1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

মালদ্বীপের অভাবনীয় উন্নতি সহযোগিতার অপার সম্ভাবনা

তপন কুমার দাশ : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২২

মহাসাগরের বুকে জেগে ওঠা প্রায় ১২শত দ্বীপ নিয়ে গঠিত অনিন্দ্য সুন্দর এক দেশ- যার নাম মালদ্বীপ। সাগরের জলে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এবং দৃষ্টিনন্দনভাবেই জেগে উঠেছে এখানকার দ্বীপসমূহ। একটি নির্দিষ্ট এলাকার জলরাশিকে মাঝখানে রেখে তার চারপাশে জেগে উঠেছে পাঁচ-সাত্‌-দশটা বা তারও বেশি সংখ্যক দ্বীপ- যা দেখতে কিছুটা দূরত্ব রেখে পাথর বসানো হাতের চুড়ি বা বালার মতো। এ দ্বীপগুচ্ছ নিয়েই গড়ে উঠেছে এক একটি ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক এলাকা, যাকে বলা হয় ‘এটল’। এ এটলগুলোও আবার সারিবদ্ধভাবে সাজানো। সবগুলো এটল নিয়ে সাজানো মালদ্বীপের ভৌগোলিক অবয়ব বা মানচিত্র অনেকটা নিচের দিকে ঝুলে পড়া মালার মতো। এ রকম বাইশটির মতো এটল আর শত শত দ্বীপ নিয়েই গঠিত এই স্বপ্নের দেশ, সাগরস্বর্গ মালদ্বীপ।

মালদ্বীপের বিমানবন্দরটি ভেলেনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামে পরিচিত। ‘হুলুস্থূল’ নামক একটি আলাদা দ্বীপে নির্মিত এ বিমানবন্দরে অনেক দেশ থেকেই বিমান আসে। ইন্ডিয়ান, শ্রীলঙ্কান, চায়নিজ, কোরিয়ান, এমিরাটস্‌ এবং তার্কিস বিমানের পাশাপাশি মালদ্বীপ এয়ারলাইন্সের দু’তিনটি বিমানও এখন পালস্না দিয়ে ছুটছে উত্তরে-পশ্চিমে। তবে যারাই যে দেশ থেকে আসুন না কেন, নামতে হয় এই বিমানবন্দরেই। বিমান থেকে নেমে অন্য যে কোনো দ্বীপে যাওয়ার জন্য একসময় বোটে উঠতে হতো। তবে ২০১৯ সালে এ বিমানবন্দরটি সংযুক্ত হয়েছে সড়কপথে রাজধানী শহর মালে এবং হুলেহ্‌মালে দ্বীপের সঙ্গে, চীনা সহায়তায় নির্মিত সিনোমালেহ্‌ ব্রিজের মাধ্যমে।

মালদ্বীপের মূল ভূখন্ড বা রাজধানী শহর মালে হলো কাফু এটল বা জোনের মধ্যেকার একটি দ্বীপ। এখানেই রয়েছে রাজভবনসহ সব মন্ত্রণালয়, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ব্যবসাবাণিজ্য ইত্যাদি। বিমান থেকে নেমে ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যেই মালে পৌঁছা যায়।

বিগত দুই দশকে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে এ দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে। শিক্ষায় এবং অর্থনীতিতে এ উন্নয়ন ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। মালদ্বীপের জনসংখ্যা বর্তমানে ৪ লাখের মতো। যার মধ্যে প্রায় শতভাগ লোকই লেখাপড়া জানে। তারা প্রায় সবাই লন্ডন বিশ্ববদ্যালয় কর্তৃক স্বীকৃত দশম শ্রেণির শিক্ষামান সম্পন্ন। অনায়াসেই এসব শিক্ষার্থী বিলেতে গিয়ে ক্যামব্রিজসহ যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারে। এ দেশে এক বছরের জন্য দিবেহি ভাষা শিক্ষা সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক। তারপরই তারা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করে। তবে, সব শিক্ষার্থীকেই কোরানিক শিক্ষাও গ্রহণ করতে হয়।

ক্যামব্রিজের শিক্ষাক্রম অনুসরণে ইতোমধ্যে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত মালদ্বীপের নিজস্ব শিক্ষাক্রম প্রণীত হয়েছে এবং অচিরেই তা আরো বিস্তৃত হবে বলে আশা করা যায়। তবে এখন পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ক্যামব্রিজ নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ড অর্জন করেই সনদপত্র পেতে হয়। মূলত মালদ্বীপের গতানুগতিক মক্তব এবং মাদ্রাসাগুলোকে আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সমন্বিত করে ১৯৬০ সালে সেখানে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার পত্তন করা হয়। ধাপে ধাপে অনেক অগ্রগতি সাধনের পর ১৯৭৮ সালে এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা একীভূত হয় এবং কাঠামোধীন রূপ লাভ করে। ৫ বছরের প্রাইমারি এডুকেশন, ৩ বছরের জুনিয়র সেকেন্ডারি এডুকেশন এবং ২ বছরের সেকেন্ডারি এডুকেশন শেষে এখানকার শিক্ষার্থীরা ১ম গ্রেড শেষ করেই কেমব্রিজভিত্তিক এড-এক্সেল-জিসিই (ঊউ-ঊঢঈঊখ-এঈঊ) এবং এডভান্স্‌ লেভেল-এর যোগ্যতা অর্জন করে। লন্ডন-এর শিক্ষার সঙ্গে সমতাস্থাপক এ শিক্ষা মালদ্বীপের সব নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক।

এ দেশের শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার কমানোর জন্য একটি চমৎকার ব্যবস্থা হচ্ছে স্কুল হ্যাপিনেস প্রোগ্রাম। এ প্রোগ্রামের আওতায় সপ্তম গ্রেড শেষ করেই শিক্ষার্থীরা নিজ পছন্দমতো বিষয় নির্বাচনের সুযোগ পায়। এ কর্মসূচি থেকে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা ভোকেশনাল বিষয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার ওপর প্রশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়। কলা ও বিজ্ঞানের নানা শাখাসহ টু্যরিজম, হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি নানা বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ রয়েছে স্কুল হ্যাপিনেস প্রোগ্রামে।

জামালুদ্দিন স্কুল, ইমামুদ্দিন স্কুল, মুজিদিয়া স্কুল কিংবা রেহেন্দি স্কুলসহ মালদ্বীপের অধিকাংশ স্কুলেরই একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে ক্রিয়েটিভ এডুকেশন। শ্রণিকক্ষভিত্তিক কাজ ও শ্রেণিকক্ষের বাইরের কাজ, যেমন : স্কুলের বারান্দায়, খোলার মাঠে, আউটডোরে বা সমাজভিত্তিক কাজের মাধ্যমেই নিশ্চিত হয় সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা। দেশের মূল দর্শন ইসলামী ভাবধারায় উজ্জীবিত, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্ব মানের যোগ্যতাসম্পন্ন বিশ্ব নাগরিক তৈরি করাই এসব স্কুলের অন্যতম উদ্দেশ্য।

এখানে প্রায় প্রতিটি স্কুলেরই রয়েছে নিজস্ব ভিশন, মিশন, মটো ও কর্মকৌশল। সরকারি নির্দেশনা মেনে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় স্কুলের নিজস্ব কর্ম-পরিকল্পনা। আর এতে করেই সম্ভব হয় সততা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয়।

পাশাপাশি, বিগত দুই দশকে ঘটে যাওয়া মালদ্বীপের আর্থিক উন্নয়ন অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। মালদ্বীপের মাথাপিছু আয় ছাড়িয়েছে ১৯ হাজার ডলার। অনেকের কাছেই প্রশ্ন, কি করে এটা সম্ভব হলো! মূলত ১৯৪৮ সালের দিকে মালদ্বীপে রাজতন্ত্রের বিলোপ হলেও আধুনিক শাসন ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে ২০-২৫ বছর আগে। সে থেকেই দ্রম্নত বদলে যেতে থাকে মালদ্বীপের অর্থনীতি। এর অন্যতম কারণ মৎস্য আহরণ ও রপ্তানি ব্যবস্থার সম্প্রসারণ। পাশাপাশি টু্যরিজম শিল্পেরও ব্যাপক বিকাশ ঘটে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয় তেমনি টু্যরিস্টদের কাছ থেকে আসতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণও দিন দিন বাড়তে থাকে।

২০১৬ সালের হিসাবে দেখা যায়, প্রায় দেড় মিলিয়ন পর্যটক এসেছে মালদ্বীপে। আর পর্যটন খাতে দেশটির বাৎসরিক আয় হয় প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন ডলার। যা তাদের জিডিপিতে একটি বড় ধরনের জোগান। এ আয় দিন দিন আরো বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। কারণ সত্তরের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে মাত্র তিনটি রেসোর্ট নিয়ে মালদ্বীপ টু্যরিজমের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে দেশে আন্তর্জাতিক মানের রেসোর্টের সংখ্যা প্রায় ১৬৬ মতো। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এ মালদ্বীপে এমন অনেক রিসোর্ট রয়েছে, যেগুলো এক একটি আলাদা দ্বীপ। একবারেই নির্জনে সময় কাটাতে চান এমন টু্যরিস্টরা এসব রিসোর্ট খুবই পছন্দ করে। দিন দিনই বাড়ছে এমন লাক্সারিয়াস রিসোর্টের সংখ্যা। এটা ঠিক যে, মালদ্বীপের মূল ভূখন্ড ডুবে গেলেও নানা দ্বীপেই থেকে যাবে অনেক রেসোর্ট। এ দ্বীপগুলো তৈরি হচ্ছে সেভাবেই।

সম্প্রতি করোনাকালে মালদ্বীপে সম্পূর্ণ নিরাপদে থেকে অবকাশ কাটানোর জন্য একটি প্রাইভেট দ্বীপ উদ্বোধন করা হয়েছে। প্রায় বত্রিশ হাজার বর্গমিটার আয়তনের ‘ইথাফুসি-দ্য প্রাইভেট আইল্যান্ড’ নামের এই দ্বীপে রিসোর্টের সঙ্গে রয়েছে ভাসমান বাগানবাড়ি, ভাসমান সুইমিং পুল, স্পোর্টস, ডাইভিং, ফিসিংসহ বিনোদনের সব ব্যবস্থা। চব্বিশ জনের মতো অতিথির থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এই দ্বীপে। আর একদিন কাটানোর জন্য সব মিলিয়ে এখানে ভাড়া গুণতে হয় কমবেশি প্রায় ৮০ হাজার ডলার।

এরই মধ্যে চাকরির খোঁজে মালদ্বীপ চলে এসেছে এক লাখের ওপরে বাংলাদেশি যুবক। এদের অধিকাংশই অবৈধভাবে মালদ্বীপে আসা এবং অদক্ষ শ্রমিক। হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাজ করা, বোট চালনা, মাছ ধরা, দোকান কর্মচারী ইত্যাদি নানা কাজে তারা নিয়োজিত। মালদ্বীপের প্রায় সব দ্বীপেই বাঙালিদের কাজ করতে দেখা যায়। তবে মালদ্বীপের অনেকেই মনে করেন অবৈধ পথে চাকরির সন্ধানে বাংলাদেশ থেকে আর একজনেরও মাল্বীপে আসা উচিত নয়।

এতদিন পর্যন্ত ভারতের একচেটিয়া প্রভাব ছিল মালদ্বীপের বাজারে। বর্তমানে চায়না, মালয়েশিয়া ও থাই পণ্যসামগ্রীও পাওয়া যাচ্ছে সর্বত্রই। মালদ্বীপের বাজারে বাংলাদেশের ওষুধ, রেডিমেড গার্মেন্ট্‌স, প্রসাধনী ইত্যাদি সামগ্রীর প্রবেশের চমৎকার সম্ভাবনা রয়েছে। চিকিৎসকদের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রকৌশলী, দক্ষকর্মী এবং শিক্ষকদেরও মালদ্বীপে কাজ করার সম্ভাবনা তৈরি করা যেতে পারে। উচ্চশিক্ষার জন্য মালদ্বীপের শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশে আসার পথও প্রশস্ত করা যেতে পারে। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশেও মালদ্বীপের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে।

প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মালদ্বীপ সফরের মাধ্যমে ঢাকা মালের মধ্যে সহযোগিতা ও সম্ভাবনার দ্বার নতুনভাবে উন্মুক্ত হবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

লেখক : তপন কুমার দাশ, শিক্ষা ও উন্নয়ন কর্মী।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ