1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

কলঙ্কিত ৭ নভেম্বর : ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’

নিউজ এডিটর : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৩

আজ ০৭ই নভেম্বর। কলঙ্কিত “মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস”।
৪৮ বছর আগের আজকের এই বিভীষিকাময় দিনটিতে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সূচনা ঘটেছিলো।

নগ্ন বিভৎসতায়, বেপরোয়া দম্ভে শুরু হয়েছিলো “বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধপন্থী সৈনিকদের” হত্যা করার প্রথম মিশন, যার আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়েছিলো ” সিপাহী জনতার বিপ্লব”! হায় সিপাহী জনতার বিপ্লব! সিপাহী মারা বিপ্লব, জনগণের আতঙ্কে ঘরবন্দীত্বের বিপ্লব, তার নাম সিপাহী জনতার বিপ্লব!প্রকৃত পক্ষে আজকের দিনটিতে ৪৮ বছর আগে খুব নিপুণ কৌশলে, সুচারু দক্ষতায় নেপথ্যের কারিগরেরা শুরু করেছিলো তাদের ভয়াবহ এক নীলনকশার দ্বিতীয় পর্যায়টির বাস্তবায়ন।

৭৫-৯০ পর্যন্ত’র সামরিক শাসন আর ৯০ পরবর্তীতে বিকৃত ইতিহাসের প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারণার কালস্রোতে আজকের প্রজন্ম সে কালো ইতিহাস সম্পর্কে অনেকটাই নাওয়াকিফ।
তা হওয়াটাই স্বাভাবিক।

যে প্রজন্ম আশৈশব ০৭ই নভেম্বরকে ঘটা করে পালিত হতে দেখেছে ” মহান বিপ্লব ও সংহতি দিবস” হিসেবে তাদের না জানাই স্বাভাবিক এই “মহান বিপ্লবের” সামরিক বুটের নীচে চাপা পড়ে আছে কত অভাগার লাশ।

আজকের লেখাটি প্রজন্মের সেই অংশের জন্যে, মিথ্যের জয়জয়কারের দিনগুলোতে শৈশব কাটানো যারা সেই হতভাগাদের সম্পর্কে জানেন না, জানেন না পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম কালো একটি দিন সম্পর্কে। অনেকে আবার জানেন একটি মহান বিপ্লবের দিন হিসেবেই!

মূলত ০৭ই নভেম্বর কোনো বিচ্ছিন্ন দিন বা ঘটনা নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট মানব ইতিহাসের যে নিকৃষ্টতম কৃতঘ্নতার ও বিশ্বাসঘাতকতার সূচনা হয়েছিলো তারই প্রাথমিক সমাপ্তি ঘটে ০৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ এ।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার মধ্য দিয়ে ভিনদেশি চক্রের দেশীয় দোসরদের যে নীল নকশার বেপরোয়া বাস্তবায়নের সূচনা, তারই দ্বিতীয় পর্যায়টি শুরু হয় এদিন। আর তার সাথে শেষ হয় সেই মহান পুরুষ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বয়ে নিয়ে এগোনোর লক্ষ্যে গড়া প্রাথমিক প্রতিরোধটুকুও।

সে ইতিহাস জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ৭৫ এর বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড পরবর্তী সময়টুকুতে, আর সাথে জানতে হবে সে সময়ের সামরিক প্রেক্ষাপটও।

৭৫ এর বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড কোনো বিচ্ছিন্ন বিপথগামী সেনা সদস্যদের আকষ্মিক উন্নাসিকতার ফলাফল নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড তৎকালীন দ্বি অক্ষ বিশ্ব ব্যবস্থায় স্নায়ুযুদ্ধকালীন ক্ষমতার লড়াইয়ের অন্যতম একটি গেম চেঞ্জিং মাস্টার স্ট্রোক ছিলো পশ্চিমাদের। আজ তা প্রকাশিত, প্রমাণিত ও স্বীকৃত।
মূলত তৎকালীন সোভিয়েত ও মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক যে ক’টি দেশ ও তাদের নেতারা ধনতান্ত্রিক অক্ষের উদ্বেগের কারণ ছিলেন তার অন্যতম ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিউবান বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো যাকে আখ্যা দিতেন হিমালয়ের সাথে, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সবচেয়ে সফল বিপ্লবটি ঘটিয়েছিলেন যে মহান নেতা, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন প্রত্যক্ষ সামরিক সহযোগীতার পরও পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয় বৈশ্বিক রাজনীতির ক্ষমতার লড়াইয়ে আমেরিকাকে নড়বড়ে অবস্থানে এনে দিয়েছিলো। আর সে সময়ে ভিয়েতনাম ইস্যুও (সোভিয়েত-মার্কিন প্রক্সি ওয়ার) মার্কিনদের ভয়াবহ মাথাব্যথার অন্যতম কারণ হয়ে ছিলো বিদ্যমান। বিশ্বের উপর আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলো ধীরে ধীরে।

দক্ষিণ আমেরিকা তার নিয়ন্ত্রণে কোনো কালেই আসেনি৷ ইউরোপে মিত্র কমেছে, বিশাল অংশ গিয়েছে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে। হাতে আসতে যাওয়া দক্ষিণ এশিয়াও (যা বিশ্বের জনগুরুত্বপূর্ণতম ভূখণ্ড) হাতছাড়া হতে বসেছে। অনুগত দেশ পাকিস্তানের দু টুকরো হয়ে যাওয়া এবং নবগঠিত বাংলাদেশের অনমনীয় আত্মনির্ভর অগ্রযাত্রা সে সময়ে মার্কিনদের শিরপীড়ার প্রধানতম উপসর্গ হয়ে প্রতীয়মান।

এমন সময়ে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাদের প্রয়োজন ছিলো একাত্তরে তাদের করে ফেলা “মারাত্মক ভুলটি” (বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়ায় বিরোধিতা করা, যা তাদের নৈতিক পরাজয় ঘটায়) নিজেদের মতো করে শুধরে নেওয়ার। অর্থাৎ সে রাষ্ট্রে বিদ্যমান সমাজতান্ত্রিক শাসনের পতন ঘটিয়ে নিজেদের অনুগতদের ক্ষমতায় এনে ব্যর্থ প্ল্যান এ’কে প্ল্যান বি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা।

সঙ্গতভাবে ধনতান্ত্রিক অক্ষের মোড়ল দেশটির পঞ্চম কলাম, তাদের নিয়ন্ত্রক গুপ্তচর সংস্থাটি, নিজেদের ষড়যন্ত্রের জাল নতুন করে সাজাতে বিলম্ব করেনি। আর এমনিতেও এসব জাল তো ছক বাঁধা নিয়মেই এগোয়।

যেকোনো বিপ্লব বয়ে চলে প্রতিবিপ্লবের ভয়াবহ সম্ভাবনা। কেননা প্রতিটি বিপ্লবই সফল হয় বিরাজমান কোনো একটি গোষ্ঠীর একাধিপত্য অর্জনের মাধ্যমে। তাই বিরাজমান অন্যান্য গোষ্ঠীর জন্যে সে বিপ্লব কেবলই নিরন্তর আত্মদহনের নামান্তর হয়ে থাকে৷ এমনটি ঘটেছে সেই ফরাসী বিপ্লবে, হালের রুশ বিপ্লবে, গণচীনের লালবিপ্লবেও।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ছিলো তদ্রুপ ঝুঁকি। একটি শোষিত বঞ্চিত অবহেলিত জনপদ, একজন ক্যারিশম্যাটিক লীডারের একার প্রচেষ্টায়, একক নৈপুণ্যে সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে, সমাজবিজ্ঞান আর পৌরনীতির সকল সূত্রকে ব্যর্থ করে দিয়ে ছিনিয়ে এনেছে অভাবনীয় বিজয়, অর্জন করে ফেলেছে স্বাধীনতা। কিন্তু তাতে তো রাষ্ট্রকাঠামো বা সমাজব্যবস্থায় এক রাতে আসেনি আমুল পরিবর্তন। বাংলাদেশকেও তাই স্বাধীনতা অর্জনের পর হাঁটতে হলো প্রথাগত রাষ্ট্রনীতির পথেই। যেকোনো স্বাধীন দেশের মতো বাংলাদেশকেও অবধারিত ভাবেই গড়তে হলো প্রতিরক্ষা বাহিনী, আমলাতন্ত্র। আর ঠিক এখানটিতেই দাবা খেলার গজের চালের দীর্ঘসূত্রিতার শুরু হয়।

নবগঠিত বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও প্রশাসন কাঠামোতে নতুন লোক হুট করে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব ছিলো না। তাই সঙ্গত ভাবেই সেখানে নিয়োগ দিতে হয়েছিলো ইতোপূর্বে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বাহিনী ও সিভিল সার্ভিসে যে সব ব্যক্তি ছিলেন তাদের।

কিন্তু এদের মাঝে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন অথবা নিয়েছিলেন পাকিস্তানের পক্ষ। অথচ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস নিজের ও নিজ পরিবারের জীবন তুচ্ছ জ্ঞান করা বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের সাথে তাদের এক কাতারে রাখা ছাড়া সে সময়ে আর কোনো বিকল্পও ছিলো না। সাথে চিরায়ত সামরিক পক্ষপাতিত্বের সংষ্কৃতিও দেখা দিয়েছিলো নতুন অস্বস্তি নিয়ে।

যে সংষ্কৃতির কারণে মেজর ফারুকের (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল কুশীলব) মতো সেনা কর্মকর্তারাও নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে হয়ে যান পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বাংলাদেশে অবস্থান করা বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। যারা পাকিস্তানে আটকা পড়েছিলেন তারাও দুঃসাহসিক নৈপূন্যে নিজেদের মাতৃভূমির জন্যে পালিয়ে এসেছিলেন সামরিক গৃহবন্দিত্ব ফাঁকি দিয়ে।

অথচ সেই মানুষগুলোই অসম সাহসিকতায় একটা দেশকে স্বাধীন করে দেখতে পেলেন কখন যেন তাদের পাশে এসে পদক নেওয়ার, দেশ চালানোর দায়িত্বের কাতারে দাঁড়িয়ে পড়েছেন সেই লোকগুলোই, যারা এতো দিন নির্লিপ্ত মুখে সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানে ক্যান্টনমেন্টে বসে খেয়েছেন, ঘুমিয়েছেন, সিনেমা দেখেছেন আর্মি সিনেমা হলে। বাংলাদেশ পরাধীন থাকলে যারা অনায়াসে আবার যোগ দিতে পারতেন পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়মিত দায়িত্বে।

সুতরাং এখানে একটি তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব যে অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

নবগঠিত সেনাবাহিনীতে তাই শুরুতেই তীব্র হয়ে উঠেছিলো গ্রুপিং। গ্রুপিঙের এক পক্ষে সন্দেহাতীত ভাবে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের হয়ে ভূমিকা রাখা অফিসার ও তাদের অনুসারী স্টাফরা। আর অন্য পক্ষে কয়েকজন বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও তাদের অনুসারী, পাকিস্তানে পুরোটা সময় অবস্থান করা অফিসার এবং স্টাফরা। এই বিতর্কিত অফিসারদের কারো কারো প্রতি এমন অভিযোগও ছিলো যে এরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ডাবল এজেন্টের ভূমিকা পালন করেছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লড়লেও প্রকৃত আনুগত্য ও যোগাযগ পাকিস্তানের সঙ্গে বজায় রেখেছেন। আজ জাতি তাদের নাম জানে।

সেনাবাহিনীর এই চরম বিবাদমান অন্তর্কোন্দলময় পরিস্থিতি পশ্চিমা ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর জন্যে ছিলো আকর্ষণীয় লক্ষ্যবস্তু। তারা রাষ্ট্রের এই দূর্বলতাটিকে লক্ষ্যে রেখেই সাজায় তাদের ষড়যন্ত্রের দ্বিতীয় ছক।

এই কাজে তারা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানপন্থী (বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাগমিত, বাঙালি হওয়ায় পাকিস্তান আর্মিতে যাদের চাকুরীরত থাকার আর সুযোগ ছিলো না) অফিসারদের। এরা নবগঠিত সেনাবাহিনীতে হীনম্মণ্য অবস্থায় ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিজ নিজ বিতর্কিত ভূমিকার জন্যে।

আর তারই ধারাবাহিকতায় সেই সব অফিসারদের ইন্ধন ও অংশগ্রহণে সংঘটিত হয়েছিলো মর্মান্তিক ১৫ অগাস্ট হত্যাকান্ড। এক রাতে তিনটি ভিন্ন স্থানে যূথহত্যা (বহু সংখ্যক হত্যা মাত্রেই গণহত্যা নয়, তাই নতুন এ শব্দের অবতারণা) চালিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছিলো নীলনকশার প্রথম ধাপ। যার প্রেক্ষিতে ক্ষমতা অধিগ্রহণ করেন খোন্দকার মোশতাক।

কিন্তু ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫ এ বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ পুরুষটিকে সপরিবারে হত্যা করে দেশটিকে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার যে ভয়াবহ নীলনকশা দেশি, বিদেশি চক্রান্তকারীরা করেছিলো তা তখনই পূর্ণাঙ্গ সফলতা পায়নি।

বীর উত্তম খালেদ মোশাররফ এবং তাঁর অকুণ্ঠ সহযোদ্ধা এটিএম হায়দার ও নাজমুল হুদা সহ খালেদ অনুসারী কর্মকর্তারা খালেদের নেতৃত্বে ০৩ নভেম্বর ১৯৭৫ এ সফল সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মোশতাক সরকারকে ক্ষমতাহীন (ক্ষমতাচ্যুত নয়) করেন। খালেদ সেই সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে এবং ঘাতক সেনা অফিসারদের (যারা তখনো রাষ্ট্রপতির বাসভবনেই অবস্থান করতেন) অবরুদ্ধ রেখে তিনি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। এই সময়ে ১৫ অগাস্ট পরবর্তীতে প্রবল অবদমনের শিকার হওয়া আওয়ামিলীগ নেতাকর্মী ও বঙ্গবন্ধু অনুসারীরা পুনরায় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেন, এবং সেটি নির্বিঘ্নে করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এমনকি খালেদ মোশাররফের জন্মদাত্রীও সে সময়ে আওয়ামীলীগের মিছিলে সামনের সারিতে অংশগ্রহণ করেন। এ সকল ঘটনাপ্রবাহ খালেদের উত্থানকে মুজিব হত্যা পরবর্তী মুজিববিরোধী অক্ষের উত্থানের প্রত্যুত্থানের রুপ দেয়। যদিও তা অত্যন্ত অল্প সময়ের জন্যে। যে সময়টায় এক দুঃস্বপ্নের মতো নক্ষত্র পতনের আঘাত কাটিয়ে বাংলাদেশে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি পুনর্গঠিত হতে শুরু করেছে ঠিক সে সময়,
ঠিক আজকের এই দিনটিতে খালেদেরই রণাঙ্গনের সহযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল তাহেরের কাল্পনিক বিপ্লবের উচ্চাভিলাষী হঠকারিতা সারা দেশের ভবিষ্যতকে এক দীর্ঘ সময়ের জন্যে এলোমেলো করে দেয় এক আঘাতে।

গৃহবন্দীত্বে থাকা জিয়া আর সেই সময়ে অবসরপ্রাপ্ত তাহের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একই ব্যাচের ব্যাচমেট ছিলেন। তাই বন্দীদশায় জিয়া তাহেরকে এক গোপন বার্তা প্রেরণ করেন জিয়াকে উদ্ধার করার জন্যে।গৃহবন্দী জিয়ার পাঠানো গোপন সাহায্যবার্তার প্রেক্ষিতে তাহের, যিনি কি না এক বামপন্থি সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে ; তিনি সেনাবাহিনীতে আকষ্মিক মারাত্মক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে আজকের দিনেই সিপাহি অভ্যুত্থানের নামে সেনা অফিসার হত্যার এক নির্মম আয়োজনে লিপ্ত হোন। এখানে উল্লেখ্য, তাহের এক ধরণের নিজস্ব সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক মতাদর্শে আস্থা রাখতেন, এবং সেই মতাদর্শে একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্যে তিনি বেশ দীর্ঘ সময় ধরেই সেনাবাহিনীতে অনুসারী বলয় সৃষ্টি করেছিলেন। এই বলয় বিপ্লবী সেনা সংস্থা নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।

এই দিনটিতে তাহেরের নেতৃত্বে সেই অনুসারীরা বিপ্লবের নামে এক উশৃঙখল হত্যাযজ্ঞের সূচনা করে। অসংখ্য নিষ্পাপ তরুণ ক্যাডেট অফিসার সহ জুনিয়র অফিসার এমনকি লেডি অফিসারকেও নিষ্ঠুর হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হতে হয় তাহেরের বিপ্লবী সেনাদের হাতে। সেনাবাহিনীর প্রচলিত কাঠামোয় অবিশ্বাসী এই সংস্থার সদস্যদের “সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, হাবিলদারের উপর অফিসার নাই”, ” সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই” ইত্যাদি স্লোগানে প্রকম্পিত হয় ক্যান্টনমেন্ট এলাকাগুলো। তিন নভেম্বর থেকেই তাহের মোশাররফের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর সদস্যদের উত্তেজিত করতে জনসংযোগ শুরু করেছিলেন। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষে ৪ নভেম্বর থেকে সেনাদের মধ্যে নানা দাবিসম্বলিত পোস্টার ছড়ানো হয়। পাকিস্তান প্রত্যাগত সিপাহিরা এই কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এই পোস্টারে ছিল বারো দফা দাবি। যেমন যাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, এমন রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে। সেনাসদস্যদের মধ্যে এত র‌্যাংক থাকবে না। বেতন বাড়াতে হবে, থাকা ও খাওয়ার উন্নতি করতে হবে’ ইত্যাদি। অন্যতম একটি দাবী ছিলো ‘ব্যাটম্যান প্রথা লোপ’।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ পরবর্তী নবগঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান প্রত্যাগত সৈনিকরা (১৯৭৪ এ প্রত্যাগত) পূর্বের আয়েশি জীবন পাচ্ছিলো না। প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান অনুগত সৈনিক হিসেবে ১৯৭৪ পর্যন্ত যে জীবনযাত্রা তারা পেয়েছিলো, বাংলাদেশের নবগঠিত সেনাবাহিনীতে তা না পেয়ে তারা অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছিলো। যেটি সৈনিকদের এই অংশটিকে তাহেরের বারো দফার প্রতি আগ্রহী করে তোলে৷ সংঘাত-বিধ্বস্ত শৃঙ্খলাবিবর্জিত সেই সময়টিতে সৈনিকদের একটি বড় অংশই কল্পনা করেছিলো “বাংলাদেশে এখন যেকোনো কিছুই হওয়া সম্ভব। তাহেরের বারো দফার বাস্তবায়ন তবে কেনো নয়?” এই সেনাদের অধিকাংশই তাহেরের বিদ্রোহে অংশ নেয় আদর্শিক জায়গা থেকে নয়, বা আনুগত্যের জায়গা থেকেও নয়, বরং এই বিদ্রোহের মাধ্যমে নিজেদের অনুকুল একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে এমন প্রত্যাশায়। সেই সময়ের ডানপন্থী আওয়ামী-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও যুগপৎ ভাবে মোশাররফের অভ্যুত্থানকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার মদতপুষ্ট বলে প্রচার করছিলো, যা পাকিস্তানপন্থী সেনাদের উত্তেজিত ও উদ্বিগ্ন করার জন্যে প্রবল ভূমিকা রাখে। ০৬ নভেম্বর দিবাগত রাত থেকেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সেনাদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে সশস্ত্র অবস্থায় বেড়িয়ে আসে। এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে তারা ঢাকা শহরে অবাধ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সারা দেশ থেকে আগত বিভিন্ন সেনা ইউনিটের সদস্যরা এদের সাথে যোগ দেয়। একই সঙ্গে যোগ দেয় বঙ্গবন্ধু হত্যার কুশীলব ফারুক-রশিদ বলয়ের অনুসারী সৈনিকরাও।

০৭ নভেম্বর সকাল থেকে দুপুরের ভিতর খালেদ ও তার দুই সাথী অফিসার নাজমুল ও হায়দারকে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর অন্যতম হত্যাকারী অফিসার মহিউদ্দীনের প্রত্যক্ষ নির্দেশে হত্যা করে সৈনিকরা, এরা ফারুক-রশিদ অনুসারী বলয়ের ছিলো। নিহত এই তিন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি কান্ডারী। বাংলাদেশে গেরিলা যুদ্ধের দ্বারা বিশেষত ঢাকার বুকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জনে একচ্ছত্র সাফল্য দেখানো খালেদ, হায়দারদেরই হত্যা করে ক্ষোভ মেটায় মহীউদ্দীনরা।
সেই রাতেই তাহের মুক্ত করেন জিয়াকে। নেপথ্যে তাহেরের মূল উদ্দেশ্য ছিলো বিদ্রোহ-উপদ্রুত পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে জিয়াকে বিপ্লবী সেনা সংস্থার পেশ করা বারো দফা দাবী মানতে বাধ্য করা।

কিন্তু বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক ধারণাই ছিলো না তাহেরের। উশৃঙখল সেনাদের সামনে জিয়া উপস্থিত হওয়া মাত্র পরিস্থিতি বদলে যায়। নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ রুপে তাহেরের হাত থেকে ছুটে চলে যায় জিয়ার হাতে। যদিও জিয়াকে সৈনিকদের সামনে তাহের প্রতিজ্ঞা করান বারো দফা দাবী মেনে নেওয়ার জন্যে। জিয়া সর্বসমক্ষে প্রতিজ্ঞা করলেও পরবর্তীতে বারো দফার মাঝে কেবল জলিল-রবের বন্দীত্বমুক্তির দাবী ব্যতীত অন্য কোনো দাবী তিনি বাস্তবায়ন করেননি। বাস্তবে তা সম্ভবপরও ছিলো না।
অর্থাৎ তথাকথিত এই বিপ্লবের বারো দফার মাঝে কেবল একটি দফাই পরবর্তীতে বাস্তবায়িত হয়েছিলো যেটি রাজনৈতিক কারণে এমনিতেও বাস্তবায়িত হতো বলেই আজ প্রতীয়মান হয়।

ঘটনাপ্রবাহ তার আকষ্মিক উত্তেজনার তুঙ্গ বিক্ষিপ্ত গতি হারানোর পর, বিশৃঙ্খলা ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়ে আসে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো প্রথম সারির অফিসারদের তো তাহেরই হত্যা করেছিলেন। তৎপরবর্তীকালে জিয়াকেও ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে পুনরায় ২৩-২৪ নভেম্বর সময়কালে আবারো তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের চেষ্টা করেন।
যদিও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়া জিয়া তারই সাহায্যের আবেদনে সাড়া দেওয়া তাহেরকে বন্দী করে একটি সংক্ষিপ্ত ক্যাঙারু ট্রায়ালের মাধ্যমে সেই বিদ্রোহের অবসানও ঘটান অবিলম্বেই। ইতিহাসে খুব সম্ভবত এমন সেনা বিদ্রোহের ঘটনা এটিই একমাত্র, যেখানে যাকে মুক্ত করার জন্যে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে, তিনিই বিদ্রোহী নেতার শাস্তি নিশ্চিত করেছেন।

এভাবেই সমাপ্তি ঘটে ০৭ নভেম্বরে সংঘটিত এক রক্তাক্ত বিদ্রোহের। যে বিদ্রোহে মর্মান্তিক ভাবে সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছিলেন সবচেয়ে নবীন অফিসাররাই। ট্রেনিংরত নবীন অফিসারদের রক্ত, লেডি ডক্টরের রক্ত (সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীর স্ত্রী) সহ অসংখ্য সেনা অফিসারের রক্তে রঞ্জিত এ বিদ্রোহ বাংলাদেশকে ধাবিত করেছিলো এমন এক অশান্ত সময়ের দিকে, সৃষ্টি করেছিলো এমন এক নৈরাজ্যময় সামরিক ধারার, যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তী ছয় বছরে ভিন্ন ভিন্ন অসংখ্য সশস্ত্র বিদ্রোহের অভিযোগে ক্যাঙারু ট্রায়ালে প্রাণ হারাতে হয় চার হাজারেরও বেশি সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈনিককে।

মূলত আজকের দিনে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধপন্থী সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের হত্যার যে ভয়াবহ নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিলো পরবর্তী একটানা দশ বছরেরও বেশি সময়ে দফায় দফায় চলা সেই হত্যাযজ্ঞে বাংলাদেশ থেকে চিরতরে বিলীন করে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে বুকে ধারণ করা সব সৈনিককে।

আজকের দিনটি ইতিহাসে চিরকাল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে এই কারণে যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও শেষরক্ষা পেতে চলা বাংলাদেশকে ধ্বংসের খাদে ঠেলে ফেলে দেওয়ার শেষ ধাক্কাটি আজকের দিনেই দেওয়া হয়েছিলো। নিরপরাধ, নিষ্পাপ ও সুচেতনায় সমৃদ্ধ সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক শহীদদের আত্মা নিশ্চয় কখনোই এই নিষ্ঠুর খুনীদের ক্ষমা করবে না। আজকের দিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় সেই মহান শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করছি।

লেখক : সম্রাট দেব চৌধুরী – সোশ্যাল মিডিয়া এক্টিভিস্ট 


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ

নির্বাচিত

সিডনিতে হামলার শিকার বিশপ জনপ্রিয় টিকটক তারকা

মৈত্রী পাইপলাইন: উত্তরাঞ্চলে থাকবে না ডিজেলের সংকট

রাঙামাটিতে ১০০ কোটি টাকায় নির্মাণ হবে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং সেন্টার

ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী

গাজায় ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা ১৯ ফিলিস্তিনিকে গুলি করে মারল ইসরায়েল

সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফের সঙ্গে আর কোনো শান্তি আলোচনা নয়

জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা 

আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের গার্মেন্টসের নতুন বাজার, আসবে তেল-চিনি

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী : ইতিহাসের কৌতূহলোদ্দীপক এক চরিত্র

শান্তি-অগ্রগতি নিশ্চিতে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান শেখ হাসিনার