নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘শহীদ হামজা ব্রিগেড (এসএইচবি)’-কে আবার সংগঠিত করার চেষ্টা চলছে। সংগঠনটির শীর্ষ নেতা মোজাহের হোসেন মিয়া ওরফে মোজাহের মেম্বার চট্টগ্রাম কারাগারে বসে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। শুধু তাই নয়, ফোন করে চাঁদাবাজি করছেন। পাশাপাশি আছে অস্ত্র ব্যবসাও। মোজাহের মেম্বারের গত ১ মে রাত ১২টা ৩ মিনিট থেকে ২২ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টা ৪২ মিনিট পর্যন্ত ছয় মাসের ৫২৩ পাতার কল লিস্ট এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। ওই কল লিস্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ সময়ে সাড়ে পাঁচ হাজারবার কল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে রবি নেটওয়ার্ক। যার ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে, হোল্ডিং নম্বর ৪৫, জেল রোড, থানা কোতোয়ালি, জেলা চট্টগ্রাম। এই জঙ্গি নেতা যাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন, তাদের কয়েকজন তা স্বীকারও করেছেন। বলেছেন, কারাগার থেকে মাঝেমধ্যে ফোন করে খোঁজখবর নেন মোজাহের মেম্বার। এদিকে কারাগারে জঙ্গি নেতার হাতে স্মার্টফোন থাকা বা কারাগারে বসে স্মার্টফোন ব্যবহারের এই ঘটনা উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
একাধিক সূত্র জানায়, হামজা ব্রিগেডের শীর্ষ নেতা মোজাহের মেম্বার পাঁচ বছরের বেশি সময় কারাগারে বসে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আসছেন। কেবল তার হাতে নয়, আরও অনেক অপরাধী কারাগারে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ আছে। কারা অভ্যন্তরে যেসব ফোন নম্বর থেকে বাইরে কথা বলা হয়, এর বেশির ভাগ মোবাইল ফোন দিনে বন্ধ থাকে। রাত গভীর হলে নিরাপত্তাব্যবস্থা কিছুটা শিথিল হয়ে আসে। তখন মোবাইল ফোনগুলো সক্রিয় হয়। তাছাড়া কারা অভ্যন্তরে সক্রিয় সংযোগগুলোর বেশির ভাগই একমুখী। অর্থাৎ ইনকামিং বন্ধ। ভেতর থেকে শুধু কল বাইরে যায়। অথচ নিয়মানুসারে, কারাগারে জঙ্গিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কারও মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ নেই।
জঙ্গি নেতা মোজাহের মেম্বার শুধু একটি নয়, দুটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন। একটি নম্বর হচ্ছে ০১৮৩৭০০২১৪০ এবং অপরটি ০১৬৩৪৬৩৯৫৪৫। মোজাহেরের এই মোবাইল নম্বরের (০১৮৩৭০০২১৪০) সিমটি নিবন্ধন করা রয়েছে ইয়াছমিন আক্তার নামে। জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ১০২৪২৩৭৮২৬, স্বামীর নাম মো. হাসান। স্থায়ী ঠিকানা নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার হরণী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। পিতার নাম মো. হাফিজ। তার মোবাইলের আইএমইআই নম্বর হচ্ছে ৩৫৫৪৩০৯৩০১৭৮৭৩০ ও ৩৫৯৪১০১০১৩২০৭৯০।
এই নম্বরের পুরো কল লিস্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যাদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই দাগি সন্ত্রাসী ও অস্ত্র ব্যবসায়ী। সবচেয়ে বেশি কথা বলা হয় ০১৮১৯০৪৭৮৮৫ নম্বরে। অনুসন্ধানে জানা যায়, নম্বরটি সাতকানিয়া উপজেলার ওয়াদিয়াপাড়ার আবদুল মাবুদের। মাবুদের বিরুদ্ধে ১০টির বেশি মামলা রয়েছে। একাধিক হত্যা মামলাও রয়েছে। তার পেশা মূলত অস্ত্র ব্যবসা। মোজাহেরের খালাতো বোন জিন্নাত (০১৮৬৯৯৭০৯২২) বলেন, ‘তিনি (মোজাহের) কারাগার থেকে বেশির ভাগ সময় আমাকে কল দিয়ে থাকেন। তিনি আমার কাছ থেকে মা-বাবার খোঁজখবর নেন।’
মোজাহের দুটি নম্বর থেকে সাড়ে পাঁচ হাজারবার কল করেন। এর মধ্যে যেসব নম্বরে সবচেয়ে বেশি কথা বলেছেন, সেগুলো হলো ০১৮৮১-২৩৪২৪১, ০১৮৬৯-৯৭০৯২২, ০১৯৭৮-৬৪৩২৯৬, ০১৮১৮-০৫৫২৪১, ০১৭৭৭-৫১৫৫৩৪, ০১৮১৮-০৫৫২৪১, ০১৮১৬-৮০৯০৯৭, ০১৯৭৬-৬৪৩২৯৬ ও ০১৮৪৩-৭২০৭৮৮।
কারাগার থেকে ফোন করার কথা স্বীকার করে চরতি ইউনিয়নের ৮ নম্বর ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মোজাহের একসময় জনপ্রতিনিধি ছিলেন। আমার কাছে কয়েকবার ফোন করে টাকা দাবি করেছেন। আমি এখন আর ফোন রিসিভ করি না।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল বলেন, ‘জঙ্গি বা অপরাধীরা জেলখানায় বসে যদি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, সেটা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্যও হুমকি। জঙ্গিরা অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের মাধ্যমে যে কোনো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে। তারা শুধু দেশের জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে তা নয়। বিদেশি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে।’
কে এই মোজাহের মেম্বার?
মোহাজের হোসেন মিয়া প্রকাশ মোজাহের মেম্বার একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও হামজা ব্রিগেডের শীর্ষ নেতা। তার বাবার নাম দেলোয়ার হোসেন। বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা এলাকায়। এক দশক আগে ইউপি মেম্বারও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১১ সালে কাঞ্চনা ইউনিয়ন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রমজান আলীর বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে হামজা ব্রিগেডের নেতৃত্ব নেন। এরপর শুরু করেন অস্ত্র ব্যবসা। ২০১৫ সালে অস্ত্র বিক্রির সময় র্যাবের হাতে ধরা পড়েন। এ ঘটনায় নগরীর কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়। মামলাটি এখন চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে।
চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের পেশকার বারাকাত চৌধুরী বলেন, ‘কোতোয়ালি থানার অস্ত্র উদ্ধারের মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। মামলা সাক্ষ্য পর্যায়ে রয়েছে। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়নি। মামলাটির পরবর্তী তারিখ ২০২৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি।’
২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল নগরীর কোতোয়ালি থানার মিডটাউন আবাসিক হোটেলে একে-৪৭ রাইফেল কেনাবেচার সময় বিক্রেতা মোজাহের হোসেন মিঞা প্রকাশ মোজাহের মেম্বার এবং বাঁশখালীতে জঙ্গি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাব্বির আহমেদ ওরফে মুহিবকে গ্রেফতার করে র্যাব। মোজাহেরের বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলার উত্তর কাঞ্চনা এলাকায়। সাব্বির হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার গুলগাঁও গ্রামের আবুল কালাম ফটিকের ছেলে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওইদিন রাতে আকবর শাহ থানার একে খান মোড়ে শ্যামলী বাস কাউন্টার থেকে মো. কামাল উদ্দিন ওরফে মোস্তফা এবং আশরাফ আলীম ওরফে আদনানকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া পাঁচলাইশ থানার কসমোপলিটন আবাসিক এলাকার গ্রিন বাংলা জাহানারা অ্যাপার্টমেন্টের সপ্তম তলায় একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ছিল ৫টি একে ২২ রাইফেল, ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি একনলা বন্দুক, ১টি এলজি, একে ২২-এর ১০টি ম্যাগাজিন, ১টি পিস্তলের ম্যাগাজিন, ২ হাজার ১৫৫ রাউন্ট পয়েন্ট টুটু বোরের পিস্তলের গুলি, ৫০১ রাউন্ড শটগানের গুলি। ওই সময় মোট ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের সবাই ‘শহীদ হামজা ব্রিগেডের’ সদস্য এবং অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে জানায় র্যাব। জঙ্গি নেতা মোজাহের চট্টগ্রাম কারাগারের আমদানি ওয়ার্ড-৪ রয়েছে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, ‘কারাগারে জঙ্গিদের মোবাইল ব্যবহার কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারাগারে আমাদের ফুলটাইম নজরদারি রয়েছে। শুধু জঙ্গি না কারাগারে কারও মোবাইল ফোন ব্যবহার করা সম্ভব নয়।’
চট্টগ্রাম কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘কারাগারে জঙ্গিরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করার বিষয়টি সত্য নয়। কারাগারে নিয়মিত তল্লাশি হয়। এছাড়াও কারাগারে জঙ্গিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সরকারি মোবাইল ফোনেও কারও সঙ্গে কথা বলার নিয়ম নেই।’