1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

খেলাপ্রীতি নাকি পাকিস্তানপ্রীতি

বিভুরঞ্জন সরকার : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২১

খেলার সঙ্গে রাজনীতিকে মেশাতে চান না অনেকেই। এই অনেকের সংখ্যা আসলে কত তা বলা কঠিন। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ ক্রীড়ামোদী এবং এই ক্রীড়ামোদীদের কত শতাংশ মানুষ খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাতে চান না, তার কোনো পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। তবে এটা অনুমান করা যায় যে, দেশে ক্রীড়ামোদীর সংখ্যার চেয়ে পাকিস্তানভক্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না!

সম্প্রতি মিরপুর স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-পাকিস্তান টি টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়ে পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে উল্লাস করেছে, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়েছে এবং একজন তো পাকিস্তান ভাঙার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথাও বলেছেন।

এরা বয়সে তরুণ। এদের মধ্যে এমন পাকিস্তানপ্রেম কীভাবে উথলে উঠল, সে প্রশ্ন উঠছে। এটাও বলা হচ্ছে যে, গত ১২ বছর ধরে টানা ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকাবাহী দল। তাহলে তারা ক্ষমতায় থাকতে দেশে তরুণদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি মহব্বত বাড়ছে কেন এবং কী কারণে?

বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রযোজন। কেউ কেউ বলছেন যে, খেলার মাঠে রাজনীতি ঢোকানো উচিত নয়। কে কোন দলকে সমর্থন করবে, কোন খেলোয়াড়ের ফ্যান কে হবে– এটা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। এটা যার যার ব্যক্তিগত রুচি ও পছন্দের ব্যাপার।

বাংলাদেশের একজন তরুণ বা যেকোনো বয়সের মানুষ যেকোনো দেশের ক্রিকেট বা ফুটবল টিমের সমর্থক হতে পারেন। কেউ যদি ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড-ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা-শ্রীলঙ্কা বা জিম্বাবুয়ের সমর্থক হতে পারেন, তাহলে আরেকজন কেন পাকিস্তানের সমর্থক হতে পারবেন না?

এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো- অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশে গণহত্যা চালায়নি। পাকিস্তান চালিয়েছে। পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। দুই লাখের বেশি বাঙালি নারী পাকিস্তানি সেনাসদস্য এবং তাদের দেশীয় দোসরদের দ্বারা চরম পাশবিকতার শিকার হয়েছেন। পাকিস্তানিরা তখন ‘মুসলমান ভাই ভাই’ নীতি অনুসরণ করেনি।

ধর্মীয় পরিচয় বিবেচনা না করে সব বাঙালিকে শত্রু ভেবেছে এবং শত্রুনিধনে চরম নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়েছে। পাকিস্তান যদি একাত্তরে জয়লাভ করত তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। পাকিস্তানকে পরাজিত করেই বাঙালিরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কাজেই অন্য দেশের সমর্থক হওয়া আর পাকিস্তানের সমর্থক হওয়া এক কথা নয়। আমাদের হারতে দেখলে (শুধু খেলার মাঠে নয়) যারা খুশি হয়, তাদের জন্য যারা অন্তরে দরদ পোষে তাদের দেশাত্মবোধ নিয়ে প্রশ্ন জাগাটা অযৌক্তিক নয়।

কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, যারা মিরপুরে পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে মাঠে উল্লাসে মেতেছে, তারা আসলে পাকিস্তানি, আটকেপড়া বিহারি, যাদের আমাদের দেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। এটা যে ঠিক নয়, বাংলাদেশের বেশ কিছু তরুণ যে পাকিস্তানি দলের জার্সি গায়ে পরে এবং পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে মাঠে গিয়েছে, তার প্রমাণ আছে।

শেষদিন এমন এক তরুণের গা থেকে পাকিস্তানি জার্সি জোর করে খোলার দৃশ্য সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে এবং দৈনিক পত্রিকায়ও বিষয়টি খবর হয়েছে। যদি খেলাটি বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে না হয়ে অন্য দুই দেশের মধ্যে হতো তাহলে ওই দুই দেশের সমর্থকেরা ওই দেশের পতাকা হাতে নিয়ে গেলেও না হয় মেনে নেয়া যেত। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে খেলার সময় যদি কোনো বাংলাদেশি বাঙালি অন্য দেশের পতাকা বহন করে তাহলে বিষয়টি শুধু খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না।

যদি বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে খেলা হলে বাংলাদেশের কেউ ভারতের পতাকা নিয়ে মাঠে গেলেও কি তার নিন্দা-সমালোচনা করা হবে? নাকি পাকিস্তানি পতাকাতেই সব রাগ-গোস্বা-ক্ষোভ? যারা এমন কূটতর্ক করতে চান, তাদের জন্যও বলার কথা একটাই– বাংলাদেশের নাগরিকদের আনুগত্য শুধু বাংলাদেশের প্রতিই থাকবে। বিষয়টি দেশপ্রেমের সঙ্গে জড়িত, ভারতপ্রীতি বা পাকিস্তানবিদ্বেষের সঙ্গে যুক্ত নয়।

যারা বলে খেলার মাঠের বিষয় নিয়ে রাজনীতির ইস্যু বানানো ঠিক নয়। তারা জানে কি, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার খবর শুনে ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, গ্যালারিতে বাঙালি দর্শকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল।

রাজনীতি সবাই করেন না। কিন্তু সবার জীবনই রাজনৈতিক ঘটনার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। খেলাধুলাও যে রাজনীতি, রাজনৈতিক পরিবেশের বাইরে নয়, একাধিক ঘটনা দিয়ে তা প্রমাণ করা যায়।

কানাডাপ্রবাসী সাংবাদিক শওগত আলী সাগর তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন: “ঢাকার খেলার মাঠে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে উল্লাস করছে বাংলাদেশিরাই”- এই দৃশ্যটি অসহনীয়। কিন্তু যারা পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে মাঠে গেছে- তাদের আমি শুরুতেই গালি দেব না।

তার আগে তাদের মানসপটটা বোঝার চেষ্টা করব। বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যকার খেলায় বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানকে সমর্থন এবং সেদেশের পতাকা নিয়ে উল্লাস করার পেছনে তাদের কী ভাবনা কাজ করেছে- সেটা বোঝার চেষ্টা করা দরকার।

ইতোমধ্যে কোনো মিডিয়া তাদের এই প্রশ্নটা করেছে কি না জানি না। কিন্তু করাটা দরকার ছিল। তারা কেন এটা করছে- কেবল সেটা জানার জন্যই নয়, আমাদের এতে কোনো দায় আছে কি না, সেটা বোঝার জন্যও আমি এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পক্ষে। খেলার মাঠে পাকিস্তানকে সমর্থন করা বা পাকিস্তানের পক্ষে উল্লাস করা নতুন কোনো ঘটনা নয়। অনেক দিন ধরেই এগুলো চলে আসছে। এখন সেটা সংখ্যায় বেড়েছে।

‘খেলার সঙ্গে রাজনীতি মিশাবেন না’- এমন আপ্তবাক্য আর ‘এরা সব পাকিস্তানের জারজ সন্তান’- এমন গালি দিয়েই আমরা আমাদের দায়িত্ব শেষ করেছি। এর বাইরে আর কিছু ভাববার দরকার আছে বলে কখনও মনে করিনি।

খেলার সঙ্গে কেন রাজনীতি জড়িয়ে যায়, কেবল রাজনীতিই নয়, সংস্কৃতি, দেশপ্রেম জড়িয়ে যায়- সেগুলো বোঝার সক্ষমতা না থাকলে, অন্যকে বোঝানোর সক্ষমতা না থাকলে, আমরা অন্যকে কী দিয়ে প্রভাবিত করব! ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করেছি, কিংবা পাকিস্তানিদের নৃশংসতা’ অন্যদের কেন স্পর্শ করা উচিত- এই বোধটা এই মানুষগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব ছিল কি না- সেটাও ভাববার চেষ্টার মধ্যে রাখা জরুরি’।

এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। যারা শাসনক্ষমতায় আছেন, তাদের এগুলো নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে, নানা ধরনের দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো গড়ে উঠছে, মানুষের গড় আয় ও আয়ু বাড়ছে। আমরা তো এগিয়ে যাওয়ার জন্যই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, রক্তনদী সাঁতরে আমরা বিজয়ী হয়েছি। এখন স্বাধীনতার ৫০ বছরে অনেক দূর আমরা এগিয়েছি। বড় বড় অর্জন অবশ্যই আমাদের আছে।

আবার এই সময়ে কিছু ক্ষেত্রে আমাদের পিছু হটার ঘটনাও আছে। আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে দেখে আমরা মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে চাইনি। অথচ আজ আমরা ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠতে পারছি না।

পাকিস্তানিরা মুসলমান, আমরাও মুসলমান তাই তাদের জয়ে আমাদের কেউ কেউ উল্লসিত হয়– একাত্তরের রক্তস্মৃতি ভুলে গিয়ে। এটাকে যারা ছোট বিষয় মনে করেন তারা আসলে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলিয়ে দিতে চান। মানুষকে তার শিকড় থেকে উপড়ে ফেলতে পারলে পরাজিত করা সহজ হয়। আমরা কি সে পথেই হাঁটছি না?

আমরা যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি তখন পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে, পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের চার-ছক্কায় উল্লাস করে ফের একাত্তরের মতোই রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ করেছে যারা তারা আসলে একাত্তরের রাজাকারসন্তান! নাকি অন্য পরিবার থেকে আসা? শুধু রাজাকার বা রাজাকারসন্তান বলে গাল দিলেই কি আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? কেউ কেউ বলছেন, বিষয়টি নিছকই পতাকাবিধি লঙ্ঘন নয়।

এটি পঞ্চাশ বছরের গভীর ষড়যন্ত্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতার বহিঃপ্রকাশ। এদের দ্রুত চিহ্নিত করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে বিচারের দাবি জানিয়েছেন কেউ কেউ। এক্ষেত্রে আইন, স্বরাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে যৌথ উদ্যোগ নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বিষয়টি দেখে আইনিব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

মন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা আবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব। এটা দুর্ভাগ্যজনক, যদি কেউ করে থাকে। একটা টিমকে যে কেউ সাপোর্ট করতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে খেলার দিন অন্য টিমকে সাপোর্ট করা, একটা দেশপ্রেমিক নাগরিকের জন্য শোভনীয় নয়।

নিঃসন্দেহে কারো কাছেই এটি শোভনীয় মনে হবে না। রক্তে কেনা স্বাধীন দেশের নাগরিক নিজদেশের খেলায় একাত্তরের পরাজিত শক্তির পতাকা বহন করে উল্লাস করবে, এটি কখনও ভাবা যায়! অকল্পনীয়। এটি বিবেকের প্রশ্ন। আমরা এখন বিষয়টি নিয়ে ভাবব। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে করণীয় ঠিক করব এবং ব্যবস্থা নেব।’

করণীয় ঠিক করে ব্যবস্থা নিতে বেশি দেরি করলে বিপদও বাড়বে- এটা মনে রাখতে হবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। শত্রুর সঙ্গে গলাগলি করা আর মিত্র চিনতে ভুল করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

লেখক: বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ