1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

’৭২-এর সংবিধানই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রক্ষাকবচ

শাহরিয়ার কবির : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ৫ নভেম্বর, ২০২১

৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। এই স্বাধীনতার জন্য প্রায় সোয়া চার লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন, পনেরো লাখেরও বেশি মানুষ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তাদের সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি দলের বিভিন্ন ঘাতক বাহিনীর নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এক কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে শরণার্থীর বিড়ম্বিত জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। স্বাধীনতার জন্য বিশ্বের অন্যকোনো দেশের মানুষ এত জীবনদান, নির্যাতন ও ত্যাগ স্বীকার করেনি।

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি ভূখণ্ড লাভ কিংবা পতাকা বদলের জন্য হয়নি। নয় মাসব্যাপী এই যুদ্ধ ছিল প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধ। দেশের কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষ এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সার্বিক মুক্তির আশায়। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধানে।

’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বদেশে ফিরে আসে। বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লিতে যাত্রা বিরতিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার জন্য এক বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। এই সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধী- দুজনের ভাষণই ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহান বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জনগণের উদ্দেশে বলেছিলেন- আমি আপনাদের তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আমার প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল, বাংলাদেশের শরণার্থীদের আমি সসম্মানে তাদের দেশে ফেরত পাঠাব। আমার দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে আমি সবরকম সহযোগিতা করব। আমার তৃতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল, শেখ মুজিবকে আমি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের করে আনব। আমি আমার তিনটি প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছি। শেখ মুজিব তার দেশের জনগণকে একটিই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দেবেন। তিনি স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।

এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাকে বলা হয়েছে ভারতের সঙ্গে আপনার কীসের এত মিল? আমি বলেছি ভারতের সঙ্গে আমার মিল হচ্ছে নীতির মিল। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও তাই বিশ্বাস করেন। আমাদের এই মিল হচ্ছে আদর্শের মিল, বিশ্বশান্তির জন্য…।

সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু একই দিনে দেশে ফিরে রমনার বিশাল জনসমুদ্রে আবারও বলেছিলেন- “বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।”

১৯৭২-এর ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের গণপরিষদের প্রস্তাবক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল গণপরিষদ, যাদের দায়িত্ব ছিল সংবিধান প্রণয়ন।

বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ছিলেন। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর ন্যাপ) থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন।

খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়- ’৭২-এর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসের প্রথম বার্ষিকীর দিন। ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান গণপরিষদে উত্থাপন করা হয় এবং বিস্তারিত আলোচনার পর ৪ নভেম্বর তা গৃহীত হয়। ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদের সদস্যরা এই সংবিধানে স্বাক্ষর করেন।

’৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘গণতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে। এই সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশের মতো একটি অনগ্রসর মুসলমানপ্রধান দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শের এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

’৭২-এর সংবিধান যাঁরা রচনা করেছেন তাদের সামনে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সংবিধান। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংবিধানসমূহ তারা অধ্যয়ন করেছেন। তারা পর্যালোচনা করেছেন এসব সংবিধানের সবলতা ও দুর্বলতা। লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের জন্য শ্রেষ্ঠতম সংবিধানটি তারা রচনা করবেন।

শুধু বিভিন্ন দেশের সংবিধান পর্যালোচনা নয়, জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাসহ মানবাধিকার-সংক্রান্ত অন্য দলিলসমূহের আলোকে আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ শীর্ষক অধ্যায়ে ২১টি অনুচ্ছেদ রয়েছে একাধিক উপচ্ছেদসহ।

সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে ‘রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি’ শীর্ষক অধ্যায়ে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যাসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মালিকানার নীতি, কৃষক শ্রমিকের মুক্তি, মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা, সুযোগের সমতা, নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, জাতীয় সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন-বিষয়ক বিধিমালায় একটি প্রগতি ও শান্তিকামী আধুনিক রাষ্ট্রের যাবতীয় অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে।

’৭২-এর ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এই সংবিধান যে সমগ্র বিশ্বের যাবতীয় সংবিধানের ভেতর অনন্য স্থান অধিকার করে আছে এ কথা পশ্চিমের সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও স্বীকার করেছন। বিশ্বের কোন দেশ কতটুকু সভ্য ও আধুনিক তা বিচার করবার অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ-গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সেই দেশটির সাংবিধানিক অঙ্গীকার এবং তার প্রয়োগ। বিশ্বের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক সংবিধানের জনক হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- যে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল ১৭৭৬ সালে।

মানবাধিকার শব্দটিরও জন্মদাতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এই যুক্তরাষ্ট্রের একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ‘সেন্টার ফর ইনক্যয়ারি’র পরিচালক ড. অস্টিন ডেসি আমাদের এক সেমিনারে বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ হিসেবে বাংলাদেশের ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠনের উপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানেও নেই। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় মৌলবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে।’

শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ হিসেবে ধর্মের নামে রাজনীতি সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বাইরে অন্যকোনো দেশ নিষিদ্ধ করতে পারেনি। এমনকি বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিবেশী ভারতের সংবিধানেও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুছে ফেলার পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে আলোকাভিসারী একটি জাতিকে সাম্প্রদায়িকতার কৃষ্ণগহ্বরে নিক্ষেপ করেছেন। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ’৭২-এর মহান সংবিধানের ওপর এই বলাৎকার বাংলাদেশে পাকিস্তানি ধারার সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার বিএনপি এবং তাদের প্রধান দোসর ’৭১-এর ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রচলন করতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা ও ইসলামবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে সব সময় বলে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ধার করেছে।

ধর্মব্যবসায়ীদের এই মিথ্যাপ্রচারণা তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছে, কারণ স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চিহ্নিত শত্রুরাই অধিককাল ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় থাকাকালীন তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জঘন্যভাবে বিকৃত করেছে। তারা সবক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে। খালেদা-নিজামীরা এবং তাদের তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবীরা অহরহ বলেন, ’৭২-এর সংবিধান রচিত হয়েছে ভারতের সংবিধানের মডেলে, ধর্মনিরপেক্ষতা নেয়া হয়েছে ভারতের সংবিধান থেকে। এসব জ্ঞানপাপীরা জানেন না যে, ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সংযুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হওয়ার চার বছর পর ১৯৭৬ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে।

বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করার সময় বঙ্গবন্ধু এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বহুবার বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালন ও প্রচারের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। শুধু রাষ্ট্র ও রাজনীতি ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবে, কোনো বিশেষ ধর্মকে প্রশ্রয় দেবে না। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ধর্মের নামে হানাহানি এবং ধর্মব্যবসা বন্ধের জন্যই এই নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন। এতে ধর্ম এবং রাষ্ট্র দুই-ই নিরাপদ থাকবে।

সেই সময় অনেক বামপন্থি বুদ্ধিজীবী ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাদের বক্তব্য ছিল সেক্যুলারিজমের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে- ‘ইহজাগতিকতা’। ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা যথেষ্ট নয়। সব ধর্মের প্রতি সমান আচরণ প্রদর্শন করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কোরাআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠ, ওআইসির সদস্যপদ গ্রহণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সেক্যুলার শিক্ষানীতি প্রণয়নে ব্যর্থতারও অনেক সমলোচনা তখন হয়েছে। পশ্চিমে সেক্যুলারিজম যে অর্থে ইহজাগতিক- বঙ্গবন্ধুর সংজ্ঞা অনুসারে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা সেরকম ছিল না। তার সেক্যুলারিজম ছিল তুলনামূলক নমনীয়, কারণ তিনি মনে করেছেন ধর্মের প্রতি ইউরোপীয়দের মনোভাব এবং বাংলাদেশসহ অধিকাংশ এশীয় দেশের মনোভাব এক রকম নয়।

ইউরোপে যারা নিজেদের সেক্যুলার বলে দাবি করে তারা ঈশ্বর-ভূত-পরলোক কিংবা কোনো সংস্কারে বিশ্বাস করে না। বঙ্গবন্ধু কখনও সে ধরনের সেক্যুলারিজম প্রচার করতে চাননি বাংলাদেশে। ধর্মব্যবসায়ী রাজনৈতিকদলগুলোর কারণে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন ও অনীহ কিন্তু একই সঙ্গে এদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মপরায়ণ। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুকে বলতে হয়েছে- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়, ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য রাজনীতিও রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক রাখা প্রয়োজন। কারণ- ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের বদৌলতে ধর্ম কীভাবে গণহত্যা ও ধর্ষণসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞের সমার্থক হতে পারে। যে কারণে ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি কারো মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। এভাবেই অনন্য হয়ে উঠেছিল ’৭২-এর সংবিধান।

মুক্তিযুদ্ধকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ বহুবার বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক পরিচয়ের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন। মুজিবনগর থেকে যে-সব পোস্টার বা ইশতেহার যুদ্ধের সময় বিলি করা হয়েছে সেখানেও অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি অবিস্মরণীয় পোস্টারের লেখা ছিল- ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খৃস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান- আমরা সবাই বাঙালী।’ ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা, ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানকে অস্বীকার করা এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে অস্বীকার করা।

জেনারেল জিয়া সংবিধানের ৫ম সংশোধনী জারি করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাতিল করেছেন, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছেন, সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ…’ এবং প্রস্তাবনাসহ একাধিক স্থানে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযোজন করেছেন। এরপর তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরেক উর্দিধারী জেনারেল এরশাদ সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর ’৭২-এর সংবিধানের ওপর এই বলাৎকার জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদকে মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের পঙক্তিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশ যদি একটি ইসলামিক দেশ হবে তবে ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের কী প্রয়োজন ছিল- এর জবাব এই দুই জেনারেলের অনুসারীদের দিতে হবে। ৩০ লাখ মানুষের জীবনদান, কয়েক কোটি মানুষের অপরিসীম দুঃখ দুর্দশা ও আত্মত্যাগের কি কোনো প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশে যদি ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ না থাকে? পাকিস্তান তো একটি ইসলামিক রাষ্ট্রই ছিল। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন করার প্রয়োজন হয়েছিল এদেশের মানুষ ইসলামের নামে শোষণ-পীড়ন, নির্যাতন-হত্যার রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করে একটি অসাম্প্রদায়িক কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিল বলে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধানকে গলা টিপে হত্যা করে সংবিধানঘাতক জিয়া-এরশাদ বাংলাদেশকে আজ জঙ্গি মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অভয়ারণ্যে পরিণত করেছেন। এদেশে এখন কোরআন ও সুন্নাহর আইন চালু করার নামে হত্যা করা হয়েছে ‘সংখ্যালঘু’ ধর্মীয় সম্প্রদায়, মুক্তচিন্তার লেখক ও অধ্যাপক, প্রগতিশীল রাজনৈতিকদলের নেতাকর্মীদের।

’৭২-এর সংবিধান কার্যকর থাকলে বাংলাদেশে আজ ধর্মের নামে এত নির্যাতন, হানাহানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, রক্তপাত হতো না। বাংলাদেশের এবং পাকিস্তানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যাবতীয় গণহত্যা-সন্ত্রাস, নির্যাতন ও ধ্বংসের জন্য দায়ী জামায়াতে ইসলামী, যা তারা করেছে ইসলামের দোহাই দিয়ে।

বাংলাদেশ যদি একটি আধুনিক ও সভ্য রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়, যদি আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ধারা নিশ্চিত করতে চায়, যদি যুদ্ধ-জেহাদ বিধ্বস্ত বিশ্বে শান্তির আলোকবর্তিকা জ্বালাতে চায় তাহলে ’৭২-এর সংবিধানের পুনঃপ্রবর্তন ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই।

লেখক: শাহরিয়ার কবির, সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। শিশুসাহিত্যিক-সাংবাদিক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ