দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ১৫ নভেম্বর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপি ও সমমনাদের আন্দোলন আরও তীব্র করার ঘোষণা আসে তাদের তরফে। তারা এমন ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিল বটে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেকেই মনে করছেন আন্দোলনই সঠিক পথ। সরকার ও নির্বাচনব্যবস্থা বিরোধী চলমান আন্দোলনে সহিংসতা অতীতের মতোই জেঁকে বসেছে। মানুষ দগ্ধ হচ্ছে, সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে এবং ক্রমেই জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারের নামে আন্দোলন ও ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য সহিংস যে রূপ দেখা যাচ্ছে, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তা গ্রাহ্য হতে পারে না। আমরা ইতোমধ্যে একাধিক সংকটের মধ্যে রয়েছি। এর মধ্যে রাজনৈতিক সংকট ক্রমেই ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে আস্থার সংকট তীব্রতর হয়ে উঠেছে। শর্তহীন আলোচনার টেবিলে যে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, তা-ও সম্ভব হচ্ছে না আস্থাহীনতার কারণে। রাজনৈতিক অঙ্গনের উত্তাপ সহিংসতার পথে এগিয়ে চলেছে এবং দেশের ভাবমূর্তির জন্যও তা ক্ষতিকর হচ্ছে। জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ায় বাড়ছে জনদুর্ভোগও।
জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে রাজনৈতিক দল তাদের বক্তব্য, অবস্থান এবং কাজের ধারাবাহিকতা ভোটারদের জানানোর চেষ্টা করে। নির্বাচনের আগেই যে এমনটি হতে হবে তা নয়। রাজনৈতিক কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত নানাভাবে তা করা যেতে পারে। এভাবেই জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয় এবং ভোটারদের সমর্থন আদায় করা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে সহিংসতার পথ পরিগ্রহ করলে তা জনগণকে সম্পৃক্ত করার বদলে আরও রাজনীতিবিমুখ করে তোলে। দেশের সিংহভাগ মানুষ শান্তিপ্রিয়। শান্তিপ্রিয় বলেই তাদের সহনশীলতা অনেক বেশি। যেকোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে তারা সমন্বয়ের মাধ্যমে টিকে থাকে। অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক সংকটের ক্ষেত্রে এই সহনশীলতা থাকলেও রাজনৈতিক সহিংসতা কিংবা সামাজিক অস্থিরতা সাধারণ মানুষ মেনে নেয় না। এজন্য যারা সহিংস রাজনৈতিক পথ অনুসরণ করেন সাধারণ মানুষ তাদের সমর্থন করে না।
দেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কখনোই ছিল না। তবে এও সত্য, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে জনগণই রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করেছে। অভিজ্ঞতায় আছে, যারা সহিংস রাজনৈতিক পথ অনুসরণ করেছে তারা কখনও মহৎ কোনো অর্জন এনে দিতে পারেনি। জনগণ তাদের ত্যাগ করেছে এবং তাদের কর্মসূচিও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। অর্থাৎ রাজনীতিতে সহিংসতা আত্মবিনাশের পথ হয়ে ওঠে। সহিংসতা মহৎ কোনো অর্জন এনে দিতে যেমন পারেনি, তেমনি পারবেও না। সহিংস রাজনীতি যে রাজনীতিকদের বিনাশ ডেকে আনে এমন নজির বহু রয়েছে। অধিকার আদায় কিংবা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিচয়ে কোনো হত্যাকাণ্ড কিংবা অগ্নিসন্ত্রাস সমর্থন পেতে পারে না। এবারও বিরোধী দলের অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি সফল হবে তা আশা করা যায় না। তারা খুব বেশিদিন সহিংসতার রাজনীতিও করতে পারবে বলেও মনে হয় না। জনগণই তাদের ত্যাগ করবেÑ অভিজ্ঞতা তা-ই বলে।
সুস্থ ধারার কিংবা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সন্ত্রাস, সহিংসতার কোনো স্থান নেই। রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন নীতিভ্রষ্টদের প্রবেশ ঘটে এবং কলুষতা ছড়াতে শুরু করে, তখন তা জনগণের কল্যাণে তো আসেই না উপরন্তু জনজীবনে দুর্ভোগ বেড়ে যায় এবং জন্ম দেয় আতঙ্কের। দলীয় স্বার্থে, ক্ষমতা আদায়ের জন্য যেভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে সহিংসতা বাড়ছে তা দুঃখজনক। সহিংসতা রাজনৈতিক সংকটের পাশাপাশি জননিরাপত্তাও ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। রাজনীতিতে সহিংসতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে হীনস্বার্থের কারণে এবং এখনও তা জিইয়ে রয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের নামে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহিংসতা ও বিরোধের পথ বেছে নেয় কিছু রাজনৈতিক দল। আমরা দেখছি, রাজনীতি মিথ্যাচারের পথেই এগিয়ে চলেছে। রাজনীতিকরা যখন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালান, তখন তা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে সংজ্ঞায়িত হতে পারে না। তাদের কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতো হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়গুলো রাজনীতির নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই ক্ষমতার উৎস।
ভোটারদের সমর্থন আদায়ের জন্য এই মুহূর্তে সব রাজনৈতিক দলকে সংলাপের মাধ্যমে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের কাঠামো, ব্যবস্থা ও বণ্টনের বিষয়ে সমঝোতায় আসতে হবে। নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে কাঠামো, ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জননিরাপত্তার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষত ভোটাররা যেন ভোটকেন্দ্রে আসার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি না হন এবং নিজের পছন্দের দলকে ভোট দিতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো রাজনৈতিক প্রার্থীকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো প্রস্তাবনা দিতে দেখা যায়নি। অথচ পরিকল্পনা পর্যায়ের এ বিষয়গুলো উপস্থাপন করলে রাজনীতিকরা দেশ-জাতিকে পথ দেখাতে পারত। সংলাপের পথও অনেকটা মসৃণ হতো। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হয় সরকারকে। সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা ও অপরাধ দমনে প্রস্তুতির বিষয়টি নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। নানা ঘাটতি ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক অর্জন রয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা অবকাঠামোগত হওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছেন। সহিংস এই পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু দায় রয়ে গেছে।
১৯ অক্টোবর প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার পরও পানির বোতলে বিক্রি হচ্ছে পেট্রোল-অকটেন। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল সড়কের ধারে টায়ার বা মেকানিকের দোকানের সামনে টেবিলের ওপর সারি সারি পানির বোতলে পেট্রোল-অকটেন বিক্রি করা হয়। যাদের লাইসেন্স নেই বা যেসব বাইকের কাগজপত্র ঠিক নেই, সেসব বাইকের চালকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পেট্রোল-অকটেন এই পানির বোতলে কেনেন। কিন্তু অবরোধ-হরতালের নামে একটি মহল পেট্রোল বোমা কিংবা ককটেল ছুড়ে যানবাহনে আগুন লাগাচ্ছে। পেট্রোল পাম্প থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করে দুর্বৃত্তরা যেন আগুন লাগাতে না পারে সেজন্য ডিএমপির এই উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য। খোলা পেট্রোল বিক্রির বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোযোগ আরও গভীর করা দরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। জনসংখ্যাবহুল এই দেশে সবখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমান মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। সেজন্য পাড়া-মহল্লা-আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক থাকতে হবে। যদি কোনো জায়গায় খোলা পেট্রোল বিক্রি করা হয়, তাহলে অনতিবিলম্বে পুলিশকে জানাতে হবে। পাশাপাশি সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে অবশ্যই পুলিশকে অবহিত করতে হবে।
সন্ত্রাস দমনে আইন রয়েছে। আইনের ভিত্তিতে বিচারকার্য পরিচালনা করতে হবে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই। প্রযুক্তির ব্যবহারে এবং তদন্ত সাপেক্ষে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। আগেই বলেছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও রয়েছে এবং এখন তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। যেসব জায়গায় যানবাহনে আগুন লাগানো হচ্ছে, সেসব এলাকা চিহ্নিত করতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ বা চিহ্নিত জোন ভাগ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টহল দিতে হবে। যেসব এলাকায় দুর্বৃত্তদের তৎপরতা বেশি সেসব এলাকায় নজরদারি, টহল এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে টহল বা অভিযানের সময় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ যেন না হয় সেদিকে মনোযোগ রাখাও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষ যেন অভিযোগ করতে পারে এবং কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন না হয়, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। সহিংসতার অভিযোগে যেকোনো কাউকেই গ্রেপ্তার করা যাবে না। এক্ষেত্রে তদারকি বাড়ানো জরুরি। অনুমান সাপেক্ষে গ্রেপ্তার আইনের মানদণ্ডে যথাযথ নয়। তাতে জন-আস্থার পারদ নিম্নগামী হয়।
আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পথ অমসৃণ হয়। আমরা জননিরাপত্তার বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিই এবং সবার নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব পালনের অনুরোধ রাখি। রাজনীতির নামে ত্রাস সৃষ্টি করার অধিকার কারোই নেই। আমরা রাজনীতি চাই, কিন্তু অপরাজনীতি চাই না। রাজনীতিকদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি থাকতে হবে জনগণের কাছে। জনগণকে জিম্মি করে কোনো আন্দোলনই গণতন্ত্রে স্বীকৃত নয়। জনগণের স্বস্তি-নিরাপত্তা-অধিকারের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি গণতন্ত্রের সংজ্ঞাসূত্র বিরুদ্ধ। সবার মধ্যে শুভবোধের উদয় হোক। সবার আগে জননিরাপত্তা, তা আমলে রাখতেই হবে।
লেখক: মোহাম্মদ আলী শিকদার – অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক