1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

পিতা-মাতার প্রতি অত্যাচারের ঘটনা আর নয়

রাজন ভট্টাচার্য : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২২

সামাজিক, পারিবারিক ব্যক্তিগত সুরক্ষা বিবেচনায় ভবিষ্যৎ জীবনে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে দেখভালের জন্যই মানুষ সন্তান কামনা করে। যদিও সময়ের কারণে সন্তান লাভের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এখন অনেকটা ভিন্ন হলেও আমরা কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতির বাইরে যেতে পারিনি। এটাই স্বাভাবিক।

প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, সংস্কৃতি যাই বলি সবই ঠিক ছিল ’৯০ দশক পর্যন্ত। একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে। বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় আমরা চোখ বন্ধ করে দৌড়াচ্ছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থের বাইরে খুব একটা চলতে পারছি না। ভাবনারও সময় নেই। এরমধ্য দিয়ে গোটা সমাজ ব্যবস্থায় একটা বিরাট রকমের পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। যা সত্যিই অস্বাভাবিক বা পুরোটাই নেতিবাচক!

সমাজ পরিবর্তনশীল। এটা স্বাভাবিক। নিয়ম অনুযায়ী সবকিছুতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগার কথাই। কিন্তু পরিবর্তনের ঝড়, এমন কিছুতে আঘাত করছে যা ভবনের মূলে আঘাত করার শামিল। অর্থাৎ মূল স্তম্ভে আঘাত করা মানেই হলো পুরো ভবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, যে কোনও সময় বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়।

সচেতনভাবে যদি স্তম্ভে আঘাত হতে থাকে আর প্রতিকারের কোনও ব্যবস্থা না হয়; তাহলে কিন্তু এর পরিণতি শুভ হতে পারে না।

যদি মনে করি আমি বা আমরা ভালো আছি, নিজের বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই; তাহলে ভুল। ঝড় সবার জন্যই বিপদ নিয়ে আসে। কেউ কম, কেউবা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাবাকে ছেলেরা প্রথম মারধর করেছে। এই অভিযোগ নিয়ে মা গিয়েছিলেন ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে। এতে ক্ষুব্ধ হন সন্তানরা। তাই দুই ভাই মিলে মাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে গুরুত্বর আহত করেন। হাসপতালের ভর্তি অবস্থায়ও সেই মা নিজের পেটে ধরা সন্তানদের থেকে নিজেকে বিপদমুক্ত মনে করতে পারছেন না। গত ১৩ নভেম্বর মর্মান্তিক এই ঘটনাটি ঘটেছে।

চলতি মাসের শুরুর দিকে নাটোরে এক শতবর্ষী অন্ধ বৃদ্ধাকে রাস্তায় ফেলে যান ছেলেরা। তারপর অসহায় এই বৃদ্ধার দায়িত্ব নেন জেলা প্রশাসক।

ভাবা যায়! এসব ঘটনা সমাজের মূল অস্তিত্বে কত বড় রকমের আঘাত। কত বড় ক্ষতিকর ঝড় উঠেছে আমাদের শেকড়ের বিরুদ্ধে। অস্তিত্বের বিরুদ্ধে। যা গোটা সমাজকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। ঘরে ঘরে আঘাত হেনেছে। লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে ভালোবাসার অকৃত্রিম পারিবারিক বন্ধন। যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

একজন মানুষ হিসেবে যদি চিন্তা করি, মাকে রাস্তায় নিজ হাতে ফেলে আসার ঘটনা মনে হলেই তো– নিজের অজান্তে চোখ ভিজে যায়। তাহলে এসব ঘটনা বারবার কীভাবে ঘটছে? আামাদের হাতে কি তাহলে করণীয় কিছু নেই।

অবশ্যই আছে। না থাকার কোনও কারণ নেই। কিন্তু আমরা করণীয় নিয়ে খুব একটা ভাবছি না। সময় বলছে, আজ থেকেই এ নিয়ে ভাবা উচিত। রাষ্ট্র ও সমাজ মিলে সম্মিলিত ভূমিকাই পারে এই ঝড় সামাল দিতে।

সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হলো, এ ধরনের খবরগুলো দ্রুত গণমাধ্যমে আসছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে সবার কাছে ছড়াচ্ছে। এতে বিপথগামী লোকজন বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিকে দেখে নিজের ক্ষেত্রে যে বাস্তবায়ন করবে না, তা কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এই সংবাদগুলো হৃদয়কে অস্থির করে তোলে। অনেকেই হয়তো খবরগুলো পড়ে বিস্মিত হয়েছেন। মনে মনে ধিক্কার জানিয়েছে। বারবার বলেছেন, ছি ছি ছি। সমাজে এসব ঘটনা হতে পারে? এই ভেবে চুপ করে আছেন। কারণ অবাক হওয়া ছাড়া হয়তো কিছুই করার নেই অনেকের কাছেই। ভাবতে হবে এ ধরনের ঘটনা কিসের আলামত। সমাজ কোন দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে?

সমাজে এসব ঘটনা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় মানবিক হৃদয়ে ঝড় তুলছে। কিন্তু যাদের এ নিয়ে মাথা ব্যথা হওয়ার কথা তারা কি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ভাবছেন। মানছি আইন আছে। আইন অনুযায়ী সন্তান হিসেবে বাবা-মাকে ভরণ-পোষণ করতে সন্তান বাধ্য। এমনকি বৃদ্ধ বাবা-মাকে আইন অনুযায়ী বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো অন্যায়। আইন অমান্য করলে শাস্তিরও বিধান আছে।

একের পর এক এরকম মহা অন্যায়ের ঘটনা তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আইন কার্যকর হচ্ছে না। তেমনি আইন অসহায় সব মানুষের জন্য সুরক্ষা কবচ হিসেবে কাজ করছে না তাও সত্য।

সমাজে ছোট খাট কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি বারবার দেখেও না দেখার ভান করা যায়। কিন্তু বাবা-মায়ের প্রতি এরকম মহা অন্যায় একটিও সহ্য করা যায় না। কোনোভাবেই তা- না দেখার ভান করা বা সহ্য করা উচিত নয়।

যারা এরকম ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা কোনও না কোনও কারণে সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। অপসংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে নিজেকে আর মানুষের কাতারে ধরে রাখতে পারেনি। তাই তার কাছে বাবা-মায়ের গায়ে হাত তোলা, প্রতিবেশি বা গ্রামের অপরিচিত জনের গায়ে হাত তোলার মতোই স্বাভাবিক ঘটনা। এজন্য অপরাধীর কোনও অনুসূচনাও কাজ করে না। সে অনুতাপেও ভোগে না।

অত্যাচারী এমন সন্তানদের কেউ ভালো চোখে দেখে না, তাদের সঙ্গে কথা বললেও ভেতরে ভেতরে মানুষ ধিক্কার দেয়– ছি ছি করে এ বিষয়গুলো মস্তিষ্ক বিকৃতদের অনুভূতিতে কাজ করার কথা নয়। তারা নিজেকে ভালো মানুষ দাবি করে সমাজের বিচার শালিসের কাজেও হয়ত যুক্ত। কিন্তু তার পেছনে যে অন্ধকার জগত রয়েছে, তা হয়তো অনেকেই জানে না, নিজেও নানা কায়দায় তা আড়াল করার চেষ্টা করেন।

প্রথম কথা হলো এ ধরনের মানুষদের সবার আগে মানসিক কাউন্সিলিং যেমন জরুরি তেমনি সমাজের মানুষদের সম্মিলিতভাবে তাদের বয়কট করতে হবে। প্রতিটি ঘটনার পর এলাকাবাসী যদি সম্মিলিত প্রতিবাদ করেন, তাহলে কিন্তু ব্যক্তি প্রভাবশালী হলেও কিছু করতে পারবে না। তার মনে একটু হলেও ভয় কাজ করবে। স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। তাকে আইনের কাঠগড়ায় সপোর্দ করতে হবে। এবার আদালতের কাজ হলো দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও সমাজে অপরাধী ব্যক্তির মুখোশ খুলে দেওয়া।

বিচার এমন হতে পারে– অপরাধী ব্যক্তিকে প্রতিদিন জনসম্মুক্ষে বুকে পোস্টার নিয়ে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা অবস্থান করা। সবাই যেন বিষয়টি দেখতে পায়। এতে অপরাধ যেমন কমবে তেমনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথাও গণমাধ্যমে প্রচার হলে অন্যরা এরকম ঘটনা ঘটাতে সাহস করবে না। তবে জেল, জরিমানাও এরসঙ্গে যুক্ত করতে হবে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বাবাকে মারধরের ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ দেওয়ায় মাকেও বেধড়ক পেটানোর অভিযোগ উঠেছে তাদের দুই ছেলের বিরুদ্ধে। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার কালবিলা গ্রামে গত শনিবার সন্ধ্যায় এ ঘটনাটি ঘটে। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওই দম্পতির তিন ছেলে। তারা প্রায়ই তুচ্ছ অজুহাতে বৃদ্ধ বাবা-মাকে মারধর করেন। কেউ এর প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের লাঞ্ছিত করেন। যার ধারাবাহিকতায় শনিবার সন্ধ্যায়ও তাদের মাকে বেধড়ক জুতা দিয়ে পিটিয়ে ও টেনে-হিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যান দুই ছেলে। এতে বৃদ্ধ নারী অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান অমল মল্লিকের বক্তব্য অনুযায়ী এই নারীর ২৮ ও ৪০ বছর বয়সী দুই ছেলে তাদের বাবাকে মারধর করেন। এ ঘটনায় বৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রী শনিবার ইউনিয়ন পরিষদে অভিযোগ করেন। অভিযোগের বিষয়ে দুই ছেলেকে নোটিশ করা হয়। কী কারণে তাদের মারধর করা হয় জানতে সেদিনই শুনানির দিন ধার্য করা হয়; কিন্তু শুনানির আগে সন্ধ্যায় দুই ছেলে মাকে পিটিয়েছে।

অন্যদিকে নাটোরে শতবর্ষী অন্ধ মাকে রাতের আঁধারে রাস্তায় ফেলে যাওয়ার ঘটনা সবাইকে হতবাক করেছে। গত ২ নভেম্বর সদর উপজেলার ছাতনী ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী মায়ের নাম তারা বানু। তিনি পাঁচ সন্তানের জননী। তিন ছেলের নিজস্ব বাড়ি ও জমিজমা থাকার পরও তারা কেউ মায়ের দায়িত্ব না নিলে তিনি পাশের গ্রামে তার বড় মেয়ে রায়লা বেগমের বাড়িতে ওঠেন। বড় মেয়ে ও জামাইকে তার বয়স্ক ভাতার টাকা দেওয়ায় রেগে যান ছোট দুই ছেলে ও বড় ছেলের ঘরের দুই নাতি। সবাই বয়স্ক ভাতার সমান ভাগ পেতে পর্যায়ক্রমে মাকে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। অক্টোবর মাসে তারা বানু ছিলেন ছোট ছেলে আজাদের সংসারে। নভেম্বর মাসের দুই তারিখ পার হয়ে গেলেও বড় ছেলে মাকে নিতে না যাওয়ায় বুধবার রাতে আজাদ তার অন্ধ মাকে রাস্তায় ফেলে যান।

পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী তারা বানুকে বড় ছেলে মানিকের বাড়িতে দিয়ে আসলে তাকে রাতে বাড়ির গোয়ালঘরে থাকতে দেওয়া হয়। খবর পেয়ে বৃদ্ধা তারা বানুর দায়িত্ব নেন জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ।

পারিবারিক, অর্থনৈতিক সহ ব্যক্তি স্বার্থের কারণে সমাজে বাবা-মায়ের প্রতি এ ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ বাড়ছে। যা কলুষিত সমাজের উদাহরণ। এ ধরনের সমস্যাকে আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। এজন্য রাষ্ট্র তথা সমাজকে সোচ্চার হতে হবে। আমাদের সবাইকে বাবা-মায়ের প্রতি আরও যত্নবান হতে হবে।

একটু চোখ বন্ধ করে যদি ভাবি, এই বাবা-মা কত কষ্ট করে যত্নে-আদরে আমাদের বড় করেছেন। আমরা যেমন আমাদের সন্তানদের বড় করছি। এমন না হোক আমাদের সন্তানরা যদি আগামী দিনে আমাদের সঙ্গে যদি এমন আচরণ করে! আমাদের অপকর্মে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি উৎসাহিত হয় ঝড়ের মহা-বিপদ সংকেত সবার জন্যই। কেউ যেন আগামী প্রজন্মকে এরকম বিপজ্জনক বাস্তবতার দিকে ঠেলে না দেই। তাই বাবা-মায়ের প্রতি অত্যাচারের ঘটনা আর নয়। সত্যিই এমন আঘাত হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়।

লেখক : রাজন ভট্টাচার্য – সাংবাদিক ও কলামিস্ট


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ