1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

দারিদ্র্য বিমোচন : বিস্ময়কর সাফল্যের নেপথ্যে

নিজস্ব প্রতিবেদক : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৮

দারিদ্র্য বিমোচন : বিস্ময়কর সাফল্যের নেপথ্যে
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো আর সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের শোষণ-বঞ্চনার শিকার দারিদ্র্যপীড়িত এক জনগোষ্ঠী। মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশেরও বেশি মানুষ বাস করত দারিদ্র্যসীমার নিচে। ছিল না মৌলিক চাহিদার ন্যূনতম সংস্থান। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর প্রথম নির্দেশনা ছিল এমন একটি সংবিধান রচনা করা, যা ‘পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন’পূর্বক ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা’সহ ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার’ নিশ্চিত করা (অনুচ্ছেদ ১৫)। সংবিধানের পরিকল্পিত উন্নয়ন দর্শনকে ধারণ করে ১৯৭৩ সালে শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কার্যক্রম। এ পরিকল্পনার দ্বিতীয় অধ্যায়ে যে বারোটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রথমটিই ছিল দারিদ্র্য হ্রাস। এমডিজি ও এসডিজির প্রথম অভীষ্টই হলো দারিদ্র্য হ্রাস। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের গুরুত্ব স্পষ্টীকরণের জন্য উদ্ধৃত হয়েছে ‘This is the foremost objective of the Plan’।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রাক্কলন অনুযায়ী সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের (২০১৭-১৮) অবসানান্তে দেশের দারিদ্র্য হার দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৮ শতাংশে; উচ্চদারিদ্র্য রেখা অনুযায়ী দেশের প্রায় ৭৮ ভাগ লোক এখন দারিদ্র্যমুক্ত। দারিদ্র্যের যে কালচিত্র (দারিদ্র্য হার ৮০ শতাংশের বেশি) সঙ্গী হয়েছিল সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের, সাড়ে চার দশকের পথপরিক্রমা শেষে তার ঠিক বিপরীত প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে দেশটি। নতুন এ বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে দারিদ্র্যের ঐতিহাসিক গতিধারার বিচার-বিশ্লেষণ এখন সময়ের দাবি। অবশ্য দারিদ্র্য পরিমাপের পদ্ধতিগত বিবর্তন এক্ষেত্রে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে; ১৯৯১-৯২ অর্থবছরের আগে বর্তমানে প্রচলিত মৌলিক চাহিদা ব্যয় (Cost of Basic Needs-CBN) পদ্ধতি নয়; ব্যবহূত হতো খাদ্যশক্তি গ্রহণ (Food Energy Intake-FEI) এবং প্রত্যক্ষ ক্যালরি গ্রহণ (Direct Calory Intake-DCI) পদ্ধতি।
বাংলাদেশে ‘প্রথম খানা ব্যয় জরিপ’ (খানা আয়-ব্যয় জরিপ’ নয়) পরিচালিত হয় ১৯৭৩-৭৪ সালে। এ জরিপ অনুযায়ী দেশের ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ উচ্চদারিদ্র্য রেখার নিচে বাস করত। এ সময় চরম দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের সংখ্যা ছিল ৪৮ শতাংশ। পরবর্তী দশকের প্রথম খানা জরিপে (১৯৮১) দেখা যায়, দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ৭৩ শতাংশে, কিন্তু চরম দারিদ্র্যের হার এর মধ্যে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে (১৯৯১) দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের হার ছিল যথাক্রমে ৫৬ দশমিক ৭ ও ৪১ দশমিক ১ শতাংশ। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কিছুটা হ্রাস পায়; দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের হার সামান্য কমে ৪৮ দশমিক ৯ ও ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়ায়। খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১০ অনুযায়ী বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ; চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি দশকের মাঝামাঝি সময়ে পরিচালিত খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬ প্রদত্ত উপাত্ত অনুযায়ী দেশে বর্তমান দারিদ্র্য হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ ও চরম দারিদ্র্য হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। দশকটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিগত দশকগুলোর সঙ্গে এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ সমীচীন হবে না। বরং সর্বশেষ জরিপ হিসেবে-২০১৬ সালের তথ্য-উপাত্তগুলোকে পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
কেবল মাথাগুনতি হিসেবে দারিদ্র্য হার নয়, দারিদ্র্যের গভীরতা ও তীব্রতা হ্রাসেও বাংলাদেশের সাফল্য ছিল লক্ষণীয়। ২০০৫ সালে উচ্চদারিদ্র্য রেখা অনুযায়ী দারিদ্র্যের গভীরতা ও তীব্রতা ছিল যথাক্রমে ৯ ও ২ দশমিক ৯। সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা যায়, দারিদ্র্য গভীরতা ৫ ও তীব্রতা ১ দশমিক ৫-এ নেমে এসেছে। নিম্নদারিদ্র্য রেখা হিসেবে একই ধরনের আশাব্যঞ্জক চিত্র প্রদর্শিত হয়। ২০০৫-১৬ সময়ে দারিদ্র্য গভীরতা ৪ দশমিক ৬ থেকে ২ দশমিক ৩-এ নেমে এসেছে; তীব্রতা ১ দশমিক ৩ থেকে দশমিক ৬-এ।
দারিদ্র্য বিমোচনে এ সাফল্যের কারণ খুঁজতে গেলে একাধিক পরস্পরসংশ্লিষ্ট নির্দেশকের অবদান পাওয়া যাবে। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় বর্তমান সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রচেষ্টার কথা। গত নয় বছরে বাংলাদেশের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশেরও বেশি। এ সময়েই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো প্রবৃদ্ধি অর্জনে ৭ শতাংশের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। বিশ্বব্যাংকের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলারে, যা ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ছিল মাত্র ৫৪৩ মার্কিন ডলার; বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। বিস্ময়করভাবে এ সময়ে মূল্যস্ফীতিও ছিল সহনসীমার নিচে (৬ শতাংশের কম)। দেশ অর্জন করেছে খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। আর এসব কিছুই অবদান রেখেছে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধিতে, যা দারিদ্র্য হ্রাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব। বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি হলো দ্রুতগতিতে দারিদ্র্য হ্রাসের প্রধানতম নিয়ামক। একজন শ্রমিক তার দৈনিক আয় দিয়ে যত কেজি মোটা চাল কিনতে পারে, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা প্রকৃত মজুরি হিসেবে ধরা যায়। ২০০৯-১০ সালের আগে কৃষি খাতে নিযুক্ত একজন মজুর দৈনিক আয়ে চাল কিনতে পারত ছয় কেজিরও কম, বর্তমানে একজন কৃষি শ্রমিকের দৈনিক আয় ১০ কেজি চালের সমতুল্য। স্বাভাবিকভাবে দেশের দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা হ্রাসে এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।
দারিদ্র্য হ্রাসের এ সাফল্যচিত্র অবশ্য নতুন কিছু করণীয় সামনে নিয়ে আসে। অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিধারা অনুযায়ী, একটি দেশের অর্থনীতির আকার যত বাড়তে থাকে এবং কমতে থাকে দারিদ্র্যের হার, তখন কিছু আনুষঙ্গিক উপসর্গ দেখা দেয়। প্রথমত, দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে যায়, ধীরগতিতে হলেও বাড়তে থাকে অসমতা। খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের বেলায়ও এমনটি ঘটেছে। ২০১০-১৬ সময়ে বছরপ্রতি ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমেছে। অথচ ২০০৫-১০ সময়ে কমার এ হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ। অসমতা পরিমাপের একটি প্রচলিত পদ্ধতি হলো জিনি সহগ (Gini Coefficient)। ২০১০ সালে আয়সংশ্লিষ্ট জিনি সহগের মান ছিল দশমিক ৪৫৮, যা ২০১৬ সালে কিছুটা বেড়ে দশমিক ৪৮৩-এ উন্নীত হয়। অবশ্য ভোগসংশ্লিষ্ট জিনি সহগ এক দশক ধরে কমবেশি স্থিতিশীল রয়েছে (২০০৫: দশমিক ৩৩২, ২০১০: দশমিক ৩২১, ২০১৬: দশমিক ৩২৪)। অর্থাৎ ভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য তেমন বাড়েনি।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান দূরদর্শী সরকার এ বিষয়ে আগেভাগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সরকারের দারিদ্র্য ও অসমতা হ্রাসের গতিকে বেগবান করার জন্য সরকারের সব সামাজিক সুরক্ষামূলক কার্যক্রমের সমন্বিত ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে প্রণীত হয়েছে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র। এ কৌশলের দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্প হলো: বাংলাদেশের সব (সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা লাভের) যোগ্য নাগরিকের জন্য এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা কার্যকরভাবে দারিদ্র্য ও অসমতা প্রতিরোধ ও মোকাবেলা করতে পারে এবং ব্যাপকতর মানবোন্নয়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারে।
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল মূলত একটি জীবনচক্রভিত্তিক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে প্রণীত। একজন মানুষের জন্মের আগে থেকে (গর্ভাবস্থায়) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিভিন্ন বয়স স্তরের ভিন্ন ভিন্ন চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে একটি সুসংহত সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই এ কৌশলের মূল উদ্দেশ্য। এ কৌশলে শিশুদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে: শিশু বা কম বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য অনুদান সহায়তা; বিদ্যালয়ে উপবৃত্তি কর্মসূচির সম্প্রসারণ; অভিভাবকহীন শিশুদের জন্য পরিচর্যা সহায়তা নিশ্চিতকরণ; কর্মজীবী মায়েদের জন্য মাতৃত্ব ভাতা এবং একগুচ্ছ পরিপূরক কর্মসূচি, যা প্রত্যক্ষভাবে শিশুকল্যাণ নিশ্চিত করবে। কর্মোপযোগীদের জন্য (তরুণ জনগোষ্ঠীসহ) কর্মসূচির মূলে থাকবে কর্মসৃজনমূলক (ওয়ার্কফেয়ার) কর্মসূচিগুলোর একীভূতকরণ ও বেকারত্ব বীমা; পাশাপাশি কর্মোপযোগী নারীদের জন্য থাকবে বিশেষ ব্যবস্থা। বয়স্কদের জন্য ব্যাপকভিত্তিক পেনশন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে, যার তিনটি স্তর রয়েছে: প্রথম স্তর সরকার অর্থায়িত সুবিধা, যা দরিদ্র ও ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীভুক্ত বয়স্ক নাগরিকদের ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা প্রদান করবে (বয়স্ক ভাতা সম্প্রসারণ); দ্বিতীয় স্তর বেসরকারি আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত কর্মীদের জন্য অংশগ্রহণমূলক পেনশন কর্মসূচি (জাতীয় সামাজিক বীমা স্কিম) এবং তৃতীয় স্তর বেসরকারি খাত পরিচালিত স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণমূলক (ভলান্টারি) পেনশন কর্মসূচি (কখনো কখনো কর্মসংস্থানভিত্তিক স্কিম); কোনো নাগরিক বার্ধক্যকালে অতিরিক্ত আয় সহায়তা পেতে ইচ্ছুক হলে এটি গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া এ কৌশলে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী, মুক্তিযোদ্ধা ও সামাজিকভাবে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কর্মসূচি রয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্ষুদ্র কর্মসূচিগুলোকে সংহত করে বৃহত্তর প্রভাব সৃষ্টির উপযোগী করে তোলা হচ্ছে, ভাতার প্রকৃত মূল্য অক্ষুণ্ন রাখার উদ্দেশ্যে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে করা হচ্ছে সঙ্গতি সাধন। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ব্যবস্থার সংস্কার সাধন, একক রেজিস্ট্রিভিত্তিক তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রসারে সরকার থেকে সুবিধাভোগী (জিটুপি) পেমেন্ট সিস্টেম শক্তিশালীকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর সুবিধাভোগী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শক্তিশালীকরণ এবং অভিযোগ ও বিবাদ নিষ্পত্তির ব্যবস্থাসহ একটি ফলাফলভিত্তিক পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা সূচিত হয়েছে এ কৌশলের মাধ্যমে। বলা যায়, দারিদ্র্য ও অসমতা হ্রাসে নবগতি আনয়নে সরকার প্রস্তুত।
খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬ থেকে অবশ্য দেশের আঞ্চলিক বৈষম্যের কিছুটা উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকভাবে দারিদ্র্যপ্রবণ কুড়িগ্রাম জেলায় দারিদ্র্যের হার এখনো উদ্বেগজনক (৭০ দশমিক ৮ শতাংশ), পার্বত্য চট্টগ্রামভুক্ত রাঙ্গামাটি জেলায় দারিদ্র্যের হার ৬৪ শতাংশ। তদুপরি নতুন পভার্টি পকেট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে দিনাজপুর (৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ) ও মাগুরার (৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ) মতো জেলা। দেশে এখন পূর্ব-পশ্চিম বৈষম্য আবারো সুস্পষ্ট। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পশ্চাত্পদ অঞ্চলের জন্য রয়েছে পৃথক কৌশলমালা। এসব কৌশলের পুরোভাগে রয়েছে পশ্চাত্পদ অঞ্চল তহবিল (Lagging Region Fund) গঠন: পশ্চাত্পদ অঞ্চলগুলোর অধিকতর সুবিধা দান, কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দানসহ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত একটি পৃথক তহবিল তৈরির কথা বলা হয়েছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। এ তহবিল ছাড়াও পশ্চাত্পদ অঞ্চলের জন্য আরো কিছু কৌশল গ্রহণের কথা বলা হয়েছে সপ্তম পরিকল্পনায়। যেমন: অবকাঠামো ব্যবধান কমিয়ে আনা; ম্যানুফ্যাকচারিং সুবিধা বৃদ্ধি করা; কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ; আন্তর্জাতিক অভিবাসনের সুযোগ সৃষ্টি এবং বৈরী পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাত সহনশীলতা নির্মাণ। বাজেট প্রণয়নে এসবের প্রতিফলন থাকা প্রয়োজন।
পশ্চাত্পদ অঞ্চলের অবস্থার পরিবর্তনে বর্তমান সরকারের আন্তরিকতাও রয়েছে। আমরা সবাই জানি, নিকট অতীতেই উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায় (কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও রংপুর) আমন ফসল রোপণের পর (সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর) ও বোরো ধান রোপণ-পরবর্তী মৌসুমে (মার্চ থেকে এপ্রিল) কৃষিশ্রমের অভাবজনিত প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করত। সরকারের নানামুখী উদ্যোগ, বিশেষ করে কৃষির বহুমুখীকরণ, বিরি ও বিনার মাধ্যমে খরাসহিষ্ণু ও জলাবদ্ধতাসহিষ্ণু উৎপাদনক্ষম ধান জাতের প্রচলন, পতিত জমিতে সবজি উৎপাদনে উৎসাহ প্রদানসহ ভর্তুকি ও প্রশিক্ষণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারের মাধ্যমে এ অঞ্চলে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যান্সের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৮ সালের আগে মঙ্গাকালে ওই পাঁচ জেলার মাত্র ২৩ শতাংশ পরিবার তিনবেলা খেতে পারত। ২০১৩ সালের আগেই এ সংখ্যা ৭৪ শতাংশে নেমে আসে। এ সময়ে এ অঞ্চলে পরিবারপ্রতি গড় বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৭৮ হাজার ১০০ টাকায়, যা আগে ছিল ৩৫ হাজার ৪০০ টাকা। ২০১৮ সালে দাঁড়িয়ে মঙ্গার দূরতর প্রতিধ্বনিও আর শোনা যায় না।
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলসহ রূপকল্প-২০২১ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার উদ্দেশ্যগুলো সামনে রেখে সরকার দরিদ্রবান্ধব বাজেট প্রণয়ন করে যাচ্ছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৭৩ দশমিক ২ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বাজেটের দশমিক ৬১ শতাংশ ও জিডিপির মাত্র দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার তাদের পূর্ববর্তী মেয়াদে প্রচলিত ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’ ধারণাকে আরো সুসংহত করে। ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যায় একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৪ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা; যা মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৮১ শতাংশ ও প্রক্ষেপিত জিডিপির ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় ২৮ গুণ।
সরকার দারিদ্র্য বিমোচন প্রচেষ্টার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগ: ১. একটি বাড়ি একটি খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক; ২. আশ্রয়ণ প্রকল্প; ৩. ডিজিটাল বাংলাদেশ; ৪. শিক্ষাসহায়তা কর্মসূচি; ৫. নারীর ক্ষমতায়ন; ৬. ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ; ৭. কমিউনিটি ক্লিনিক ও মানসিক স্বাস্থ্য; ৮. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি; ৯. বিনিয়োগ বিকাশ এবং ১০. পরিবেশের সুরক্ষা। এ মহতী উদ্যোগগুলোর প্রতিটিই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দারিদ্র্য ও অসমতা হ্রাসের সঙ্গে জড়িত।
প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত উপকূলীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপদ আবাসন নিশ্চিতকল্পে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনটি ফেজে আশ্রয়ণ প্রকল্প (৯১৯৭-২০০২), আশ্রয়ণ প্রকল্প (ফেজ-২) (২০০২-১০), আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প (২০১০-১৭) মোট ১ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। অব্যাহত চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের বর্ধিত মেয়াদে (২০১০-১৯; সংশোধিত) আড়াই লাখ গৃহহীন পরিবারের আবাসন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
এ ধারায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো ‘চর ডেভেলপমেন্ট ও সেটলমেন্ট প্রকল্প’, যা ভাঙনকবলিত গৃহহীন মানুষের জীবিকা ও আশ্রয় প্রদায়ী এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে একাধিক মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ও সংস্থা এবং এনজিওদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত মানুষকে সব ধরনের মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় এ প্রকল্পের মাধ্যমে। এরই মধ্যে প্রকল্পের তিনটি ফেজ সমাপ্ত হয়েছে, চতুর্থটি চলমান এবং পঞ্চম ফেজ আলোচনাধীন রয়েছে। এক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপকূলে জেগে ওঠা নতুন চরগুলোকে বনায়নের মাধ্যমে স্থিতিশীল করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে জীবন ও জীবিকার সব উপাদানসহ এখানে গৃহহীন মানুষকে পুনর্বাসন করা হয়। চলমান সিডিএসপি-৪-এর মাধ্যমে চরনাঙ্গুলিয়া, নলেরচর, কেরিংচর, উড়িরচর ও চরজিয়াউদ্দিনে ২৮ হাজার দরিদ্র পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যেই গ্রামাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ আধুনিকায়ন ও গ্রামে গ্রামে বিদ্যুতায়নের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ