫০ বিঘা খাস জমি প্রদান করে। মৃত্যুর সময় আলতাফউদ্দীনের বয়স ছিল ৪৩ বছর।

১৯৬৪-এর জানুয়ারি। সীমান্তের দুপারে আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়। ঢাকায় নবাবপুর রোডে ছিল আমীর হোসেন চৌধুরীর রিমা কেমিক্যালসের কারখানা এবং বাসভবন। আমীর হোসেন চৌধুরী ছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কনিষ্ঠ ভগ্নী হোমায়েরা খাতুনের একমাত্র পুত্র। তিনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও মুকুন্দ দাস সম্পর্কে ইংরেজি ও বাংলায় একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। নজরুলের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করার পাশাপাশি সুতি কাপড়ে রঙিন মুদ্রণ ও ছাতার কাপড় সম্পর্কেও ইংরেজিতে বই লেখেন। দাঙ্গার সময় প্রতিবেশী হিন্দুর বাড়ি আক্রান্ত হলে আমীর হোসেন চৌধুরী তাদের রক্ষা করতে ছুটে যান এবং দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ হারান। তখন তার বয়স ছিল ৫৩ বছর।

সেবারই দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে গিয়ে আরও একজন আত্মাহুতি দেন। তিনি জিন্নাত আলী মাস্টার। সেবছরের শেষদিকে প্রকাশিত জীবনকথা বইটি জসীম উদদীন উৎসর্গ করেন আমীর হোসেন চৌধুরী, জিন্নাত আলী মাস্টারসহ যারা নিজের জীবন বিপন্ন করেও দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা দূর করতে চেয়েছিলেন, তাদের সবাইকে।

গত কবছর ধরে বাংলাদেশের পুব-পশ্চিমে, উত্তর-দক্ষিণে নানা জায়গায় হিন্দু ও বৌদ্ধদের পীড়ন করা হয়েছে। ঘটনাগুলোর ধরন একইরকম। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া। লুটপাট ও ত্রাস সৃষ্টি, একইসঙ্গে উপাসনালয় ও প্রতিমার ধ্বংসসাধন করে উপাসকদের মনে ভীতির সঞ্চার করা। ভয় পেয়ে তারা যেন ভিটেবাড়ি ও দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, সেটাই মনে হয় আক্রমণকারীদের লক্ষ্য। প্রশাসনের যে সক্রিয়তা আশা করা হয়েছিল, তা দেখা যায়নি বরং ঔদাসীন্য বা অপারগতা দেখা গেছে।

হ্যাঁ, রাজনীতিও ছিল। সেটা ধর্মীয় মৌলবাদী তোষণের রাজনীতি। নাগরিকসমাজ এসব প্রতিরোধ করতে তাৎক্ষণিক ও তাৎস্থানিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, পরে কিছু প্রতিবাদ হয়েছে। কিছু সাংগঠনিক উদ্যোগও নেয়া হয়েছে, যা যথেষ্ট নয়। সরকার অনেক ধর্মস্থান ও ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর পুনর্নির্মাণ করে দিচ্ছে বটে, তাতে ভাঙাবাড়ি জোড়া লাগবে, ভাঙামন জোড়া লাগবে কি?

যখন বলা হয়, বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ- তখন কি এসব সাম্প্রদায়িক ঘটনার কথা বিস্মৃত হয়ে বলি? যারা বলে, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তারা কি নিজেদের প্রবোধ দেয় মাত্র? বাংলাদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক নয়, এ কথা আমি সাধারণভাবে মানি। কিন্তু তাদের মধ্যে যে অনেকে সাম্প্রদায়িক এবং সক্রিয়ভাবে অন্যধর্মের প্রতি বিদ্বিষ্ট, এর প্রমাণ তো চাক্ষুষ দেখা যাচ্ছে। সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা গেলেও, রাষ্ট্রধর্মের বিধান বর্জিত হয়নি— সেটি কাদের মুখ চেয়ে? এই গোঁজামিলের মতো অবস্থা কি বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি। বেশ আছে সবাই, পরস্পর ভাই ভাই। কিন্তু কখন যে কে কার মাথায় বাড়ি দেবে, তার ঠিক নেই। আর দিলে ওটা অগ্রজের শাসন বলে মেনে নিতে হবে।

নিজেদের ব্যর্থতা সবাইকে স্বীকার করতে হবে। রাজনৈতিক ব্যর্থতা আছে, আছে সামাজিক ব্যর্থতাও। যারা ধর্মপ্রাণ, তারা সবাইকে বোঝাতে পারেনি যে, অন্য ধর্মাবলম্বীকে আঘাত করা ধর্মীয় নির্দেশের পরিপন্থি। যারা ইহজাগতিক- নিত্য মানবতা, শুভাশুভ, ন্যায়-অন্যায়ের কথা বলে, তারাও সমাজে যথোচিত প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়নি। ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারা বরং ভেদবুদ্ধির মন্ত্র দিয়ে যাচ্ছে মানুষের কানে।

আজ হিন্দু-মুসলমান আলাদা, কাল শিয়া-সুন্নি পৃথক, পরশু আহমদিয়ারা মুসলমান নয়— এরকম বলেই যাচ্ছে এবং তাদের কথা শোনার মতো লোকও পাওয়া যাচ্ছে। একাত্তরের ঐক্য কোথায় গেল? দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে অতি অল্পসময়ে রাজনৈতিক নেতারা মানুষকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল, তেমন নেতৃত্ব এখন কোথায়?

দেশপ্রেম মানে কোনো ভূখণ্ডের নদীনালা, পাহাড়-সমুদ্র, গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি ইত্যাদির প্রতি প্রেম নয়। দেশপ্রেম মানে হওয়া উচিৎ দেশের মানুষের প্রতি প্রেম; লাঞ্ছিত, বঞ্চিত আর অবহেলিত গণমানুষের প্রতি ভালোবাসা। সবারই জানা আছে, রাষ্ট্রের প্রধান উপাদান হলো জনসমষ্টি। এই জনসমষ্টিকে বাদ দিয়ে শুধু কতগুলো প্রাণহীন নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত আর মাটির প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টিকে আর যা-ই বলা হোক- ‘দেশপ্রেম’ বলে অভিহিত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

রবীন্দ্রনাথ তার ‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছিলেন-

“দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ মানুষে তৈরি। আমাদের চারদিকে আজ মানুষ রক্ষা নয়, দেশরক্ষার সমবেত সঙ্গীত। দেশপ্রেমের সংকীর্ণ চোরাগলিতে এসে মানুষ হারিয়ে গেছে। বড় হয়েছে ভূখণ্ড, তথাকথিত জাতি, ধর্মীয় চেতনা ইত্যাদি। ওদিকে ‘মানুষ’ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। অকাতরে মার খাচ্ছে। আদিবাসীরা মার খাচ্ছে, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানরা মার খাচ্ছে, হরিজন-দলিতরা মার খাচ্ছে, সম্পদের দিক থেকে যারা প্রান্তিক, সংখ্যালঘু-তারা মার খাচ্ছে। মানবতাহীন ‘দেশপ্রেমের’ এই চেতনা দেশের প্রান্তিক মানুষদের ‘দেশছাড়া’ হতে প্রতিনিয়ত উৎসাহ ও মদদ যোগাচ্ছে। উস্কানি দিচ্ছে।”

দেশ মানে শুধু মাটি, পতাকা আর সীমানা নয়। মানুষ নিয়েই আসল দেশ। সেখানেই যদি গোলমাল থাকে তবে সে দেশ থাকলেই কি আর না থাকলেই কি? ওরকম দেশপ্রেমের কোনো মূল্য নেই, মূল্য থাকতে পারে না। মানুষ দেশের কাছে দায়বদ্ধ না বরং দেশই মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। যে নাগরিক তার দেশের কাছ থেকে নিরাপত্তা পায় না, নাগরিক হিসেবে সম্মান পায় না, সে কোন দুঃখে সে দেশের কথা বলবে? সেই দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখাবে?

দেশ কী রকম হওয়া উচিৎ সেটা নিয়ে কলকাতার শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রের গাওয়া অসাধারণ একটা গান আছে। সে গানের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই- ‘এ মানচিত্র জ্বলছে জ্বলুক, এই দাবানল পোড়াক চোখ, আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক।’

লেখক: চিররঞ্জন সরকার, প্রবন্ধকার, সাবেক ছাত্রনেতা।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ