লোকে তার ছবি দেখুক আর না-ই দেখুক—সবাই জানে তিনি আঁকিয়ে; জয়নুল আবেদিন—বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অসামান্য কিংবদন্তি। মধ্যবিত্তের শিল্পবস্তুর সঙ্গে আমজনতার সম্পর্ক অতি দূরের হলেও প্রায় সবার কাছেই পৌঁছে গিয়েছে তার জীবন ও কাজের বিবরণ।
বাঙালির আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের বিশিষ্ট ক্ষেত্রভূমি তার ছবি। পূর্ব বাংলার বাঙালির হাতে তিনি তুলে দিয়েছিলেন স্বতন্ত্র চিত্রভাষা। থেমে থাকেননি সেখানে; বাংলাদেশে চিত্রকলার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেছিল তারই তত্ত্বাবধানে। আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। আবার যুক্ত ছিলেন লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সঙ্গে। অর্থাৎ তিনি বুঝেছিলেন, ব্যক্তি পর্যায়ে আঁকলেই হবে না; শিল্পীর জন্য প্রস্তুত করে দিতে হবে বিদ্যায়তনিক পাটাতন। সেখানে দাঁড়িয়েই শিল্পী গড়ে তুলবেন নিজস্ব ভাবনার রূপ, রস ও সৌন্দর্য।
প্রশ্ন হলো, শিল্প শিখন এবং শিল্পবস্তু সংরক্ষণের উদ্যোগ কেন নিলেন তিনি? সমুদয় প্রশ্নের জবাব নিহিত বাঙালির ঔপনিবেশিক ইতিহাসে। ছবি আঁকার কৌশলগুলো তিনি রপ্ত করেছিলেন কলকাতা আর্ট কলেজে, যার ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক গুরুদের হাতে। সেই সূত্রে বাঙালির শিল্পমঞ্চে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়। কেউ গিয়েছেন পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু নির্ভর চিত্রাঙ্কনের দিকে; কারও ছবিতে এলো ভারতীয় পুরাণ ও আধ্যাত্মিকতা; কেউ ভাষা খুঁজলেন কালী ঘাটের পটে। কোনো পথেই দিশা পেলেন না জয়নুল।
পুরাণ ও ইতিহাসের ধূসর পৃথিবীর রঙিন চিত্র থেকে তিনি নেমে এলেন মাটির পৃথিবীতে। প্রকাশ উন্মুখ পর্বে বাস্তবতা হলো জয়নুলের ছবির বিষয়। তারই মধ্য দিয়ে ১৯৪৩ সালে বাঙালির চিত্রকলায় সংযোজিত হলো ভিন্ন কণ্ঠস্বর। ক্ষুধা ও শিল্পকে একীভূত করলেন তিনি।
বাংলা অঞ্চলে তখন মন্বন্তরের দুর্ভোগ। পথে পথে শরণার্থীদের ভিড়। গ্রাম থেকে শহরে ঢুকছে মানুষ। ভাগাড় আর আবর্জনার স্তূপে একই সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ ও পশু। দুর্ভাগ্যময় এই সময়ে আলোড়িত হয়েছিলেন অনেক কবি, লেখক, শিল্পী। ‘নয়নচারা’র মতো গল্প লিখেছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, বিজন ভট্টাচার্য লিখেছিলেন ‘নবান্ন’র মতো নাটক। এসব রচনা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ, সন্দেহ নেই। কিন্তু সম্ভবত সে কালের সমস্ত সাহিত্যকে ছাড়িয়ে গিয়েছে জয়নুলের আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবি।
মুহূর্তেই ছবিগুলো দর্শককে টেনে নেয়। এক ধাক্কায় পাঠিয়ে দেয় রূঢ় বাস্তবে। ছড়িয়ে দেয় মর্মান্তিক সংবেদনা। কঙ্কালসার অর্ধনগ্ন ক্ষুধার্ত মানুষ। একজন চুমুক দিচ্ছে খাবারের থালায়। অন্যজন অপলক তাকিয়ে আছে হাত বাড়িয়ে। তিন দিকে ছড়ানো তিনটি কাক। একটি খাবার খুঁজছে। অন্য দুটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অপেক্ষমাণ—যদি কিছু মেলে।
বিখ্যাত ‘ম্যাডোনা’ ছবিটিতে মৃত মায়ের স্তনের ওপর লুটিয়ে পড়েছে শিশু। শূন্য থালায় মায়ের হাত। আরেক ছবিতে মাটিতে শায়িত একজন। শিথানের কাছে খাবারের শূন্য পাত্র। অন্যজন চিন্তামগ্ন, কিংবা অবসন্ন। অন্য একটি ছবিতে দেখা যায়, হেঁটে যাচ্ছে শরণার্থী দুজন মানুষ। একজনের কোলে রুগ্ন শিশু। প্রতিটি মানুষের অবয়ব মাংসহীন। তুলিতে আঁকা এই ড্রইংগুলোর কোনোটিতেই মানুষের মুখ স্পষ্ট নয়। শরীর ভেঙে গেছে। অবশেষ রূপে টিকে আছে দেহের ভেতরের একগুচ্ছ হাড়।
মন্বন্তরে আঁকা ছবিগুলোতে সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্যপট ধারণ করে আছে শিশু ও নারীর অবয়ব। হয়তো সচেতনভাবেই জয়নুল মা ও শিশুর ভঙ্গুর ফিগারগুলো এঁকেছেন। মন্বন্তর শুধু নয়, মানব সভ্যতার ইতিহাসে ক্ষমতা, পুঁজি ও যুদ্ধ বহু শতাব্দী ধরে নারী ও শিশুকে নিয়ে গেছে ধ্বংসের দুয়ারে। কিংবা এমনও তো ভাবা যায়, বহুবর্ষ জুড়ে শোষিত দেশমাতার শরীর যখন অন্নের জোগান দিতে ব্যর্থ, তখন তার শীর্ণ সন্তানরাও মৃতপ্রায়। জয়নুলের আঁকা হাড়গুলো দুইশো বছরের ঔপনিবেশিক শোষণের প্রতীকী বাস্তবতা যেন।
ঔপনিবেশিক শাসন ও ইতিহাসের তীব্র সমালোচনা এইসব ছবি। সভ্যতা ও কল্যাণের জয়গাঁথার প্রচারণা চালালেও ঔপনিবেশিক গোষ্ঠী ছিল মূলত আধিপত্যবাদী শক্তি। ব্রিটিশ শাসনকালে আধিপত্যের শক্তি নানা রূপে প্রকাশ পেয়েছে। তেতাল্লিশের মন্বন্তর তারই একটি চেহারা।
একই ধরনের মন্বন্তর ঘটেছিল ১১৭৬ সালে। এই দুই ভয়াল রূপ ছাড়াও অজস্র দুর্ভিক্ষের জন্ম দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসন। এ কারণে জয়নুলের ছবিগুলো ক্ষুধা ও দারিদ্র্য পীড়িতের জীবন অখ্যানের চিত্ররূপ হয়ে দাঁড়ায়। তার পূর্বসূরিরা এভাবে দেশকে দেখেননি। তাদের চোখ ছিল রঙ তুলি রেখায় আঁকা স্বপ্নাচ্ছন্ন কল্পনায়। সৌন্দর্যের শিল্পায়িত অনুভব ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য ছিল শিল্পীদের। জয়নুল আঁকলেন ক্ষুধার শিল্প। পুরাণ ও ইতিহাস নির্ভর বঙ্গীয় চিত্রকলায় এগুলো একেবারেই নতুন ভাব ও আঙ্গিক।
কিন্তু এই একমাত্রিক রূপায়ণেই কি হারিয়ে গিয়েছে জয়নুলের ছবি? নাকি আছে অন্য কোনো জগৎ? প্রকৃতপক্ষে সামাজিক বাস্তবতা ও মন্বন্তরের আলোকে জয়নুলের চিত্রপাঠের একটি সমস্যা আছে; কারণ এই বিবেচনায় জয়নুলের ছবি হয়ে পড়ে সাময়িক এবং স্থান কাল ইতিহাস নির্দিষ্ট ব্যাপার মাত্র। কিন্তু এক ধারার ছবি তিনি আঁকেননি। প্রথম পর্যায়ে বাস্তবতাবাদী ঘরানায় ছবি আঁকলেও, নিখাদ সৌন্দর্যের অনুভূতি সৃষ্টিতে জয়নুল কম পারঙ্গম ছিলেন না।
দেখতে পাই, তেলরং, জলরং, গোয়াসে আঁকা ছবিগুলো আলোচনার দ্যুতি পায় কম। ঋতু বৈচিত্র্য ও প্রকৃতির প্রতি জয়নুলের বাড়তি মনোযোগ লক্ষ্য করা যায় এ ধারার ছবিতে। মন্তন্বরের কালেই জয়নুল এঁকেছিলেন ‘নববধূ’; লাল-হলুদে মেশা ছবিটিতে লাল রঙের প্রাধান্য দেখা যায়। সবচেয়ে লক্ষ্যযাগ্য দিক হলো এই যে, ছবির বধূটি হাঁটুতে দুই হাত মুড়ে হাঁটুর ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে কি জাগ্রত, না কি স্বপ্নগ্রস্ত? নাকি মন্বন্তরের ক্ষুধা ও মৃত্যু বিবাহের উজ্জ্বলতায় ভয়ের প্রতীক হিসেবে এলো লাল রং? দর্শকের সামনে ছবিটি ঝুলিয়ে দেয় নান্দনিক দ্বিধা।
১৯৪৮ সালে জয়নুল এঁকেছেন ‘চেয়ারে পাঠরতা কিশোরী’। হলদে খয়েরি রঙের সোফায় বসে বই পড়ছে কালো চুলের কিশোরী। হালকা সবুজাভ দেওয়াল। ছবিতে আছে চিন্তামগ্ন পাঠকের স্থিরতা।
নদীর পটভূমিতে ১৯৫১ সালে এঁকেছেন ‘জেলে নৌকা’। তটরেখা জুড়ে সারি সারি নৌকা। একই বছর এঁকেছেন ‘কালবৈশাখী’ নামের ছবিটি। হলদে খয়েরি রঙের ঝড়ো হাওয়ায় ছুটে যাচ্ছে দুটো মানুষের ফিগার। ঝড় থেকে নিজেদের রক্ষা করতে খানিকটা কুঁজো হয়ে গেছে শরীর। বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ ছবিটিও এঁকেছেন সেই বছর। দড়ি ছিঁড়ে ছুটে যেতে চাইছে একটি গাভী। দৃপ্ত তার ভঙ্গি। এটিও জলরঙে আঁকা ছবি। সে বছরই পাওয়া যাচ্ছে ‘সাঁওতাল দম্পতি’, ‘সংগ্রাম’ ইত্যাদি।
১৯৫৩ সালে বেশকিছু দৃষ্টি সুখকর ছবি এঁকেছেন জয়নুল। ‘দুই রমণী’, ‘পাইন্যার মা’, ‘গুনটানা’, ‘রমণী’ ইত্যাদি। ‘গুনটানা’ ছবিটিকে বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে। কারণ সেই নদীও নেই, নদীপথ ও গুনটানা তাই অবান্তর অনুষঙ্গ। যদিও এক সময় নদীকেন্দ্রিক জীবনযাত্রার প্রতিদিনকার অংশ ছিল গুনটানা। সে কারণে হারিয়ে যাওয়া এই দৈনন্দিনতার শৈল্পিক ডকুমেন্টেশন জয়নুলের ‘গুনটানা’। এই সময়ের বাকি সব ছবিতে প্রাধান্য পেয়েছে নারী—প্রত্যেকেই গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতিনিধি।
‘পাইন্যার মা’ নামটিই শিল্পভোক্তাকে নিয়ে যায় গ্রামের লৌকিক জীবনে। ‘দুই রমণী’ ছবিতে দুই নারী যেন পরস্পরের প্রশ্নাতীত নির্ভরতা। ‘রমণী’ ছবিতে পাওয়া যাচ্ছে জ্যামিতিক নকশায় সাজানো নারী। এই পর্বে এসে জয়নুল হাতে তুলে নিয়েছেন আধুনিক চিত্রকলার ভাষা। ১৯৭২ সালে এঁকেছেন ‘বিমূর্ত বিন্যাস’, ১৯৭৬ এ পাওয়া গেল ‘স্নানরত’।
পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোতে জয়নুল জাতীয়তাবাদকে মান্য করেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি তখনো তার ছবির কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠেনি। এমনকি তার চিন্তার কেন্দ্রেও ছিল না পূর্ববাংলা কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ। তার প্রমাণ ১৯৬৩ সালে জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি প্রতিষ্ঠা বিষয়ক একটি লেখা।
লাহোর থেকে প্রকাশিত The Civil and Military Gazette সংকলনে A Case for Museums and Art Galleries লেখাটিতে জয়নুল লাহোর, করাচি ও ঢাকায় জাতীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ঐতিহ্যমণ্ডিত শিল্প, ঐতিহ্যিক শিল্পবস্তু সংরক্ষণ, জাতীয় সত্তার প্রসঙ্গ টেনেছেন।
জয়নুলের এই ‘জাতীয় সত্তা’ তখনো বাঙালি পরিচয় গ্রহণ করেনি। মূলত শিল্পবস্তু সংরক্ষণ ও জাতীয় সত্তা গঠন ছিল তার মূল ভাবনার বস্তু। শিল্পকে তিনি দেখেছেন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যম হিসেবে। জয়নুল বলেছেন, ‘যেকোনো আন্তর্জাতিক আসরে আমার নিজের জাতীয় সত্তাই আমার পরিচয়। সেখানে আমি আমার জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে বিশিষ্ট।’
এই ভাবনার বশেই তিনি অনুকরণ ও আত্তীকরণকে আলাদা করেছেন। জয়নুলের চোখে আত্তীকরণ নান্দনিক ও নীতি সম্মত আচরণ। কিন্তু এই উপলব্ধি তৈরি হবে কখন? তার মতে, নিজেদের ‘সাংস্কৃতিক ভাণ্ডার’ সম্পর্কে সচেতন হলে ‘সাংস্কৃতিক অপযোজন বা আত্তীকরণ’ সম্ভব। আর তাই ঐতিহ্যবাহী নকশা ও সাংস্কৃতিক উপাদান সংরক্ষণ করার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন তিনি।
সংরক্ষণের তিনটি প্রতিষ্ঠানের কথা ভেবেছিলেন, জাতীয় জাদুঘর, আর্ট গ্যালারি, লোকশিল্প জাদুঘর। এই সবকিছুর মূলে নিহিত উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর এক প্রতিনিধি হিসেবে স্মৃতির পুনরুদ্ধার করা। জাদুঘর ও গ্যালারি স্মৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের প্রধান কেন্দ্র। অতীতের প্রতিচ্ছবি আকারে জাদুঘরে সঞ্চিত হয় বস্তুগত সংস্কৃতির নানা উপাদান। গ্যালারিতে প্রদর্শিত ও সংরক্ষিত হয় নান্দনিক চিত্র ও ভাস্কর্য।
উপনিবেশিতের স্মৃতি সঞ্চয়ের স্থান হিসেবে এ দুটির তাৎপর্য বুঝতে পেরেছিলেন জয়নুল। এ কারণে প্রশ্ন তুলেছেন বিদেশিদের মধ্যস্থতায় দেশের শিল্পকলার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রবণতার বিষয়ে। বিদেশিদের হাতে সাংস্কৃতিক সম্পদ তুলে দেওয়ার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন প্রবল অনিচ্ছুক।
জাতীয়তাবাদ ও আত্মপরিচয়ের লড়াইয়ে জয়নুলের শিল্প সংরক্ষণ বিষয়ক প্রস্তাবনাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। যদিও জয়নুল খুব কম ছবিতেই রাজনৈতিক মতাদর্শ ও চিন্তার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পর জয়নুল এঁকেছেন দীর্ঘ পটচিত্র ‘নবান্ন’। এই প্রথম জয়নুলের জাতীয়তাবাদ বাঙালির রাজনৈতিক বাসনার সঙ্গে মিশে গেল।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি বর্জন করেছিলেন পাকিস্তানি পদক, অংশ নিয়েছিলেন রাজনৈতিক সমাবেশে। ১৯৭১ সালে তার ছবিতে অনিবার্য হয়ে এলো ‘মুক্তিযোদ্ধা’। মুক্তিযুদ্ধের পর তারই তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানের অলংকরণ।
জয়নুলের সামগ্রিক এই শিল্পযাত্রাকে বলা যায় উপনিবেশিত বাঙালির আত্মপরিচয় অনুসন্ধান ও প্রতিষ্ঠার ইতিহাস; না তিনি উপনিবেশিত আধার ও আধেয়কে বাদ দিয়েছেন, না তিনি আমূল মগ্ন থেকেছেন ইউরোপীয় আধুনিকতায়। আদর্শের সংকট বা দ্বিধা একে বলা যাবে না। তিনি বরং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক—দুই প্রবাহেই ভাসতে চেয়েছেন। দু’দিক থেকেই এসেছে তার রং ও রেখার ভাষা। যেমন করে ঔপনিবেশিক সময়পর্বে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠী নিমজ্জিত হয়েছে আত্ম ও অপরের টানাপড়েনে; একই সঙ্গে নির্মাণ করেছে জাতীয় চেতনা কিংবা জাতীয়তাবাদ। জয়নুল আবেদিনও বুঝে নিয়েছেন আধুনিকতার সংকটে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার তাৎপর্য। মূলত জয়নুলের চিত্রকলা বাংলাদেশের জাতিক, সাংস্কৃতিক, আঞ্চলিক ও ঐতিহ্যিক পরিচিতিকে প্রকাশ করে।
লেখক: সুমন সাজ্জাদ – অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।