1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

অভির সঙ্গে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলেন তিন্নি

কামরুল হাসান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ১ নভেম্বর, ২০২১

লাশকাটা ঘরে পড়ে আছে লাশটি। ঠিকানা নেই, তাই মর্গের খাতায় নাম ওঠেনি। নাম নেই পুলিশের কাগজপত্রেও। এর নাম বেওয়ারিশ লাশ। ঢাকায় প্রতিদিন ছয়-সাতজন এভাবে বেওয়ারিশ হয়। ওই তরুণীও সেভাবেই বেওয়ারিশ হয়েছিলেন। যখন পরিচয় পাওয়া গেল, ততক্ষণে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম তাঁকে দাফন করে ফেলেছে। কে জানত, এত জনপ্রিয় মেয়েটি!

জনকণ্ঠের কেরানীগঞ্জ সংবাদদাতা ছিলেন সালাউদ্দিন আহমেদ। একদিন সন্ধ্যায় শার্টের বুক পকেটে করে একটি লাশের ছবি নিয়ে অফিসে হাজির। বললেন, ‘বস, এইডা একটু ছাপাইয়া দ্যান। দ্যাকতে বড় লোকের মাইয়ার মতন লাগে।’ সালাউদ্দিনের বর্ণনা ছিল, চীন-মৈত্রী সেতুর পশ্চিম দিক থেকে ১১ নম্বর পিলারের ওপর লাশটি পড়ে ছিল। কেরানীগঞ্জ থানার এএসআই শফিউদ্দিন লাশ উদ্ধার করেছেন। পুলিশ মনে করছে, মেয়েটি আত্মহত্যার জন্য বুড়িগঙ্গা ব্রিজ থেকে লাফ দিয়েছিল। কিন্তু পানিতে না পড়ে পিলারের ওপর পড়েছে। মিটফোর্ড মর্গে লাশ আছে, চার দিনে কেউ তাঁর খোঁজ নিতে আসেনি। পত্রিকায় ছবি ছাপা হলে হয়তো পরিচয় মিলবে। ২০০২ সালের কথা বলছি। তখন সংবাদপত্রে লাশের ছবি ছাপা নিয়ে অত রাখঢাক ছিল না। হরদম ছাপা হতো।

ছবিটি নিয়ে চিফ রিপোর্টারকে দেখালাম, পাত্তা পেলাম না। পরদিন বার্তা সম্পাদককে অনুরোধ করতেই বললেন, ‘পেজ টু-এ দিয়ে দেন।’ ‘এই তরুণীর পরিচয় নেই’ শিরোনামে তিন কলামজুড়ে ছাপা হলো অজ্ঞাত তরুণীর লাশের ছবি।

এটা ২০০২ সালের ১৬ নভেম্বর। ওই দিন দুপুরে ধানমন্ডি থেকে ফোন দিলেন অনু নামের এক যুবক। বললেন, ছাপা ছবিটির মূল ছবি তাঁরা দেখতে চান। সেটা দেখতে একটি পরিবার আমার অফিসে আসবে। কলাবাগান থেকে ইস্কাটনে জনকণ্ঠ ভবনে তাঁরা এলেন সন্ধ্যার দিকে। ছবিটি হাতে নিতেই সুজন নামে একজন বলে উঠলেন, ‘ঠিকই তো আছে।’ পাশে থাকা এক নারী ছবির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। তাঁর দেখাদেখি আরেকজনও শুরু করলেন কান্না। যতই চুপ করতে বলি, কেউ কথা শোনেন না। বললাম, এটা কার ছবি? কেউ বলেন না। তাঁদের সঙ্গে আসা অনু বললেন, এটা মডেল তিন্নি ওরফে সৈয়দা তানিয়া মাহবুবের ছবি। কয়েক দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। মাঝবয়সী এক নারীকে দেখিয়ে বললেন, ‘উনি তিন্নির ফুফু’।

একজন একটু শান্ত হয়ে জানতে চাইলেন, এখন তাঁদের কী করতে হবে। বললাম, আগে মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। সবাই গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।
ঘণ্টা দেড়েক পর অনুর ফোন: ‘ভাই, মর্গে তো লাশ নেই। আজ বিকেলে আঞ্জুমান জুরাইন কবরস্থানে দাফন কইরা ফেলছে।’ বললাম, এবার কেরানীগঞ্জ থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন। তিন্নির চাচা সৈয়দ রেজাউল করিমও সম্ভবত তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।

পরদিন ফলোআপ করতে তিন্নিদের কলাবাগানের বাড়িতে গেলাম। মনে হলো সবাই খুব ভয়ে আছেন। কেউ কিছু বললেন না। কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা হলো। তদন্ত শুরু করলেন এসআই কাইয়ুম আলী সরদার। তিনি তদন্তের শুরুতেই তিন্নির স্বামী শাফকাত হোসেন পিয়ালকে গ্রেপ্তার করলেন। পুলিশ ধরে নিয়েছিল, এ ঘটনার কয়েক দিন আগে তিন্নির সঙ্গে পিয়ালের ছাড়াছাড়ি হয়। সেই ক্ষোভেই পিয়াল মেয়েটিকে খুন করেছেন।

কেরানীগঞ্জ থানায় গিয়ে পিয়ালের সঙ্গে কথা বলতেই পেয়ে গেলাম আসল খবর। পিয়ালের এক বন্ধু সে সময় থানায় ছিলেন। বললেন, নামকরা একটি পত্রিকার কাভার ফটো হওয়ার পর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান তিন্নি। এরপর খুব কম সময়ে তিনি অনেকগুলো নামী পণ্যের মডেল হন। তাঁর এই সাফল্যের পেছনের মানুষ ছিলেন স্বামী শাফকাত হোসেন পিয়াল। তাঁদের তিন বছরের সংসারে দেড় বছরের একটি মেয়ে ছিল।

একদিন একটি পাঁচতারকা হোটেলের পার্টিতে এসে তিন্নির সঙ্গে পরিচয় হয় সাবেক সাংসদ গোলাম ফারুক অভির। অভির প্রেমে পড়ে যান তিন্নি। তখন অভি থাকতেন নিউ ইস্কাটনের প্রোপার্টি এনক্লেভের একটি ফ্ল্যাটে। সেখানে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন তিন্নি। অভির সঙ্গে কয়েকবার বিদেশেও যান। নতুন সম্পর্ক নিয়ে পিয়ালের সঙ্গে বিরোধ বাধে তিন্নির। তিন্নি সিদ্ধান্ত নেন পিয়ালকে ছেড়ে অভিকেই বিয়ে করবেন।

২০০২ সালের ৬ নভেম্বর পিয়ালের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে দেড় বছরের মেয়েকে স্বামীর কাছে রেখে অভির ইস্কাটনের ফ্ল্যাটে চলে আসেন তিন্নি। সেখানে থাকার সময় ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর রাতে তিনি খুন হন।

এই খুনের মামলা যাঁরা তদন্ত করেছিলেন, তাঁদের একজন সিআইডির এএসপি আরমান আলী। অভির গাড়িচালক, গৃহকর্মী ও ফ্ল্যাটের নিরাপত্তাকর্মীকে জেরা করেন তিনি। আরমান আলী আমাকে বলেছিলেন, ইস্কাটনের বাড়িতে এসে বিয়ের জন্য অভিকে চাপ দিতে থাকেন তিন্নি। কিন্তু অভি রাজি হচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে গণমাধ্যমের কাছে এ ঘটনা ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেন তিনি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অভি তিন্নির মাথায় আঘাত করেন। সঙ্গে সঙ্গে নিস্তেজ হয়ে পড়েন তিন্নি। এরপর গভীর রাতে অভি সেই মরদেহ গাড়িতে তুলে বুড়িগঙ্গা ব্রিজের কাছে যান। এরপর ব্রিজের ওপর থেকে লাশটি নদীতে ফেলে দেন। কিন্তু পানিতে না পড়ে লাশ পড়ে ব্রিজের পিলারের মাথার ওপর।

সাতজন তদন্তকারী এই মামলার তদন্ত করেন। ছয় বছর পর ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর চার্জশিট দিয়েছিলেন সিআইডির এএসপি মোজাম্মেল হক। অভিনেত্রী তমালিকা কর্মকার, অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয় ও নাট্যকার এজাজ খান এই মামলার সাক্ষী ছিলেন। আরেক সাক্ষী ছিলেন শীর্ষসন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন। ইমন পুলিশকে বলেছিলেন, তিন্নি খুনের পর অভি ঢাকা থেকে পালিয়ে নেপাল হয়ে কলকাতায় যান। কলকাতায় তাঁর আশ্রয়ে থাকার সময় তিন্নিকে খুন করার কথা স্বীকার করেন অভি।

এবার অভিকে নিয়ে কিছু বলতেই হয়। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার ধামুড়া গ্রামের আরশাদ আহমেদের চার ছেলে ও চার মেয়ে। ছেলেদের মধ্যে ছোট গোলাম ফারুক অভি। অসম্ভব মেধাবী অভি এসএসসিতে মেধাতালিকায় স্থান পান। ভাইবোনদের সবাই উচ্চশিক্ষিত, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ পদস্থ সরকারি চাকুরে। একজন নামকরা সাংবাদিক। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ‘হিফজুল বাহার’-এ সওয়ার হয়েছিলেন ছাত্রজীবনে। তারপর জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে ভিড়ে যান। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদকও হন। আরেক ছাত্রনেতা নীরুর সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন বিশাল এক বাহিনী। ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি তাঁরা নানা ধরনের সন্ত্রাসী কাজে জড়িয়ে পড়েন।

এরশাদবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ছাত্রদল প্রকাশ্যে থাকলেও অভি-নীরু গোপনে এরশাদের সঙ্গে আঁতাত করেন। এর মধ্যে ১৯৮৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন অভি। এতে তাঁর ভাগ্য খুলে যায়। জেলে এরশাদের লোকজন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরশাদের পক্ষে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন অভি। ১৯৯০-এর ২৭ নভেম্বর এরশাদের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নেতৃত্ব দেন অভি-নীরু। ওই দিন গুলিতে ডা. মিলন নিহত হলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে ওঠে। কয়েক দিন পর এরশাদের পতন হয়।

এনএসআইয়ের সাবেক পরিচালক সফিক উল্লাহ তাঁর বই ‘এক পুলিশের ডায়েরি’তে লিখেছেন, এরশাদের এক সেনা কর্মকর্তার নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে অভিদের জন্য সরকারি গুলি সরবরাহ করা হয়। পরে সেই গুলির কিছু অংশ রাজারবাগে ফেরতও দেওয়া হয়। রাজারবাগের অস্ত্রাগারের নথিতে এসব তথ্য রয়েছে।
ডা. মিলন হত্যার পর গোপনে কলকাতায় চলে যান অভি। ফিরে এসে বরিশাল-২ আসন থেকে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হন ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে। ২০০১ সালের নির্বাচনে ওই আসনে বিএনপির মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের কাছে হেরে যান।

অভির জীবন ছিল বেপরোয়া। বহু অভিনেত্রী, মডেল ও চিত্রনায়িকা তাঁর লালসার শিকার হয়েছেন। একবার ব্যক্তিগত ছবি ফাঁস করার অভিযোগে এক অভিনেত্রী তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। অভির সর্বশেষ শিকার মডেল তিন্নি।

অভির বিরুদ্ধে তিন্নি খুনের অভিযোগ ওঠে লাশ উদ্ধারের চার-পাঁচ দিন পর। এরপরই গা-ঢাকা দেন তিনি। শুনেছিলাম, একটি ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সহায়তায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নেপালে যান। সেখান থেকে কলকাতা হয়ে থিতু হন কানাডায়। রমনা থানার একটি অস্ত্র মামলায় অভির ১৭ বছরের সাজা হয়েছে। তাঁকে ধরতে ইন্টারপোল কয়েক দফা রেড নোটিশ জারি করেছিল। সব মিলিয়ে পুলিশি তৎপরতা বলতে ছিল এটুকুই।

এই লেখাটা শেষ করার আগে তিন্নির ফেলে আসা পরিবারের খোঁজ নিলাম। তাঁর মেয়ে এখন বাবার সঙ্গে বিদেশে থাকেন। তিন্নিরা ছিলেন দুই বোন, ছোট বোন এয়ারহোস্টেস। তাঁর প্রবাসী বাবা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এখন দেশে একাই থাকেন। তিন্নির মা স্বামীকে ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গেছেন। কলাবাগানে ফুফুর যে বাড়িতে তিন্নিরা থাকতেন, অভির ভয়ে সেটাও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় পরিবারটি। এভাবে একটি খুন লন্ডভন্ড করে দেয় গোটা একটি পরিবারকে। অথচ ঘটনার মূল হোতা অভি থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আসলে, ধর্মের কলও অনেক সময় বাতাসে নড়ে না।

সূত্র- আজকের পত্রিকা


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ