1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

সরকারি দল এবং বিরোধী দলের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন

ড. প্রণব কুমার পান্ডে : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২২

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের ভুল স্বীকার করা কিংবা নিজেদের কর্ম সম্পর্কে আত্মোপলব্ধির ঘটনা খুব বেশি ঘটে না যদিও এই বিষয়টি রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নিজেদের কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করে না। যে রাজনৈতিক দলের নেতারা সময়ের সাথে সাথে এই কাজটি করতে সক্ষম হন তারা রাজনীতিতে ভালোভাবে টিকে থাকেন এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে।

এই সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলো নিজেদের প্রস্তুত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বিএনপি সরকারের পদত্যাগের দাবিসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করে চলেছে কয়েক মাস ধরে। বিরোধীদলের কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে সরকারি দল আওয়ামী লীগও বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করছে। বস্তুতপক্ষে, দেশের রাজনীতিতে নির্বাচনের ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে নির্বাচনের এক বছর আগে থেকেই।

অতিসম্প্রতি আওয়ামী লীগের দুজন শীর্ষস্থানীয় নেতার গণমাধ্যমে প্রদত্ত বক্তব্য আমাকে আকৃষ্ট করেছে। দু’জন নেতাই বক্তব্যের একপর্যায়ে স্বীকার করেছেন যে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের কোথাও কোথাও হয়তো ভুল হয়েছে। তবে তারা সেই ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সকল জনগণ, সুশীল সমাজ এবং রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকারি দল এবং বিরোধী দল যদি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উভয়ের কার্যক্রমের সমালোচনা করে তাহলে সেই দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। এই প্রেক্ষাপট থেকে বিচার করলে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ভুল স্বীকার করাকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে মানুষই ভুল করে। ফলে, নিজেদের ভুল স্বীকার করার মধ্যে কোনও অন্যায় বা পাপ নেই। কিন্তু নিজেদের ভুল স্বীকার করার মানসিকতা সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে নেই।

দল পরিচালনা কিংবা রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতাদের কোনও ভুল হবে না– এই বিষয়টি কোনও রাজনৈতিক দলের নেতারাই নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না। দল পরিচালনার চেয়েও রাষ্ট্র পরিচালনা করা অনেক জটিল কাজ। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে। এই দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকাকালে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। তবে ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি কোনও কোনও ক্ষেত্রে সরকার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি– এটিই বাস্তবতা। একটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে শতভাগ সফলতার সাথে রাষ্ট্রপরিচালনা করবে– এটি প্রত্যাশা করাও ঠিক নয়।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাষ্ট্র পরিচালনা আরও কঠিন কারণ এমন একটি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয় যেখানে ত্যাগী নেতা-কর্মীদের চেয়ে অনুপ্রবেশকারীদের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বিভিন্ন দল থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরা দলের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রাধান্য বিস্তার করে। এই শ্রেণির নেতাকর্মীরা দলের আদর্শের চেয়ে নিজেদের আদর্শকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে লিপ্ত থাকে। দিন শেষে এই সমস্ত অপকর্মের দায়-দায়িত্ব দল ও সরকারের ওপর এসে পড়ে কারণ দায়িত্ব অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের হাত ধরেই তারা দলে অনুপ্রবেশ করে এবং তাদের সহায়তায় বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সাথে যুক্ত হয়।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি দুর্বল দিক হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকালে দল এবং সরকারের এক হয়ে যাওয়া যা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় কখনই কাম্য নয়।

আমরা সবাই জানি যে নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক দল জনগণের সামনে তাদের নির্বাচনি ইশতেহার বা ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করে। সেই ইশতেহার বা ঘোষণা পত্র দেখেই জনগণ তাদের ওপরে আস্থা রাখে। যখন কোনও রাজনৈতিক দল নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখন সেই সরকারের মূল লক্ষ্য থাকে দল জনগণের সামনে যে নির্বাচনি ইশতেহার বা ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেছিল সেই অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল এবং সরকারকে আলাদাভাবে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে কাজ করতে হয়।

এটা যদি করা সম্ভব হয় তাহলে সরকার যেমন সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারবে, ঠিক তেমনিভাবে রাজনৈতিক দল সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী হবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দল ও সরকারের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নিশ্চিত করে কাজ করা সম্ভব হয় না কারণ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারাই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থাকেন। তারা এই যৌথ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে ব্যর্থ হন। আমরা যদি উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে সে সমস্ত দেশে সরকারি দল এবং সরকার দুটো আলাদা সত্তা। দলের নেতৃত্বে থাকেন একদল নেতা এবং সরকারের দায়িত্বে থাকেন অন্য আরেক দল নেতা। উভয়েই চেষ্টা করেন নিজেদের মধ্যে সমন্বয় রেখে দলের নির্বাচনি ইশতেহার বা ঘোষণাপত্রের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। এতে করে একদিকে যেমন দল সুসংগঠিত হয়, তেমনি ভাবে দেশের উন্নয়ন সাধিত হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটিই সকল দলের নিকট কাম্য।

দল এবং সরকারের মধ্যে যে সুস্পষ্ট বিভাজন সেটি বজায় রাখতে না পারার ফলে দল আস্তে আস্তে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে যা নির্বাচনের সময় দলকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ে।

গত প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। দলে অনুপ্রবেশকারী এবং এক শ্রেণির নেতাকর্মীদের আধিপত্যের কারণে ত্যাগীরা বঞ্চিত হয়েছে। তবে, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুখে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের কথা শোনা যাচ্ছে। যদি এই কথাগুলো বাস্তবায়িত হয় তাহলে তা দলের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখে আত্মোপলব্ধিমূলক যে বক্তব্যগুলো শোনা যাচ্ছে তা দলের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য সতিই ইতিবাচক। যদিও বিরোধীদলের পক্ষ থেকে তাদের শাসনামলে যে সমস্ত অপকর্ম করা হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে ভুল স্বীকার করতে দেখা যাচ্ছে না যা রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে কখনোই কাম্য হতে পারে না।

দেশের উন্নয়নের জন্য ক্ষমতার ধারাবাহিকতা অত্যন্ত প্রয়োজন। গত প্রায় ১৪ বছরে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা ছিল বিধায় বাংলাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, যেখানে সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব হয় না, ক্ষমতার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত না হলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। সেই দিক থেকে বিচার করলে গত এক দশকের ওপর সময় ধরে চলমান বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে আগামী নির্বাচনে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় আসতে হবে। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দলকে সুসংগঠিত করতে হবে। যদি তা করা যায় তাহলে আগামী নির্বাচনেও দল ক্ষমতায় আসবে বলেই দেশের বেশিরভাগ জনগণ মনে করে।

তবে রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের আত্মোপলব্ধিকে বাস্তবে কার্যকর করতে হবে। তারা যদি নিজেদের ভুল স্বীকার করে সেই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে সেই সিদ্ধান্ত তাদের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে নিয়ে আসবে। ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের দলের প্রতি অনুগতদের মধ্যে এক ধরনের উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে দেশব্যাপী। তারা এই আচরণ করছে কারণ অনেক ক্ষেত্রে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। এখনও যদি এই সমস্ত নেতাকর্মীরা দলের প্রতি অনুরক্ত না হয় উদাসীন আচরণ করে তাহলে আখেরে আগামী নির্বাচনে দলের জন্য বিপদ ডেকে নিয়ে আসতে পারে। ফলে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে থেকে যেমন এই সকল ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে নেতাকর্মীদেরও অনুরাগ বা বিরাগ থেকে বের হয়ে এসে দলের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। উভয়পক্ষই যদি ইতিবাচকভাবে এই কাজগুলো করে তাহলে দল সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী হবে এবং বিরোধীদলের আন্দোলনের হুমকি কিংবা সরকার পতনে হুমকি মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।

আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলা করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্যে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দেশে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে– এটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক: ড. প্রণব কুমার পান্ডে – অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ