বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার হচ্ছে। অথচ, এটি কোনও রকেট সাইন্স নয়। এ বিষয়টি বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হবারও প্রয়োজন নেই। একটু তথ্যানুসন্ধান করলে এবং মাথা খাটালেই বিষয়টি বোঝা যায়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে যাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে তাদের জন্য সংক্ষিপ্ত আকারে হিসাবটি তুলে ধরলাম।
(১) আগস্ট, ২০২১-এ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
কিন্তু, বিশ্ব বাজারে জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, করোনা পরবর্তী pent-up demand, পরিবহন খরচ (shipping & freight cost) বৃদ্ধি, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মুদ্রানীতি -এসব বিভিন্ন কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ে।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার সম্মেলনে বলা হয় ২০২২ ও ২০২৩ সালে বিশ্ব এক ভয়াবহ আর্থিক মন্দার কিনারায় রয়েছে। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। একই সম্মেলনে বলা হয়, ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মান কমেছে ৯০টি উন্নয়নশীল দেশে। এদের মধ্যে ১০ শতাংশের বেশি দরপতন হয়েছে অন্তত ৩০টি দেশে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে আশঙ্কাজনক হারে। যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রানীতির কারণে ঋণের বোঝা বাড়ার ঝুঁকিতে অন্তত ৪৬টি দেশ।
বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রের বাইরের কোনও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ডলার খরচে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি। এছাড়া লোহাসহ বিভিন্ন ধরনের ধাতু, সার, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পপণ্যের রেকর্ড আমদানিও বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মোট আমদানি ব্যয় ছিল ৬৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) তা দাঁড়ায় ৮৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারে। এ খাতের পণ্য আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ। ১৬ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলারের ক্যাপিটাল গুডস বা মূলধনি পণ্য আমদানি হয়েছে। শুধু তৈরি পোশাক, বিভিন্ন ধরনের ইন্টারমিডিয়েট গুডস ও ক্যাপিটাল গুডস মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬৩ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা দেশের মোট আমদানির ৭১ শতাংশেরও বেশি।
(২) সেপ্টেম্বর, ২০২২-এ এসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫.৮ বিলিয়ন ডলার।
(৩) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে এবং ঋণ দিয়েছে।
(ক) এরমধ্যে রিজার্ভ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার দিয়ে গঠন করা হয়েছে রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ)।
(খ) বিআইডিএফ থেকে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে ঋণ দেওয়া হয়েছে ৫,৪১৭ কোটি টাকা।
(গ) শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দেওয়া হয়েছে (২০ কোটি ডলার) ০.২ বিলিয়ন ডলার।
(৪) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৫.৮ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে (ক), (খ) এবং (গ) এই তিনটি খাতে যে বিনিয়োগ করা হয়েছে বা ঋণ দেওয়া হয়েছে তা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেরই অংশ। এই তিনটি খাতে যে ডলার দেওয়া হয়েছে তা কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়নি, স্বচ্ছতার সঙ্গে হিসাবে দেখানোও আছে।
(৫) আইএমএফ একটি রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান। তারা (ক), (খ) এবং (গ) এই তিনটি খাতে রিজার্ভ থেকে যে বিনিয়োগ করা হয়েছে বা ঋণ দেওয়া হয়েছে তা বাদ দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব করতে চায়।
(৬) কাজেই, আইএমএফের প্রক্রিয়াটি যদি অনুসরণ করা হয়, তাহলে রিজার্ভ ৩৫.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২৭.৮ বিলিয়ন ডলার দেখাতে হবে। তার মানে এই নয় যে বাকি ডলার উধাও হয়ে গেছে। অথচ, কিছু মানুষ একটি অশুভ উদ্দেশ্যে এই বিষয়টি নিয়ে বাজারে অপপ্রচার ছড়াচ্ছে। বাকি ৮ বিলিয়ন ডলার (ক), (খ) এবং (গ) এই তিনটি খাতের হিসাবে ধরা আছে এবং এটি রিজার্ভেই অংশ, সময় মতো তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেই যুক্ত হবে।
লেখক : অধ্যাপক মোহাম্মদ এ. আরাফাত – চেয়ারম্যান, সুচিন্তা ফাউন্ডেশন