1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

স্মরণে শহীদ ডা. মিলন ও দেশের স্বাস্থ্যখাত

অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২২

১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের আমলে ‘জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি’ বিষয়টা সামনে চলে আসে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এ দেশের চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)’ শুরু থেকেই দেশে একটি গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য দাবি-লড়াই-আন্দোলন করে আসছে। এ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও মেডিক্যাল শিক্ষার উন্নয়নে বিএমএর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৯০ সালে চিকিৎসকদের প্রাণের দাবি ২৩ দফা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন চলছিল।

এই দাবিতে চিকিৎসকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় ছিল না, ছিল গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা বাস্তবায়নে নীতিমালা প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ, অবকাঠামো সংস্কার, বাজেট, মেডিক্যাল শিক্ষা সংস্কারসহ নানা অতীব জরুরি বিষয়।

১৯৯০ সালের জানুয়ারি থেকেই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল যে এরশাদ সরকার একটা স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে। ৪ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণে জেনারেল এরশাদ চিকিৎসকদের জাতির সামনে অন্যায়ভাবে হেয় করে বক্তব্য দিলেন। এতে চিকিৎসক সমাজ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হলো। ডা. মাজেদ ও ডা. জালালের নেতৃত্বাধীন বিএমএ তখন একদিকে কর্মসূচি দিল এবং অন্যদিকে দেশব্যাপী চিকিৎসকদের সংগঠিত করার জন্য সাংগঠনিক সফরে বের হলো। এরই মধ্যে অনেকটাই পরিষ্কার এরশাদের গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি। বিএমএর নেতৃত্বে গোটা দেশের চিকিৎসকরা নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ। ২৫ জুলাই রাষ্ট্রপতি এরশাদ বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে এ দেশের চিকিৎসকদের চূড়ান্ত সমালোচনা-অবমাননা করে জাতির সামনে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ঘোষণা করলেন। এই নীতিতে বিএমএ বা চিকিৎসকসহ কোনো মহলেরই কোনো মতামত নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেই স্বাস্থ্যনীতি ছিল একেবারে অবাস্তব। বিএমএ এবং সব রাজনৈতিক দল তা প্রত্যাখ্যান করে। ২৭ জুলাই ছিল বিএমএর পূর্বঘোষিত শহীদ মিনারে জাতীয় চিকিৎসক মহাসমাবেশ এবং বিকেলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিশেষ সাধারণ সভা। সেখান থেকে ‘গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল ও ২৩ দফা দাবি বাস্তবায়ন’-এর জন্য চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। চিকিৎসকদের গণপদত্যাগ, কর্মবিরতি, গণসংযোগ, সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দেশের চিকিৎসক সমাজ বিএমএর নেতৃত্বে ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলে। অবশেষে ১৪ আগস্ট চিকিৎসকদের তুমুল আন্দোলনের মুখে সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ স্বাক্ষরিত একটি প্রেস নোট বিএমএর কাছে প্রেরণ করা হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করা হয়। প্রেস নোটের বক্তব্য ছিল ‘সরকারের প্রস্তাবিত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ১৯৯০-এর রূপরেখা নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার অবসান হওয়া প্রয়োজন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি এরই মধ্যে ৫ আগস্ট, ১৯৯০-এ চিকিৎসক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি নতুন স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করার জন্য আহবান জানিয়েছেন। ওই আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দেশের জনগণের কল্যাণে একটি সর্বজনস্বীকৃত নতুন স্বাস্থ্যনীতি বিএমএ এবং চিকিৎসাসংক্রান্ত পেশাজীবী ও অন্যান্য জনপ্রতিনিধিমূলক সংগঠন ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে প্রণয়ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই উদ্দেশে সরকার একটি কমিটি গঠন করবে। ’ বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত প্রেস নোট সম্ভবত এই একটিই।

বিএমএ আন্দোলন স্থগিত করার কিছুদিন পর সরকার আবার একই স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে ছিলেন না, বিএমএ চেয়েছিল সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী একটি স্বাস্থ্যনীতি। বিএমএকে সরকারের চুক্তি ভঙ্গ করার কারণে আবার আন্দোলনে নামতে বাধ্য করা হলো। চিকিৎসকদের এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দল, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পাঁচ দল এবং বাম জোটের পাঁচ দল। দেশে তখন চলছিল স্বৈরাচারবিরোধী জাতীয় আন্দোলন, আর অন্যদিকে চলছিল বিএমএর নেতৃত্বে চিকিৎসকদের গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল এবং ২৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলন। ২৭ নভেম্বর ছিল বিএমএর দেশব্যাপী কর্মসূচি। তৎকালীন পিজি হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে আয়োজিত সভায় যাওয়ার পথে ডা. মিলন টিএসসি চত্বরে শহীদ হন।

ডা. মিলনের মৃত্যু এরশাদের পতন ত্বরান্বিত করে এবং ৬ ডিসেম্বর ৯ বছরের স্বৈরশাসনের পতন হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পরপরই গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল ঘোষণা করে। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন, কিন্তু স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেই জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। ১২-১২-৯৬ তারিখে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্মারক নম্বর হাস-১/স্বানী-২/৯৫/১১৭ সূত্র মোতাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সভাপতি করে ২৬ সদস্যের ‘জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। এতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় উপনেতা অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ দেশের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) এবং অনুচ্ছেদ ১৮(১) অনুযায়ী জনগণের পুষ্টির উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনের লক্ষ্যসহ স্বাস্থ্যনীতিতে ১৫টি লক্ষ্য, ১০টি মূলনীতি এবং ৩২টি কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়। ২০০০ সালে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি সর্বস্তরের জনগণের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করে মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়। এতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও মেডিক্যাল শিক্ষার উন্নয়নের সব দিকনির্দেশনা বিদ্যমান। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ২০১১ সালে এই স্বাস্থ্যনীতি হালনাগাদ করা হয়। এই স্বাস্থ্যনীতি অনুসরণ করে চললে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বেশির ভাগ সমস্যাই সমাধান হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে জনবল, অবকাঠামো, কর্মবিন্যাস এবং পরিকল্পনা দুর্বল বলা যাবে না। বিগত ১৪ বছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে দৃশ্যমান উন্নয়ন, আধুনিকায়ন এবং সম্প্রসারণ করেছেন। স্বাস্থ্যব্যবস্থা একটি জরুরি বিষয়, যেখানে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় দ্রুত, বাস্তবায়ন করতে হয় ত্বরিত, ধীরগতি বা গাফিলতির কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এ দেশের চিকিৎসকদের একমাত্র জাতীয় সংগঠন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, মেডিক্যাল শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। ১৯৯০ সালে ড্যাব সৃষ্টির মাধ্যমে চিকিৎসক সমাজ নানা রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএমএ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন ভিন্ন হতেই পারে; কিন্তু বিএমএতে দল-মত-নির্বিশেষে গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থার স্বার্থে, চিকিৎসকদের উন্নয়ন ও অধিকারের স্বার্থে সব চিকিৎসকের ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরি। উন্নত বিশ্বে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার নীতি নির্ধারণে মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা অপরিসীম, কখনো কখনো প্রধান। আমরা শহীদ মিলন দিবসে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনকে সেই উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করতে চাই। সরকারের নেতৃতে বিএমএসহ সব চিকিৎসা পেশার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষার স্বাস্থ্যব্যবস্থার বাস্তবায়ন অবশ্যই সম্ভব।

লেখক : অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান – সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ