1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

সাম্প্রদায়িক শক্তি এই মাটিতে কখনো বিজয়ী হয়নি

সন্দীপন বসু : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২১

বাংলাদেশে দুর্গাপূজা মানেই সর্বজনীন। উৎসবটির নামও সর্বজনীন শারদীয় দুর্গাপূজা। এই পূজায় কোনো ভেদ-বিভেদ করা হয় না। আমন্ত্রিত সবাই। দুর্গাপূজায় উৎসবের আনন্দে মাতে গোটা দেশ। আয়োজক হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শুধু নয়, অন্য সম্প্রদায়ের উপস্থিতিও লক্ষ করা যায়। কোনো পূজা মণ্ডপে গিয়ে কেউ বুঝতেই পারবেন না কে কোন ধর্মাবলম্বী। এটাই সম্প্রীতির বাংলাদেশ। হাজার বছর ধরে চলে আসছে এই বিরল সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন।

হিন্দু পৌরাণিক শাস্ত্রমতে দুর্গোৎসব সমাজকে হিংসা, বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত করে। মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে ঐক্য, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা। আর বাঙালির শত বছরের ঐতিহ্যে এই পূজা সম্প্রীতি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করে মানুষকে। সুদৃঢ় করে সম্প্রীতি ও ভাতৃত্ববোধের বন্ধন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার মঙ্গল কামনায় পালিত হয় এই দুর্গোৎসব।

সর্বজনীন এই অনুষ্ঠান চলাকালেই কুমিল্লার নানুয়া দীঘির পাড়ে শারদীয় দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে এক চরম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ঘটেছে। দুর্গাপূজার মধ্যেই কুমিল্লায় কোরআন শরিফ অবমাননার কথিত অভিযোগ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ পরিস্থিতি শান্ত করতে গেলে তারা তোপের মুখে পড়ে, বাঁধে সংঘর্ষ। এর জের ধরে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মন্দির-মণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। চাঁদপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে চার জনের প্রাণহানিও ঘটেছে। সেখানে চলছে ১৪৪ ধারা।

চাঁদপুর ছাড়াও সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিল নিয়ে মন্দিরে হামলা হয়েছে। গাজীপুরের কাশিমপুর এলাকায় সুবল দাসের বাড়িতে দুর্গাপূজার মণ্ডপে ৩০০-৪০০ লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। সন্ধ্যার পর হামলা হয় চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কর্ণফুলী উপজেলা। রাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও কুলাউড়ায় ৯টি মন্দির ও পূজা মণ্ডপে চলে হামলা-ভাঙচুর। কক্সবাজারের পেকুয়ায় দু’টি পূজামণ্ডপে হামলার পর বেশ কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর হয়। বান্দরবানের লামায় মিছিল করে মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালায় ওই ‘সর্বস্তরের তৌহিদী জনতা’। হামলা হয়েছে কুড়িগ্রামের উলিপুরে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে। বিভিন্ন জেলাতেও হয়েছে এমন হামলা-ভাঙচুর। এমন পরিস্থিতিতে দুর্গাপূজায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারাদেশে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

যারাই কুমিল্লায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করেছেন, সবারই বক্তব্য— এটি একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ। হিন্দু ধর্মালম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব চলাকালে একটি মহল দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ঘটনার পর থেকে সর্বত্র একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে এবং এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে উৎসবের প্রাণচাঞ্চল্য। সারাদেশের হিন্দুরা এই মুহূর্তে চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। সম্প্রীতির উৎসব পরিণত হয়েছে বিষাদে।

পুলিশ ও প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের প্রধানমন্ত্রী সবাই এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় উদ্বিগ্ন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে দুর্গাপূজার মণ্ডপে হামলার পেছনে ‘ষড়যন্ত্র’ রয়েছে বলেই প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল, কোনো ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারীর কর্ম এটা। আমরা তদন্ত শেষে আপনাদের সব ঘটনা জানাতে পারব।’ পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ‘উসকানি দিয়ে’ মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় ৪৫ জনকে আটক করার কথা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুমিল্লার ঘটনায় কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে মন্তব্য করেছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে একটি গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে। সরকার এবং আওয়ামী লীগ যেকোনো মূল্যে এই অপশক্তিকে প্রতিরোধ করবে।’ এই সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রায় সব পর্যায়ের নেতারা।

কুমিল্লার ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে একদল মানুষের সুযোগসন্ধানী প্রচেষ্টা। যেভাবেই হোক, এর গভীরে যেতে হবে। যেতে হবে এই বিষের উৎসমূলে। ধর্মের নামে, ধর্ম প্রতিষ্ঠার নামে এই অঞ্চলে হানাহানি, বলপ্রয়োগ, রক্তপাত, প্রাণহানির ঘটনা তো নতুন কিছু নয়। সুদূর অতীতেও ঘটেছে, সাম্প্রতিক সময়েও ঘটছে। তবে এটাও ঠিক, হাজার বছর ধরে নানা জাতি ধর্মের মানুষ এই ভূখণ্ডে সাম্প্রদায়িক শক্তি কখনো বিজয়ী হয়নি। নানা ধর্ম ও মতের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে এ দেশের রয়েছে ঐতিহ্য। ইংরেজ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমলে এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, সেটি সত্যি। কিন্তু ওই দুই আমলসহ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর অপচেষ্টা রুখে দেওয়া হয়েছিল সম্মিলিত প্রতিরোধের মাধ্যমেই।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির পরিচিতিও মূলত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে। এই বীজ প্রোথিত করে দিয়ে গিয়েছিলেন বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বায়াত্তরের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রথম বক্তৃতাতেই স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশ কোনো ধর্মীয় রাষ্ট্র হবে না, বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকার থাকবে। বাংলাদেশে ধর্মের রাজনীতির কোনো জায়গা হবে না।’ বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে বায়াত্তরের সংবিধানে। সংবিধানের চার মূলনীতিতে যুক্ত করা হয় ধর্মনিরপেক্ষতার বিধান। সংবিধানের বিধানে সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞাকে সুনির্দিষ্টও করা হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগঠন এবং তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কার্যকলাপকে নিষিদ্ধ করা হয়।

প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের বিষয়টিই ছিল চরম বিতর্কিত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশের বিভাজন অসারত্বের প্রমাণ। জিন্নাহর ভ্রান্ত ও ভ্রষ্ট রাজনীতিকে পরাজিত করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পতন ঘটিয়ে বাঙালি জাতি নিজেদের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু সেদিন দ্বিজাতি তত্ত্বের রাজনীতিকে সমুচিত জবাব দেওয়া গেলেও ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক বিষ দূর করা সম্ভব হয়নি। ব্রিটিশদের কলোনি পরিচালনার সুবিধার্থে প্রোথিত ধর্মীয় বিভেদের বিষ এখনো আচ্ছন্ন করে আছে উপমহাদেশকে।

নৃতাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে এশিয়ার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর অন্যতম এই ব-দ্বীপে বসবাসকারী বাঙালি জাতি। শত বছর ধরে নদী অধ্যুষিত এই জনপদে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান একসঙ্গে বসবাস করেছে। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেও পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের ভিত্তি এ বসবাসকারীদের মর্মমূলে প্রোথিত। পারস্পরিক সম্প্রীতির ভিত্তিতে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় বসবাসকারী এই মানুষগুলোর মধ্যে নিজস্ব কৃষ্টি ও সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছে। কৃষির জন্যে এই ব-দ্বীপের মাটি উর্বর হলেও তা কখনোই সাম্প্রদায়িকতার উর্বর ক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি। সেই প্রাচীন বৌদ্ধযুগ থেকে শুরু করে গুপ্তযুগ, রাজা শশাঙ্ক, পাল, সেন, বাংলার সুলতান, মোগল, বারো ভূঁইয়া ও নবাবের আমল, এমনকি শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদদৌলার সময়েও এই অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাচার করেছে স্বাধীনভাবে। ব্রিটিশরা এসে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি, তথা ‘বিভক্ত করো, শাসন করো’ নীতি গ্রহণের মাধ্যমেই মূলত এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিভক্তি, বিভাজনের বীজ লাগিয়ে দিয়েছে। এর বিষ ফলের ফায়দা তুলে দুইশ বছর এই অঞ্চলসহ উপমহাদেশকে লুটেছে ব্রিটিশরা। আর সেই বিষফল ফলছে এখনো।

ব্রিটিশদের লাগানো বিভাজনের সেই সাম্প্রদায়িক বৃক্ষের ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু সেই বিভেদের রাষ্ট্র কাঠামোতে শোষিত হতে থাকে বাঙালি জনগোষ্ঠী। বাড়ে অসন্তোষ, গড়ে ওঠে জনবিদ্রোহ। সামনে এগিয়ে আসেন বাঙালির মুক্তির অবিসংবাদিত মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার অঙুলি হেলনে একাত্তরে ৩০ লাখ গণমানুষের প্রাণের বিনিময়ে জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বকে অসার প্রমাণ করে সৃষ্টি হয় স্বাধীন বাংলাদেশ।

পাকিস্তান আমলের পর স্বাধীন বাংলাদেশেও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর এক ধরনের নীরব সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন ঘটেছে বা ঘটছে। তবে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সংখ্যালঘুদের নিয়ে কিছু না কিছু সমস্যা আছে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা সব দেশে সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারে না। আমাদের পাশের দেশগুলো যেমন— পাকিস্তান, ভারত, চীন, মিয়ানমার, শ্রীলংকাসহ অনেক দেশেই সংখ্যালঘুরা নির্যাতন, নিপীড়ন, হয়রানির শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হলেও নীরব সাম্প্রদায়িকতা আছে। আছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে জর্জরিত হয়ে নিয়মিত সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের ঘটনা।

একটি কথা না বললেই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাড়ার পাশাপাশি এই অপচেষ্টা প্রতিরোধে রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সচেতন মানুষের এগিয়ে আসার নজির লক্ষণীয়। লক্ষণীয় বর্তমান সরকার তথা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নিরলস প্রয়াসও। এর মাঝেও মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো, ঘটায় নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা। আর এসবের পরিপ্রেক্ষিত- পরম্পরায় সংখ্যালঘুদের মাঝে আস্থা আর নিরাপত্তার সংকট অনূভূত হয়। এটি খুবই স্বাভাবিক।

গত ৭৪ বছরে নানা পরিস্থিতির শিকার হয়ে লাখো সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করেছেন। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণটি ছিল নিরাপত্তার সংকট। এখনো এই সংকটটিই প্রকটভাবে দৃশ্যমান। এই সংকট কাটাতে সরকারকে আরও শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। এবারের দুর্গাপূজাকে ঘিরে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিটি ঘটনা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ তৎপরতা কাম্য। এ বিষয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সচেতন নাগরিকদেরও সতর্ক থাকা জরুরি, যেন কেউ উসকানি দিয়ে কোনো ঘটনাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে না পারে। সম্প্রীতির বাংলাদেশে যারা সম্প্রীতি ধ্বংসের অপচেষ্টা চালায়, তাদের কোনো ছাড় নয়। দখলদার, বিভাজন সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনলে, শাস্তি দিলে মানুষ আস্বস্ত হবে। ফিরে আসবে নিরাপত্তা বোধ, কাটবে আস্থার সংকট।

আরেকটি কথা না বললেই নয়, এবারের সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপপ্রয়াসকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরোপিত প্রচার ছিল উদ্বেগজনক। বিএনপি-জামায়েতের ফেসবুক প্রচারমাধ্যম হিসেবে পরিচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পেজ, পেইড এজেন্টদের ব্যক্তিগত পেজগুলোতে এই ঘটনাটির অতিউৎসাহী প্রচারও ছিল লক্ষণীয়। এই অপশক্তি বাংলাদেশকে বরাবরই পাকিস্তান-আফগানিস্তান বানাতে চাইছে। যে দ্রুততায় ফেসবুক ইউটিউবে হাজার হাজার ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হলো, এর পেছনে রাজনৈতিক অভিপ্রায়, দুরভিসন্ধি অবশ্যই আছে। কেউ কিছু জানার আগেই যেন দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত এই পেজগুলো সব ঘটনা জেনে বসে আছে। শিশু থেকে শুরু করে নানাবয়েসী দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রত্যক্ষদর্শীরা ওই পেজের কাছে বক্তব্য পাঠিয়ে বসে আছে। এই পেজগুলোসহ যেকোনো খবরে গুজব প্রচারকারী পেজগুলোকে আইনের আওতায় আনা আশু প্রয়োজন।

তবে এতসব নেতিবাচক খবরের পাশাপাশি কিছু খবর আশান্বিতও করে। সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটে একই চত্বরে অবস্থান মন্দির ও মসজিদের। শহরের পুরান বাজার জামে মসজিদ ও কালীবাড়ি কেন্দ্রীয় মন্দিরটি একই উঠোনে রয়েছে। দুই উপাসনালয়ে কয়েক দশক ধরে চলছে একযোগে প্রার্থনা। যে যার মতো ধর্মীয় আচার পালন করে চলেছেন। শারদীয় দুর্গোৎসবের আমেজে মেতে উঠেছে ওই চত্বরটি। ধর্মীয় সম্প্রীতির এই নিদর্শন কিন্তু বাংলাদেশে বিরল নয়। এমন খবরও আসছে— কুমিল্লার ঘটনার পর পূজা নির্বিঘ্ন করতে মণ্ডপ পাহারা দিচ্ছেন মুসলমানরাই।

আসলে এটাই বাংলাদেশ। কাজী নজরুলের বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। সন্ধ্যার আজানের পর হিন্দু ঘরে ঘরে বেজে ওঠে শাঁখ— এই দৃশ্য তো এই বাংলার চিরচেনা। উসকানি ছড়িয়ে ফায়দা লুটতে শতকোটির বাজেট, ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নের সিঁড়ির নিচে শত পোড়া লাশ থেকে শুরু করে দেশভাগের আরোপিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা— সব ছাপিয়ে এই দুঃসময়েও অন্তঃস্থল থেকে একটি বাক্যই উঠে আসে— সাম্প্রদায়িক শক্তি এই বাংলার মাটিতে কখনো বিজয়ী হয়নি। সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে সাময়িক কিছু কুলাঙ্গার-অপশক্তি ফায়দা লুটেছে ঠিকই, কিন্তু আখেরে জয় হয়েছে এই ভূমির খেটে খাওয়া ঘামে ভেজা মানুষগুলোরই। তারা সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বিষাদে ধর্মের নামে আরোপিত হিংসার বাতারবণকে ছাপিয়ে ছিল ঘন হয়ে। ছিল পাশাপাশি। বাংলার জল, বাংলার মাটি, বাংলার মানুষকেই দিয়েছে সর্বোচ্চ মর্যাদা। জয় হোক বাংলার আপামর জনতার, লোপ পাক সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, ষড়যন্ত্রকারীদের কালো হাত।

লেখক: সন্দীপন বসু, ডেপুটি এডিটর, সারাবাংলা ডটনেট।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ