1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

নতুন কারিকুলাম ও কিছু ভাবনা

নিউজ এডিটর : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২৪

বিগত শিক্ষা কারিকুলাম আমাদের প্রথম থেকেই স্নোবিশ এবং নার্সিসিস্টিক হতে শিখিয়েছে। কে কার চেয়ে ভালো ছাত্র, কে প্রথম হবে, কে দ্বিতীয় হবে, পাশের বাড়ির ছেলে মেয়ের থেকে ভালো করতে পেরেছি কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিযোগিতা করতে করতে এমন এক জাতিতে পরিণত হয়েছি যে আমরা কাউকে সহযোগিতা করতে পারি না।

সহযোগিতামূলক আচরণ আমাদের মধ্যে একেবারেই নেই। যারা একাডেমিক বিষয়ে ভালো করতে পারে না তাদের শিক্ষার্থীরা এমনকি শিক্ষকরাও ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সের মাঝে ফেলে দেয়। ছোটবেলা থেকেই তুলনা শুনে শুনে বড় হয়েছি – “প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ভালো নাকি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ভালো?” এ নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে প্রায়ই তর্ক হয়। আমরা পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, তোরা প্রাইভেটে পড়িস, আমরা অনেক ভালো পড়াশোনার পরিবেশ পাই, আমাদের শিক্ষকরা মেধাবী, আমাদের পড়াশোনার মান ভালো।.. তোরা পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স না পেয়ে প্রাইভেট ভর্তি হয়েছিস। বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও যেন একে অন্যের সাথে সর্বদা একটা টক্সিক মানসিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকা।

যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম, তখন সিনিয়ররা বলতেন, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে না তারা কোন ছাত্রই নয়। আবার মেডিকেল বুয়েটের স্টুডেন্টরা বলতো যারা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয় না তারা কোন ছাত্রই না। এই ভাবেই সারাটা জীবন অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখে দেখে বড় হয়েছি। এভাবেই ছাত্রদের মাথার মধ্যে চারিদিক থেকে শুধু বিষ ঢালা হয়। প্রকৃত বন্ধুত্ব জীবনে খুব কম দেখতে পেয়েছি। সহযোগিতামূলক আচরণ কবে দেখেছি মনে পড়ে না।

যখন দেশ ছেড়েছি তখন বুঝতে পারলাম কিভাবে সহযোগিতামূলক শিক্ষা মানুষের মনকে সুস্থ্য করতে পারে। এরপরে যখন নিজেই বিদেশে শিক্ষকতা করতে শুরু করলাম তখন নিজেই প্র্যাকটিকলি অনুধাবন করলাম।

শিক্ষার মানে কখনোই অসুস্থ প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত নয়। প্রত্যেকটা ব্যক্তি তার জীবনের যুদ্ধে লিপ্ত। কেউ কারো কম্পিটিটর নয়। জীবন বা স্কুল খেলার মাঠ নয়। কেউ যদি ক্লাসে প্রথম হয় বা একেবারে শেষের কাতারে থাকে তাতে কি বা আসে যায়? আপনি যদি কারো থেকে বেশি নম্বর পান আর যদি কেউ কম নম্বর পায় তাতে কি তার মানুষ হওয়ার অধিকার কমে যায়? আপনার থেকে কি সে একটু কম বাঁচবে আর আপনি কি তার থেকে একটু বেশি বাঁচবেন? যে পরীক্ষায় ভালো করলো না সে কি না খেয়ে থাকবে?তার কি জীবিকা উপার্জনের অধিকার নেই? সমাজে, পরিবারে, স্কুলে সবাই তাকে বিদ্রুপ করবে?

ফেসবুকের আবির্ভাবের পর বাঙালির আসল চরিত্র খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। কোন না কোন বিষয় নিয়ে একে অন্যের পিছে লেগে আছে। অন্যকে ছোট করা, অপমান করা এবং উপহাস করাই যেন পৈশাচিক আনন্দ।

সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন নতুন ইস্যু নিয়ে ট্রল চলতেই থাকে। আজকাল নতুন ট্রল হল পাঠ্যক্রম 2023 এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ ভিডিও৷ কেউ শিক্ষা কারিকুলাম বুঝুক বা নাই বুঝুক সমালোচনা সমালোচনা করা চাই। তবে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় সমালোচনা কোথা থেকে আসছে। একটি মহল বহু বছর ধরে মৌলবাদের বীজ বপন করে আসছে। এবং আমরা আজ তার ফলাফল দেখতে পাচ্ছি।

যখন বইয়ের ব্যাগের ভারে ছাত্ররা হাঁটতে পারতো না, স্কুল শেষ করে কোচিংয়ে এবং প্রাইভেট টিউটরের কাছে কাছে ঘুরতে হতো, হাজার হাজার টাকা এক্সট্রা ব্যয় হতো, পড়া শুধু মুখস্থ করতে হতো সেটা নিয়েও সমালোচনার ঝড় বয়েছে। এখন সেই কারিকুলামকে পরিবর্তন করে নতুন একটি উপযোগিতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছে তখন সেটাকেও রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে।

এই আচরণ আসলে আমরা বিদ্যালয়েই থেকেই শিখেছি। ছোটবেলায় হিন্দু বন্ধুদের মালাউন বলে ট্রল করতেও শিখেছি স্কুল বা পরিবারের কাছ থেকেই, আবার কোন নাদুসনুদুস মোটাসোটা বন্ধু থাকলে তাদেরকে নিয়ে আমরা বিদ্রুপ করতে শিখেছি, কেউ পাতলা গড়নের হলে তাকে নিয়েও হাসি ঠাট্টা করেছি। মেয়েরা সুন্দর হলে তো কথায়ই নেই. সৌন্দর্য দেখিয়ে ভালো নম্বার পেয়েছে। নিশ্চই ফেভার পেয়েছে।

কারো শারীরিক গঠন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা যায় না সেটা তো আমরা এখনও শিখিনি। মানুষের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক দুর্বলতা নিয়ে উপহাস করাকে এখানে মহিমান্বিত করা হয়। সহানুভূতি বা কাইন্ডনেস বলতে কোন শব্দ আছে এখনো শিখতেই পারিনি। কোত্থেকে শিখবো? যারা শেখাবে তারাও তো কখনো শেখেনি। তাই অন্যকে ছোট করা আমাদের নিয়মিত আচরণের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে আমরা লজ্জিত হইনা। বিষয়টি যে নিজের জন্য লজ্জার তাও তো আমরা শিখিনি।
এই হচ্ছে আমাদের এখনকার কালচার। এই কালচার দীর্ঘদিনের গড়া হয়েছে। অত্যন্ত সচেতন ভাবে। পাশের বাড়ির মানুষকে ঘৃণা করা, পাশের রাষ্ট্রকে ঘৃণা করা তো আমাদের রন্ধে রন্ধে মিশে গেছে। এখান থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু গ্রহণ করা এত সহজ নয়। কারণ অন্যকে ছোট করে, সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্স দেখিয়ে যেই পরিমাণ বিকৃত আনন্দ পাওয়া যায় আপনি সমবেদনা এবং দয়া অনুশীলন থেকে একই পরিমাণ বিকৃত আনন্দ পাবেন না।

মকারি বা বিদ্রুপের ব্যাপারে আমার জীবনের অভিজ্ঞতা কিছুটা ভিন্ন। ছোটবেলায় আমরা একটা মফস্বলধামে থাকতাম। আমার শৈশব খুব একটা সহজ ছিল না। আমার তিনটে স্পেশাল নিডস ভাই-বোন ছিল। আমার এই ভাই বোন বাইরে গেলেই প্রতিদিন মানুষের মার খেয়ে আসতো। স্কুলে যেতে পারত না ছেলে-মেয়েদের বুলিংয়ের অত্যাচারে। হ্যাপি যদিও দীর্ঘদিন আমার সাথে স্কুলে গিয়েছে কিন্তু স্কুল তাকে মেনে নিতে পারেনি। সে নিজেও স্কুলকে মেনে নিতে পারেনি। কত অত্যাচারে তারা জীবন পার করেছে, নিজের অভিজ্ঞতা ছাড়া এই নির্যাতন কেউ কল্পনাও করতে পারে না।

আমার এই তিন ভাই-বোনের কারণে লোকেরা সারাক্ষণ আমাদের নিয়েও প্রতিনিয়ত ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত। আর সে কারণে আমরা নিজেরাও ওদের তিনজনের প্রতি অনেক নির্মম ছিলাম। মা বাবা তাদের সাথে কোথাও যেতে চাইলে আমরা যেতে চাইতাম না। এ নিয়ে লাগাতার যুদ্ধ চলত।

মারাত্মক সোশ্যাল শেইমের মধ্যে আমরা জীবন যাপন করেছি। বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা নিয়ে ঝগড়া হলেই প্রথমেই বলতো তোর ভাই-বোন তো বোকা। কি পরিমান ইনসেনটিভ যে মানুষ হতে পারে নিজের জীবন দিয়ে প্রতিদিন উপলব্ধি করতাম। সে কারণেই এই বিষয়গুলিতে আমার উপলব্ধি ভিন্ন। উপহাস সহ্য করা কতটা কঠিন তা কেউ বুঝতে পারে না যদি না তারা এটি অনুভব করে। We have experienced more and more how much heterogeneity can make society behave.

আমার ডাউন সিনড্রোম ভাই-বোনদের একজন মাহমুদ। প্রায়শই বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় তার প্যান্ট খুলে রান্নাঘরের স্প্যাটুলা দিয়ে তাকে পুড়িয়ে দেওয়া হত, তার উপর গরম জল ছুঁড়ে দেওয়া হত।

একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখি মাহমুদকে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে এবং সে কূলে উঠে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওর এমন অবস্থায় দেখে আমি তাকে পুকুর থেকে বের করার চেষ্টা করি। অনেক চেষ্টার পর সুপারি গাছের বাঁকল দিয়ে তাকে তুলে নিলাম। আমি এখনো সেই দিনগুলো ভুলিনি।

আমার ভাই-বোনদের সাথে এটি হওয়ার একটি কারণ হল শিক্ষা ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না। মানুষ জানত না কিভাবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তারা কি করে জানবে যে এরা সম্মান ও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য মানুষ!
পাপা অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার সন্তানদের নির্যাতন ও উপহাসের হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি। আবার সেই সব ছেলে-মেয়েই বাবার কাছে পড়তে আসতো। আমার বাবা বেশিরভাগ ছাত্রকে বিনামূল্যে পড়াতেন। তা সত্ত্বেও আমার ভাই-বোনরা নিপীড়ন থেকে মুক্তি পায়নি।

সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝতে পেরেছি যে, আমাদের স্কুলের পাঠ্যসূচিতে যদি প্রথম থেকেই এই সব বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি থাকত তাদের সাথে কীভাবে আচরণ করা যায়, বা তারাও সমাজের একটি অংশ, তাদের নিপীড়ন করা যায় না, তাদের ভালোবাসতে হবে, তাহলে জীবনের সেই অন্ধকার অধ্যায়টি আমাদের এক্সপেরিয়েন্স করতে হতো না।

আমরা ফিনল্যান্ড বা পশ্চিমের শিক্ষা ব্যবস্থাকে উপহাস করি কিন্তু পশ্চিমা দেশে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য আলাদা কোনো স্কুল নেই। সবাই একসাথে একই ক্লাসে পড়ে। অন্তর্ভুক্তি কী বা সহযোগিতা কী তা এখানে ক্লাসে শেখানো হয়। সে কারণেই পাবলিক ‘চলো বন্ধু হই’ অধ্যায়ের সমালোচনা করে, কারণ আমরা অন্তর্ভুক্তি শিখিনি।

তবে, স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে যে কয়টি ভালো প্রকল্প আমরা দেখেছি তার মধ্যে বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম অন্যতম। আমি জানি না শিক্ষকরা এই শিক্ষাকে কতটা ভালো ভাবে পড়াতে পারবেন। তবুও, আমি খুব আশাবাদী। অনেকদিন পর দেশে একটা পরিবর্তন খুব ভালো লাগছে। শিক্ষা এমন হওয়া উচিত যেখানে কেউ বলতে না পারে আমি তোমার চেয়ে বেটার। আমরা সবাই যাতে একসাথে এগিয়ে যেতে পারি এবং একটি সুস্থ সমাজ গঠন করতে পারি, এটুকুই কামনা।

লেখক : নাহিদ আক্তার – শিক্ষক ও গবেষক, সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া। সমাজকর্মী ও সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ