1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ঐতিহাসিক মূল্যায়নে বিশ্বসভায় চট্টগ্রাম বন্দরের স্থান

অধ্যাপক ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০২২

আধুনিক বন্দরের ইতিহাস ২০০ বছরের পুরোনো। জলপথে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে এর সম্পর্ক। ইংরেজদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ভিত্তিই জলপথ, যেখানে মোগলদের ভিত্তি ছিল স্থলপথ। মোগলদের বাহন ছিল ঘোড়া, ইংরেজদের জাহাজ। উনিশ শতকের প্রথমদিকে উপসাগরীয় অঞ্চল ও ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়; একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয় বন্দর। প্রথম যুগে গড়ে ওঠে কলম্বো বন্দর ১৮১৫ সালে, সিঙ্গাপুর বন্দর ১৮১৯ সালে এবং রেঙ্গুন বন্দর ১৮২৪ সালে। এগুলোর অবস্থান সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরের মধ্যে। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতায় যার পরিচয় ধরা পড়ে এভাবে-‘সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে/অনেক ঘুরেছি আমি।…আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন’।

ব্রিটিশের সাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ার প্রাক্কালেই বার্মায় প্রতিষ্ঠিত হয় রেঙ্গুন বন্দর। তার আগে হাজার বছরের স্বাধীন রাজ্য আরাকান ছিল বর্মী সেনাপতি বোধপায়ার শাসানাধীন (১৭৮৫-১৮২৫)। ব্রিটিশের হাত থেকে মুক্তির আগে সিঙ্গাপুর বন্দর ছিল মালয়েশিয়ার একটি ক্ষুদ্র বন্দর, তখন সিঙ্গাপুর ছিল বেকারত্ব ও দারিদ্র্যলাঞ্ছিত অখ্যাত পল্লি। বন্দরের কল্যাণেই ভারত ও শ্রীলংকায় নিয়োগ দেওয়া হয় চীনা চা চাষিদের। এটি হচ্ছে এমন যুগ, যখন নদীপথে বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষিত হতো। নৌযান ছিল কাঠের, মৌসুমি বায়ুর ওপর নির্ভরশীল। শুরু হয় কাঠের বাক্সে বন্দি চায়ের পেটির ওঠানামা বন্দরে বন্দরে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধজুড়ে প্রধান ব্যবসাপণ্য ছিল চা ও আফিম।

নদীযুগের পশ্চাৎপদতার অবসান ঘটে রেলওয়ে প্রবর্তনের পর। ইংল্যান্ডে ১৮২৫ সালে, আমেরিকায় ১৮৩৩ সালে, জার্মানিতে ১৮৩৫ সালে, ইতালিতে ১৮৩৯ সালে রেলওয়ে প্রবর্তিত হওয়ার পর তার ঔপনিবেশিক স্বার্থ আরও প্রবল হয়ে ওঠে। প্রথম আফিম যুদ্ধের বছরগুলোয় (১৮৩৯-১৮৪২) যুক্তরাজ্য জোরপূর্বক গড়ে তোলে হংকং বন্দর ১৮৪০ সালে, সাংহাই বন্দর ১৮৪২ সালে, নিংপো বন্দর ১৮৪১-১৮৪২ সালে, গুয়ানজু বন্দর (ক্যান্টন বন্দর নামে সমধিক পরিচিত) ১৮৪২ সালে। এসব বন্দর প্রথম আফিম যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের খেসারত হিসাবে গড়ে ওঠে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের খেসারত হিসাবে জার্মান সাম্রাজ্যের অধিকাংশ অংশ দখল করে নেয় মিত্র শক্তি। বন্দর প্রতিষ্ঠার আগে কলকাতা থেকে সিকিম হয়ে চোরাই পথে আফিম পাঠানো হতো চীনে। সিকিমের পথ ছিল কষ্টসাধ্য, ব্যয়বহুল ও বিপৎসংকুল। বন্দর প্রতিষ্ঠার পর আফিম রপ্তানি হয়ে ওঠে প্রমোদভ্রমণের মতো স্বচ্ছন্দ, নির্বিঘ্ন ও সহজ। ভারতে উৎপাদিত আফিম চীনে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ রৌপ্য পাচার করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় হংকং বন্দর। ১৮৩০ সালে বাংলার ৯০ হাজার একর জমিতে আফিম উৎপাদক পপির আবাদ হতো, ১৮৪০ সালে জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৭৬ হাজার একরে। ১৮৩০-এর দশকে চীনে আফিমসেবীর সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ, বন্দরের কল্যাণে ১৮৪০-এর দশকে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। সাংহাই ছিল জেলেপল্লি। আফিম যুদ্ধের পর সাংহাইয়ে ইউরোপীয় বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত হয়। রবার্ট ফরচুন ছদ্মবেশে চীনে প্রবেশ করে (১৮৪৮-১৮৪৯) সাংহাই থেকে চীনের চা এলাকায় তিন মাসের ভ্রমণের পর ফিরে আসেন আবার সাংহাইয়ে। সংগৃহীত গাছের চারা ও বীজ কাচের বোতলে করে চালান করতে সক্ষম হন হংকং এবং কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে। আগে ছিল অবৈধপথে আফিমের চোরাচালান, এবার এর সঙ্গে যুক্ত হলো অবৈধপথে বন্দরের মাধ্যমে চায়ের বীজের চোরাচালান। সব চোরাচালানেই প্রধান বাহক হয় তাদেরই প্রতিষ্ঠিত বন্দর। ইউরোপীয় বণিকরা চীন থেকে আমদানি করত চা আর বিপুল পরিমাণ আফিম চীনে রপ্তানি করত। কলম্বো, রেঙ্গুন ও সিঙ্গাপুর বন্দরে পণ্য পরিবহণের জন্য একমাত্র মাধ্যম ছিল জলপথ। আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে এগুলো ছিল পশ্চাৎপদ। হংকং, সাংহাই, নিংপো ও গুয়াংজু বন্দরেও মাল ওঠানামা করত নদীপথের মাধ্যমে। তবে পার্থক্য হলো-কলম্বো, রেঙ্গুন ও সিঙ্গাপুর বন্দর গড়ে ওঠে ইউরোপে রেলওয়ে প্রবর্তনের আগে, পক্ষান্তরে চীনের বন্দরগুলো গড়ে ওঠে দ্বিতীয় পর্যায়ে, ইউরোপ-আমেরিকায় রেলওয়েব্যবস্থা প্রবর্তনের পর।

সিপাহি বিপ্লবের পর ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা আসামের চা বাগানে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। যারা অর্থলগ্নি করেছিল গঙ্গা অববাহিকায় নীল চাষে, তারাও বেছে নেয় আসামকে। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ প্রকাশিত হওয়ার পর যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে নদীমাতৃক বাংলায়, তার তুলনায় জঙ্গলাকীর্ণ আসাম ছিল শান্ত। ১৮৬০ সালে ডিব্রুগড়ে কলকাতা থেকে জাহাজে নিয়মিত যাতায়াতব্যবস্থা চালু হলে এ প্রক্রিয়া বিস্তৃত হয়। ১৮৫৩ সালে দুই হাজার একর চা বাগান ছিল আসাম কোম্পানির, ১৮৬০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার একরে। সিপাহি বিপ্লবের পর শুধু চা শিল্প বিকশিত হয়েছে তাই নয়, দ্রুত রেলওয়ে নেটওয়ার্কও বিস্তৃত হয়। ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপানশন বোর্ড ও টি চেজ কমিটি চা কোম্পানিগুলোকে রেলস্টেশনে চায়ের ক্যান্টিন স্থাপনের পরামর্শ দেয়। এসব ক্যান্টিনে বিনামূল্যে চা পান ও বানানোর পদ্ধতি শেখানো হতো।

সিপাহি বিপ্লবের পর ট্রেন যোগাযোগ স্থাপন ও চা শিল্পের বিকাশের পরই তৃতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বন্দর ১৮৭০ সালে, বোম্বে বন্দর ১৮৭৩ সালে এবং মাদ্রাজ বন্দর ১৮৮১ সালে। সবশেষে চট্টগ্রাম বন্দর ১৮৮৭ সালে। হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত লাইন ১৮৫৪ সালে উদ্বোধনের মাধ্যমে বাংলায় চালু হয় প্রথম রেললাইন। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের কলকাতা-রানাঘাট শাখা উদ্বোধন হয় ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আর দর্শনা-জগতী শাখা ১৫ নভেম্বর। ভারতে বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয় রেললাইন প্রতিষ্ঠার পর। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে রেললাইন প্রবর্তিত হয় প্রথম ভারতেই। ইংরেজরা তাদের শিল্পবিপ্লবের এক শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার উপহার দেয় ভারতকেই প্রথম। সেসময় এসব বন্দরই ছিল এশিয়ার শ্রেষ্ঠ বন্দর। এসব বন্দরের পরেই ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরগুলোর স্থান। তার মধ্যে কলম্বো বন্দর রেললাইন স্থাপিত হয় ১৮৬৪ সালে। সিঙ্গাপুর বন্দর থেকে পণ্য খালাসের জন্য স্থাপিত হয় রেলওয়ে ১৮৭৭ সালে। একই বছর নির্মিত হয় রেঙ্গুন রেললাইন। তাতে ফল হলো এই-উনিশ শতকের শুরুতে আফিম রপ্তানির পরিমাণ ৪ হাজার বাক্স হলেও ১৮৮০ সালে এর গিয়ে পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ হাজার বাক্সে। ১৯০০ সালে বাংলার উচ্চফলনশীল ৫ লাখ একর জমি আফিম চাষের দখলে চলে যায়। একইভাবে পাল্লা দিয়ে ১৯০৬ সালে চীনে আফিমসেবীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৩৫ লাখে। বন্দরসংলগ্ন সমগ্র দক্ষিণ চীন আফিমের আড্ডায় ছেয়ে যায়। ১৮৮৮ সালে ব্রিটেনে ভারতের চা রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৬ মিলিয়ন পাউন্ড, যা চীন থেকে রপ্তানি করা ৮০ মিলিয়ন পাউন্ডকে ছাড়িয়ে যায়। ভারতে ট্রেন ও স্টিমার সার্ভিস চালুর পরই এর সঙ্গে যুক্ত হলো চিনি। ক্যারিবিয়ান আখ থেকে উৎপাদিত চিনির সঙ্গে সিলেটের চায়ের নির্যাস মিলে তৈরি হলো মাদকতাময় সুগন্ধি চা। উনিশ শতকজুড়ে চা, চিনি আর আফিম-এ তিন মিলে বন্দর সরগরম হতে থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বন্দরগুলোর ওপর ব্রিটিশ দখলদারি বজায় থাকে। স্বাধীনতা লাভের পর এসব দেশে নতুন যুগের সূচনা হয়। একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করে বন্দরগুলো শীর্ষে চলে আসে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে। যার মধ্যে অন্যতম উচ্চগতিসম্পন্ন ট্রেন সংযোজন। এ বছর শ্রেষ্ঠত্বের তালিকায় প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে সাংহাই, দ্বিতীয় সিঙ্গাপুর, তৃতীয় নিংপো, চতুর্থ শেনজেন এবং পঞ্চম গুয়ানজো। শ্রেষ্ঠত্বের তালিকায় যেসব বন্দর স্থান পেয়েছে, তাদের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যায়, সব বন্দরই ঔপনিবেশিক আমলে সৃষ্টি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে উন্মোচিত হলো শীর্ষ বন্দরে পরিণত হওয়ার মূল রহস্য। কত দ্রুত পণ্য বিস্তৃত হতে পারে বিভিন্ন গন্তব্যে, এর ওপর নির্ভর করছে একটি বন্দরের শ্রেষ্ঠত্ব। চীনের সেরা বন্দরগুলো পরস্পর বুলেট ট্রেন দিয়ে যুক্ত। বুলেট ট্রেনকে বলা যায় লক্ষ্যভেদ করার অব্যর্থ তির।

বর্তমান শতাব্দীতে বন্দরের তালিকায় এসেছে বৈপ্লবিক পালাবদল। বাংলাদেশ এগিয়ে আসছে পেছন থেকে সামনের দিকে। বিশ্বের শীর্ষ ১০০ বন্দরের তালিকায় চট্টগ্রামের স্থান এখন ৬৪তম। শুধু উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর কালের পরিক্রমায় শ্রেষ্ঠ বন্দরে রূপান্তরিত হতে পারে। তার মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উচ্চগতি সংযোজন। বুলেট ট্রেন দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরকে শুধু নারায়ণগঞ্জ বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করলেই হবে না, তাকে মোংলার সঙ্গেও যুক্ত করতে হবে। যাকে সম্প্রসারিত করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নর্থইস্ট ফ্রন্টিয়ারে এবং আরও উত্তরে চীনে। মধ্যযুগে চট্টগ্রাম বন্দর ছিল শ্রেষ্ঠ বন্দরের একটি। সব বৈশিষ্ট্যই রয়েছে তার শীর্ষ স্থান অধিকার করার। শুধু আবহমানকালের বিস্তার প্রসার ও গভীরতার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে উচ্চগতি, আধুনিক প্রযুক্তি এবং একটি স্বাধীন জাতির চিৎপ্রকর্ষ।

লেখক : অধ্যাপক ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি – সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ