1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসের ভাবনা

লাভা মাহমুদা : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২১

পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, বিকশিত হচ্ছে সভ্যতা, প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে সামাজিক কাঠামোয়। পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে মানুষের জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে সবখানে। কিন্তু নারীর মর্যাদার ক্ষেত্রে তার গুণগত কোনো প্রভাব পড়েনি। উন্নতি ঘটেনি মানসিক এবং সামাজিক অবস্থার, পরিবর্তন ঘটেনি অবস্থানেরও।

নারীর প্রতি অবমাননা, অসম্মান, নির্যাতন সেকালেও ছিল, একালেও আছে। এ যেন অলিখিত এক অধ্যাদেশ। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান থাকলেও নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা কোনো অংশেই কমেনি, বরং বেড়েছে। এখনও পৃথিবীতে প্রতি তিনজন নারীর একজন জীবনে কোনো না কোনো সময়ে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়; তিনজনের দুজন স্বামী বা বন্ধু কিংবা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়।

সারা পৃথিবীতে মাত্র ৮৯টি দেশ নারী নির্যাতনের তথ্য জাতীয়ভাবে সংগ্রহ করে থাকে। ১১৯টি দেশে নারী নির্যাতনবিরোধী আইন আছে, ১২৫টি দেশে যৌন সহিংসতাবিরোধী আইন আছে এবং মাত্র ২৫টি দেশে বিবাহভুক্ত ধর্ষণবিরোধী আইন আছে।

এ তো গেল সারা পৃথিবীর হিসাব। এবার চোখ ফেরাই নিজের দেশে। আমাদের নারীদের ৮৭ শতাংশ পারিবারিক সহিংসতার (Domestic violence) শিকার হয়। তাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত মার খায় ৭৭ শতাংশ, যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। আবার এক-তৃতীয়াংশ স্বামী কর্তৃক ধর্ষণের শিকারও হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় পর্যায়ের জরিপ ‘Violence Against Women Survey’ তে উঠে এসেছে এসব ভয়ংকর তথ্য। বিবিএস এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রথাগত সব ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে গৃহেই সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে নারী। স্বামী এবং অন্যান্য আপনজনদের কাছেই অনেক বেশি সহিংসতার শিকার হয় এবং নির্যাতনের ঝুঁকির ভেতর থাকে।

স্বামীর অনুমতি না নিয়ে বাইরে যাওয়া, বাচ্চাদের প্রতি যত্নশীল না হওয়া, স্বামীর সঙ্গে তর্ক করা, যৌন সম্পর্ক করতে অস্বীকৃতি জানানো, খাবার পুড়িয়ে ফেলার মতো অতি তুচ্ছ যেকোনো অন্তত একটি কারণে পুরুষের কাছে মার খায় নারী।
বিবিএসের জরিপে আরও উঠে এসেছে, ৮০ শতাংশ নারী জীবনে কোনো না কোনো সময়ে সহিংসতার শিকার হয়েছে, কখনও গোপনে, কখনও প্রকাশ্যে। জরিপে অন্তত ৭ শতাংশ নারী জানিয়েছে, নির্যাতনের কারণে তারা আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছে।

জীবনের বাঁকে বাঁকে বহুমাত্রিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত নারী, নির্মম বাস্তবতার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে হতে স্বকীয়তাই ভুলতে বসে। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি নারীর আর মানুষ হওয়া হয় না।

জন্মেই নারীর ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায় নিশ্চিতভাবেই। এখনও ভূমিষ্ট হওয়ার পর সন্তানটি কন্যা হলে পরিবারের সদস্যদের মুখ কালো হয়ে যায়, মন অন্ধকার হয়ে আসে। যেন কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার দায় শুধুই নারীটির।

আবার এই যে সংরক্ষিত অধিকার নিয়ে কন্যা সন্তানটি পৃথিবীর মুখ দেখল, মৃত্যু অবধি তার আর পরিবর্তন ঘটল না। পিতার সম্পত্তিতে সে ভাইয়ের সমান হলো না, স্বামীর সংসারেও সে অপাঙক্তেয়ই থেকে গেল।

সাফল্যের চূড়ায় বসে থাকা অল্প কয়েকজন নারী গোটা সমাজের প্রতিভূ নয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানসিক অবস্থানের সূচকই নারীর বাস্তবতা। আর গোটা কয় নারীর সামনে এগিয়ে যাওয়ার পেছনের কাহিনিটাও কম কষ্টসাধ্য নয়।

সেখানেও রয়েছে সহিংসতার ভিন্ন রকমের মাত্রা। নারীদের শিক্ষিত এবং সচেতন হওয়ার আনুপাতিক হার বাড়ার কারণে পরিবর্তিত হচ্ছে নারীকে শৃঙ্খলিত করার ধরন ও প্রকৃতিও।
নারী মাত্রই জানে প্রতিনিয়ত কতটা অবহেলা, অসম্মান আর আত্মগ্লানির ভেতর দিয়ে যেতে হয় ।

কত নারী বুক সমান হতাশা, দীর্ঘশ্বাস, অবহেলা, আক্ষেপ নিয়ে নির্ঘুম রাত পার করে, সে হিসাবটা শুধু নারীরাই জানে। যে দেশ, সমাজ, পরিবার আজও মেয়েদের মানুষ ভাবতেই শেখেনি, ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্যায়ন করতে জানে না, সেখানে মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাববার সময় কই! এত মানুষের ভিড়ে একাকিত্ব আর তীব্র দহনে নারীদের দীর্ঘশ্বাস শুধু চার দেয়ালের ভেতরেই ঘুরপাক খায়।

আমরা যে পঙ্কিল সমাজে বাস করি, তাতে যূথবদ্ধভাবে নারীকে অবদমন করা হয় ব্যক্তিগত-দলগত, গোষ্ঠীগত, সমাজগতভাবে। তাই নারীদের অন্ধকার থেকে আলোতে বেরিয়ে আসাও সহজ হয় না।

বিংশ শতকের এ সময়েও নারীর অধিকার আর মর্যাদা অন্য কোথাও শেকলে বাঁধা। সেই বাঁধনের দৃঢ়তা বা শিথিলতার ওপর নির্ভর করে তার মান মর্যাদা আকাঙ্ক্ষা সম্ভ্রম প্রায় সবকিছুই। কন্যা জায়া জননীর প্রতিচ্ছায়া দিয়ে যতই মহিমান্বিত করা হোক না কেন, পশ্চাৎপদ প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন এ সমাজে নারীর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাকে পদে পদে শৃঙ্খল পরানো হয়, পেরোতে হয় নানামুখী অনাকাঙ্ক্ষিত বাধা। পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ তাকে অর্থনৈতিকভাবে অকর্মণ্যতার দিকে ঠেলে দেয় প্রতিনিয়ত।

সামষ্টিক বিচারে গ্রামীণ ও শহুরে অর্থনীতিতে নারীর স্পষ্ট অবদান থাকলেও স্বীকৃতি নেই । অথচ সভ্যতার ক্রম বিকাশের ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই রোবটিক্স যুগ পর্যন্ত সমাজের বিবর্তন-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় নারীর সর্বজনীন উপস্থিতিই প্রমাণ করে তার বৈচিত্র্যময় বহুমুখিতা।

তাই নারীর আত্মমর্যাদা এবং সম্মান বাড়াতে নিজেদেরই আওয়াজ তুলতে হবে। নিজেকে শিক্ষায়, স্বাতন্ত্র্যে নিজের মতো করে পরিপূর্ণ মানুষ হতে হবে। বাড়াতে হবে দক্ষতা, নিশ্চিত করতে হবে অর্থনৈতিক অবস্থান। নিজেকে নিজের যোগ্য করে তুলতে হবে। সেটা সম্ভব হলেই কেবল নারী আর নারী থাকবে না, মানুষ হবে। উপভোগ করতে পারবে নিজের জীবন, স্বাধীনতা।

সবকিছুর আগে সংস্কৃতিগতভাবে নারীকে সমৃদ্ধ হতে হবে। কারণ সংস্কৃতি যেকোনো মানুষকে পরিশীলিত করে, ঋদ্ধ করে। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। আমাদের সংস্কৃতিতে নারী-পুরুষের ভয়ংকর প্রভেদের মূল কারণ সমাজে বিদ্যমান অপসংস্কৃতি, অশিক্ষা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় অনুভূতি।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা পুরুষকে দিয়েছে সর্বময় ক্ষমতা অন্যদিকে নারীকে করে রেখেছে গৃহমুখী। কিন্তু বিশ্বের উন্নয়ন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই সংস্কৃতির পরিবর্তন খুবই জরুরি। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর ইতিবাচক ভূমিকা ও প্রগতিশীল ভাবমূর্তির মাধ্যমে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, সচেতনতা-সুযোগ, নিরাপত্তা-শিক্ষা এবং সর্বোপরি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। তবেই নারী বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
তীব্র ঘাত প্রতিঘাত উপেক্ষা করে অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের মাধ্যমে একদিন নারী তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেই। তখনই সভ্যতার আলো জ্বলবে। নতুন সূর্য উঠবে।

সে আলোয় নারী পুরুষ নয়, মানুষ হিসেবেই আলোকিত হবে। সেদিন নারীরা শৃঙ্খলমুক্ত বাসযোগ্য একটা সমাজ পাবে। পূরণ হবে নিজের মতো করে বাঁচবার সাধ, অসীম আকাশে মেঘ হয়ে উড়বার সাধ, নিজেকে নিজের মতো করে পাওয়ার সাধ।
এর আগে বুঝতে হবে- পুরুষশাসিত সমাজ কিছু সস্তা অজুহাতে শৃঙ্খল পরিয়েছে নারীকে, নিজের স্বার্থে। সে অধিকার বঞ্চিত, উপেক্ষিত, অবহেলিত।

আজ ২৫ নভেম্বর। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর লাতিন আমেরিকার ডমিনিকান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী শাসক রাফায়েল ক্রজিলোর বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন চলাকালে শাসকচক্র প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা ও মিনার্ভা মিরাকেল নামের ৩ বোনকে হত্যা করে। এই হত্যার প্রতিবাদে ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকার এক নারী সম্মেলনে ২৫ নভেম্বরকে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে দিবসটি স্বীকৃতি পায়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২৫ নভেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়।

এর দুই বছর আগে ১৯৯৭ সাল থেকেই অবশ্য আমাদের দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। তবে দিবস এলে সভা-সমাবেশ, সেমিনার, ওয়েবিনারে চমৎকৃত হওয়ার মতো অনেক আলোচনা থাকলেও নারীর ভাগ্যের সুষম সুরাহা হয় না।
সংস্কারের পলেস্তারা খসাতে হবে নারীকেই। শিরদাঁড়া সোজা করে তাকাতে হবে সামনের পানে। তাহলেই হয়তো নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস তার প্রয়োজনীয়তা হারাবে।

লেখক: লাভা মাহমুদা, শিক্ষক-প্রাবন্ধিক।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ