1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বিজয়ের উল্লাসে জন্মযুদ্ধ

ফনিন্দ্র সরকার : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শনিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২২

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের বিজয় অর্জিত হয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে যে বিজয় আমরা দেখেছি তা বিস্ময়কর ঘটনা হলেও সুদীর্ঘ দিনের লালিত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে আন্দোলন করতে হয়েছে বহুকাল ধরে। এ আন্দোলনের বাঁকে বাঁকে অনেক নেতার উপস্থিতি ইতিহাসে সাক্ষ্য দিলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই সফল পরিণতি ঘটে।

যে নয় মাস যুদ্ধ হয়েছে সেটি ছিল সশস্ত্র যুদ্ধ; মূলতঃ যুদ্ধটি কেবল নয় মাসের ছিল না; ইতিহাসের পরতে পরতে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে রক্তের দাগ লেগে আছে। তবে নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হয় প্রায় ত্রিশ লাখ বাঙালি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিংশ শতাব্দীর বিরাট এক মানবসৃষ্ট দুর্যোগ নেমে আসে বাঙালির ওপর। স্বাধীনতার পথে মানবতার জন্য এক সর্বোত্তম বিজয় অর্জিত হয়। সীমাহীন বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি তার ভাগ্য গড়ার প্রচেষ্টায় যে সম্মিলিত আত্মদান করেছিল তা গোটা বিশে^র মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সহানুভূতি ও সাহায্যের বন্যা বয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। এ সাহায্য আর সহানুভূতি সক্রিয় রাজনৈতিক ও বাস্তব সমর্থন থেকে শুরু করে হৃদয়গ্রাহী বদান্যতাও স্থান পেয়েছিল। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশের সাহায্যার্থে পপ তারকাদের সংগীতানুষ্ঠান, আফ্রিকার ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য যেমন ত্রাণ তৎপরতার এক আদর্শ ছিল তেমনি আদর্শ হিসেবে ওই অনুষ্ঠানটি বিবেচিত হয়েছিল। অথচ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করেনি। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের অসংখ্য জীবন উৎসর্গের কোনো তুলনা মেলে না। প্রতিটি বাঙালির হৃদয় সামাজিক ঐক্যের অনুভূতিতে তাড়িত হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার গল্প বিশ^ ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া বিরল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নামের জাদুস্পর্শে বাঙালি হয়ে উঠেছিল সম্পূর্ণরূপে ভয়হীন। নির্ভীক হৃদয়বেত্তার সমন্বয় ঘটিয়ে প্রায় প্রতিটি বাঙালিই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ে; এদিনই প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের প্রাক্কালে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। যে ঘোষণাপত্রটি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়। ইতিহাসে এ ঘোষণা নিয়ে নানা বিতর্ক বিদ্যমান রয়েছে, যা খুবই দুঃখজনক। ঘোষণাপত্রটি প্রথমে পাঠ করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম হান্নান। এরপর আরও অনেকেই ঘোষণাপাঠ করলেও সর্বশেষ ২৭ তারিখে তৎকালীন মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা পত্রটি পাঠ করেন। রাজনৈতিক বিপজ্জনক ঘটনা প্রবাহে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক বনে যান একশ্রেণির কাছে যা ইতিহাস বিকৃতির শামিল। এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। এ নিয়ে আলোচনা করতে চাই না আজ। আমি যুদ্ধের কথায় আসি।
২৫ মার্চের রাত থেকে গণহত্যা শুরু হয়। রাজধানী ঢাকার মানুষ দলে দলে প্রাণ বাঁচাতে গ্রামের দিকে ছুটে যায়। বিভিন্ন জেলা শহরে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর আক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। ভারত মানবিক কারণে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ১ কোটি বাঙালিকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ নানারকম সাহায্য করতে থাকে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও ভারতে প্রবেশ করে যুদ্ধ কৌশল ঠিক করতে থাকে। ভারত নীতিগতভাবে আমাদের সহযোগিতা করলেও প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়াতে বেশ সময় নেয়। আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়া অণুসরণ করে ধীরে সুস্থে অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবে কীনা এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে। এদিকে বাঙালির ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ভারত অসংখ্য বাঙালিকে আশ্রয় প্রদান ও নানারকম সাহায্যের কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক উস্কানি নিয়ে বাঙালি জাতিকে বিভাজন করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র হিসেবেই প্রচার করতে থাকে। যার ফলে জুলাই-আগস্টের দিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্মম নির্যাতন শুরু করে দেয়। বিভিন্ন মন্দির হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে নারীদের সম্ভ্রম হানিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সীমাহীন বর্বরতার পরিচয় দেয়। যুদ্ধের আইনকানুন উপেক্ষা করে যে নৃশংস হত্যাকান্ড সংঘটিত করে তা ছিল রীতিমতো মধ্যযুগীয় বর্বরতা। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুক্ত হয় এ দেশীয় কিছু মানুষ, যারা সুযোগ বুঝে হিন্দু সম্প্রদায়ের সহায় সম্পদ লুটে নেয়। আগস্ট থেকে ১৬ ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত ভয়ঙ্কর বিপন্ন জীবন অতিবাহিত করছিল হিন্দু সম্প্রদায়। ইতিহাসে এ সত্যকে আড়াল করার অপচেষ্টা নিন্দনীয় অপরাধ। জীবন বাঁচাতে হিন্দুদের কলেমা শিখতে হয়। পাকিস্তানি সেনারা যে সকল বাঙালিকে ধরে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যেত তাদের পরিচয় শনাক্তে বিবস্ত্র করে পৈশাচিক আচরণ ছিল উল্লেখ করার মতো।

এদিকে ভারতে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী। মুক্তিবাহিনী ভারত থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করে। গঠিত হয় ৯টি সেক্টর। এই সেক্টরগুলোর অধীনেই জনযুদ্ধ পরিচালিত হয়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারত সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে অংশ গ্রহণের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় এর আগেই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীই প্রথমে ভারতে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তানি বিমান থেকে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে এয়ারফিল্ডগুলোতে বোমা বর্ষণ করা হয়। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা সফরে ছিলেন।

শুরু হয়ে যায় ভারতপাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ। মাত্র ১৩ দিনের মাথায় পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্থনে বাধ্য করা হয়। এর আগে নানা নাটকীয় ঘটনার জন্ম হয়। সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

যুদ্ধ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। অত্যন্ত কৌশলী সেনা কর্মকর্তা আরোরা রণকৌশলে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ভারতীয় মিত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত রাজধানী ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা তাদের দপ্তরে বৈঠক করছিলেন। এ সময় একটি চিরকুট এসে সবাইকে চমকে দেয়। বৈঠকে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল একে নিয়াজি, মেজর জেনারেল জামশেদ, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, রিয়ার এডমিরাল শরিফ, ব্রিগেডিয়ার আবু বকর সিদ্দিকী, সিদ্দিক মালিকসহ আরও কয়েকজন। চিরকুটে লেখা ছিল, ‘প্রিয় আব্দুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।’ এখানে ‘আব্দুল্লাহ, বলতে জেনারেল নিয়াজিকে বোঝানো হয়েছে। নিয়াজির পুরো নাম ছিল- আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি, যিনি একে নিয়াজি হিসেবে পরিচিত। চিরকুটটি পাঠিয়ে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরা। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টা নাগাদ ঢাকার মিরপুর ব্রিজের কাছে মেজর জেনারেল নাগরাকে বহনকারী একটি সামরিক জিপ এসে থামে। জেনারেল নাগরা কীভাবে ঢাকার প্রবেশমুখে এসে পৌঁছেন সেটি সবাইকে বিস্মিত করেছিল। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা বুঝে গিয়েছেন তাদের দিন শেষ। রাও ফরমান আলী ওই চিরকুট দেখে ভেবেছিলেন যুদ্ধ বিরতির বার্তা এটি। তিনি জেনারেল নিয়াজিকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তিনি কি (নাগরা) আলোচনার জন্যে এসেছেন’। নিয়াজি কোনো উত্তর দিলেন না।

এর আগে পাকিস্তানের তরফ থেকে ভারতের কাছে যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। সে প্রস্তাবের আলোকে জেনারেল আরোরা পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের শর্ত দিয়েছিল। শর্ত মোতাবেক ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণের দলিল সম্পাদিত হয়। এখানে যে দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছিল তা হচ্ছে বাঙালিরা সচক্ষে দেখুক তারা সত্যিসত্যি স্বাধীনতা লাভ করেছে। এখানে আরেকটি মজার ঘটনা হচ্ছে- আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল আরোরা তার স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। তার যুক্তি ছিল- পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী বাঙালি নারীদেরও অমর্যাদা করেছে; নারীর মর্যাদা সমুন্নত রাখতে প্রতীক হিসেবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আরোরা তার স্ত্রীকে উপস্থিত রেখেছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধানের অনুমতি সাপেক্ষে।

আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে গোটা বাংলাদেশ উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল বাংলার আকাশ-বাতাস। সে এক অন্য উল্লাস। স্বপ্নের সোনার বাংলা স্বাধীন হয়েছে। বাঙালি ফিরে পেয়েছে তার রাজনৈতিক অধিকার। স্বজন হারানোর বেদনাকে ভুলে গিয়ে গোটা বাঙালি ঐক্যে লীন হয়েছে দীপ্ত সংস্কৃতির অঙ্গনে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি আমরা। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, এখনও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির চোখ রাঙানি প্রত্যক্ষ করতে হয় আমাদের। বিজয়ের এই একান্ন বছরে বাঙালি জাতিকে আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে অপশক্তি প্রতিহত করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। অন্যথায় স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে যাবে। যুদ্ধ বিজয়ের তাৎপর্য যেন অর্থহীন হয়ে না পড়ে। সততার সঙ্গে সৎ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীনতার ভিত্তিকে মজবুত করাই এখন প্রধান কাজ।

লেখক : ফনিন্দ্র সরকার – রাজনৈতিক বিশ্লেষক


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ